শ্রীল প্রভুপাদ নামে পরিচিতি অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ (Abhayachanaravinda Bhaktivedanta Swami Prabhupada) হলেন ভারতের একজন প্রভাবশালী ধর্মগুরু। ভারতবর্ষে ‘হরেকৃষ্ণ আন্দোলন’-এর অন্যতম প্রধান মুখ এবং ইস্কন(ISKCON)এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন এই শ্রীল প্রভুপাদ। পরবর্তীকালে তিনি ভ্রাম্যমাণ বৈষ্ণব সন্ন্যাসী হিসাবে মূলত পাশ্চাত্যে ভারতের গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের একজন প্রভাবশালী প্রচারকের মর্যাদা পান। সারা বিশ্বে গৌড়ীয় বৈষ্ণবতত্ত্বকে ছড়িয়ে দিতে শ্রীল প্রভুপাদ সচেষ্ট ছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিক্ষিপ্তভাবে তাঁর শিষ্যরা ছড়িয়ে রয়েছেন। তিনি বৈষ্ণবতত্ত্ব সংক্রান্ত প্রচুর বইয়ের অনুবাদ করেছেন, সঙ্গে কিছু বইয়ের টীকা লেখার কাজও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
১৮৯৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্মাষ্টমীর পরের দিন অর্থাৎ নন্দ উৎসবের দিনে কলকাতার একটি বৈষ্ণব পরিবারে শ্রীল প্রভুপাদের জন্ম হয়। তাঁর পিতৃ-মাতৃদত্ত নাম ছিল অভয় চরণ দে। তাঁর বাবার নাম ছিল গৌর মোহন দে এবং মায়ের নাম ছিল রজনী দে। প্রভুপাদ বন্ধুদের সঙ্গে খেলার পরিবর্বতে মন্দিরে যেতে বেশি পছন্দ করতেন। ছোটবেলা থেকেই আধ্যাত্মিকতার পরিবেশে বড় হওয়ায় তাঁর মধ্যে ধর্মভাব প্রকট ছিল।
প্রভুপাদ কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াশোনা করতেন। কলেজে পড়াকালীন তিনি ইংরেজি ও সংস্কৃত এই দুই সমিতিরই সদস্য ছিলেন। ১৯২০ সালে স্নাতক হওয়ার পর স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীজীর ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দেন। ২২ বছর বয়সে রাধারাণী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।
১৯২২ সালে প্রথমবার তাঁর গুরু ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তাঁর গুরুদেবই তাঁকে ইংরেজি ভাষায় চৈতন্য মহাপ্রভুর বার্তা প্রচার করার অনুরোধ জানান। ১৯৩৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের শিষ্য হন এবং এই বছরেই তিনি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ‘ব্যাক টু গডহেড’ (Back to Godhead) নামে একটি বইয়ের প্রকাশনা শুরু করেন। এই প্রকাশনার যাবতীয় দায়িত্ব শ্রীল প্রভুপাদ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ তাঁকে ভক্তিবেদান্ত উপাধিতে ভূষিত করে। পরবর্তীকালে তাঁকে প্রভুপাদ উপাধি দেওয়া হয়। তাঁর শিষ্যরা তাঁকে এই নামেই সম্বোধন করতেন। এই উপাধি পাওয়ার আগে তাঁকে স্বামীজী বলে ডাকা হত। ১৯৫০ সাল থেকে তিনি বৃন্দাবনে অবস্থিত মধ্যযুগের বিখ্যাত রাধা দামোদর মন্দিরে থাকা শুরু করেন। এখানে থাকাকালীন তিনি ভাগবত পুরাণের টীকা লেখা এবং অনুবাদ করার কাজে হাত দেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য সাহিত্যিক উপস্থাপনা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা তিনি ভালই বুঝতে পেরেছিলেন।
১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজের গৌড়ীয় মঠে শ্রীল প্রভুপাদ অভয় বাবু হিসেবে সাদা বস্ত্র পরে মন্দির দর্শনের জন্য ঢোকেন কিন্তু সেখান থেকে বেরোন গেরুয়া বসন পরে, সন্ন্যাসী হয়ে। তাঁর বন্ধু এবং গুরুভাই ভক্ত প্রাজ্ঞ কেশবের থেকে তিনি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। শ্রীল প্রভুপাদ এই মঠেই থাকতেন, পড়াশোনা করতেন এবং এখান থেকেই ‘গৌড়ীয় পত্রিকা’ নামক পত্রিকাটির সম্পাদনা করতেন। এই মঠের শ্রী শ্রী রাধা বিনোদবিহারীজী-র মূর্তির পাশে তিনি চৈতন্য মহাপ্রভুকে স্থাপন করেন। একা হাতে ভাগবত পুরাণের প্রথম বইটির তিনটি খন্ডও তিনি প্রকাশ করেন। প্রতিটি খন্ডে বিস্তারিত টীকাসহ চারশো পাতা রয়েছে। এরপরেই নিজের গুরুদেবের আদেশ অনুযায়ী গোটা বিশ্বে চৈতন্যদেবের বার্তাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি ভারত ছেড়ে বিদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হন। যাত্রাকালে তাঁর সঙ্গে থাকা সুটকেসের ভিতরে ছিল একটি ছাতা, সামান্য কিছু শুকনো খাবার, ভারতীয় মুদ্রায় আট টাকা, এবং কয়েকটি বাক্স ভর্তি বই।
১৯৩৬ সালে ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের দেহত্যাগের কয়েকদিন আগে শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর কাছ থেকে পাশ্চাত্যে ইংরেজি ভাষায় কৃষ্ণ চৈতন্য প্রচারের দায়িত্ব পান। ১৯৬৫ সালে তাঁর গুরুদের ইচ্ছা পূর্ণ করতে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে বেরোন। এই সফরের জন্য কোনো ধর্মীয় সংগঠন তাঁকে অনুদান দেয়নি, বা তাঁর কোনো বিশ্বস্ত অনুগামীর দল তাঁকে ডেকে নিয়ে যায়নি। তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই এই সফরে বেরোন এবং জানান যে সফল হওয়ার জন্য তিনি কৃষ্ণের শরণাপন্ন হয়েছিলেন।
১৯৬৬ সালে নিউইয়র্ক সিটিতে ‘ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস’ বা ইস্কন (International Society for Krishna Consciousness, ISKCON) প্রতিষ্ঠা করে তিনি বৈষ্ণববাদকে পাশ্চাত্যজগতের কাছে উন্মুক্ত করে দেন। তাঁর জীবনের শেষ দশকটি তিনি এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার কাজে নিয়োগ করেন। ইস্কনের প্রধান মুখ হওয়ার সুবাদে তাঁকেই এই প্রতিষ্ঠানের উন্নতি নিশ্চিত করার গুরুদায়িত্ব নিতে হয় এবং এই কাজে তিনি দারুণ সফল হন। ১৯৬৭ সালে সান ফ্রান্সিস্কোতে ইস্কনের আরেকটি শাখা গড়ে ওঠে। সেখান থেকে তিনি তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে করে গোটা আমেরিকা জুড়ে ঘুরে বেরাতে থাকেন। সংকীর্তন, বই বিতরণ, এবং জনসভার মাধ্যমে তিনি এই ‘হরেকৃষ্ণ আন্দোলন’কে পাশ্চাত্য সমাজে জনপ্রিয় করে তুলতে থাকেন।
সময় যত এগোতে থাকে তাঁর নেতৃত্বে ইস্কনের শ্রীবৃদ্ধি হতে থাকে। বিভিন্ন বক্তৃতার জন্য তাঁকে গোটা পৃথিবী জুড়ে সফর করতে হত। শ্রীল প্রভুপাদ এই সফরের জন্য সর্বমোট ১৪ বার গোটা বিশ্বে ভ্রমণ করেছেন, এবং ৬ টি মহদেশে পদার্পণ করেছেন। তাঁর এই বিদেশ সফরগুলিতে তিনি চৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষাকেই প্রচার করেছেন এবং আন্তর্জাতিক দর্শকের কাছে ভক্তিযোগকে পৌঁছে দিয়েছেন। বিদেশের মাটিতে বৈষ্ণববাদকে প্রতিষ্ঠা করার কাজে সফল হয়ে ১৯৭১ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সাল থেকে ভারতে এই আন্দোলন বৃহদাকার ধারণ করে। শ্রীল প্রভুপাদের মন্দির প্রকল্পের অধীনে মায়াপুর এবং বৃন্দাবনে মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতবর্ষেও ইস্কনের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
শ্রীল প্রভুপাদের সাংগঠনিক শক্তি এবং নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ছাড়া আর যে বিষয়টির জন্য তিনি সবথেকে বেশি পরিচিত তা হল তাঁর বই। জীবনের শেষ বারোটি বছরে তিনি ভাগবত গীতা, চৈতন্য চরিতামৃত, শ্রীমদ ভাগবতমতের মতো ৬০টি গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ করেন, যা ৬০টিরও বেশি ভাষায় পাওয়া যায়। এছাড়াও তাঁর অন্যান্য বইও আছে, যা ৮০টিরও বেশি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৭৭ সালের ১৪ নভেম্বর বৃন্দাবনে অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ দেহত্যাগ করেন। তাঁকে বৃন্দাবনের কৃষ্ণ বলরাম মন্দিরে দাহ করা হয়। তাঁর স্মৃতিতে মায়াপুর, বৃন্দাবন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু সমাধিসৌধ নির্মিত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে শ্রীল প্রভুপাদের শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ভারত সরকার তাঁর সম্মানে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে। ১৯৯৮ সালের রামনবমীর দিন নতুন দিল্লিতে ইস্কনের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। অ্যালফ্রেড ফোর্ড, মূলত অম্বরিশ দাস নামে পরিচিত তাঁর এক শিষ্যকে তিনি পৃথিবীর সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণিত একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নের কথা জানান। এই মন্দিরটি বর্তমানে মায়াপুরে তৈরি হচ্ছে।
2 comments