প্রবাদ

প্রবাদ

কথায় কথায় আমরা বলে থাকি ‘প্রবাদপ্রতিম’ কারণ প্রবাদ পুরাণের মতই শক্তিশালী। যেকোনো উৎকৃষ্ট ভাষার একটি প্রধান সম্পদ হল প্রবাদ, ইংরেজিতে যাকে বলে proverb। ব্যুৎপত্তিগতভাবে প্রবাদ এর অর্থ হল প্রকৃষ্ট বাদ অর্থাৎ উৎকৃষ্ট বা শ্রেষ্ঠ উক্তি। পুরাকাল থেকে ধারাবাহিক ভাবে চলে আসা বাক্য, জনশ্রুতি কিংবা লোক সমাজের যুগসঞ্চিত অভিজ্ঞতালব্ধ বোধের সংক্ষিপ্ত প্রকাশ হল প্রবাদ। Oxford Advance Learner’s Dictionary অনুযায়ী প্রবাদের অর্থ ‘Short well known saying that states a general truth or gives advice’।

মনের ভাব অর্থবহ বা যথাযথভাবে যৌক্তিক অর্থে উপস্থাপনাই প্রবাদের মূল কথা।লোকসাহিত্য বিশেষজ্ঞ আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন,  “প্রবাদ বা প্রবচন জাতির সুদীর্ঘ ব্যবহারিক অভিব্যক্তির সংক্ষিপ্ততম রসভিব্যক্তি; ইহা একদিক দিয়ে যেমন প্রাচীন আবার তেমনই অন্যদিক দিয়া আধুনিক। পূর্ব হইতে প্রচলিত হইয়া আসিতেছে বলিয়া প্রাচীন আবার প্রচলিত মনোভাব প্রকাশ করিতেও সহায়তা করিতেছে বলিয়া আধুনিক। বিভিন্নমুখী ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের বহু পরীক্ষিত উপদেশ ও নীতি প্রচার করাই ইহার লক্ষ্য-রূপক বক্রোক্তি ইহার প্রধান অবলম্বন। ইহা যেমন ব্যক্তি ও সমাজজীবনের কর্তব্য নির্দেশক, তেমনই সম্পাদিত কার্যাবলিরও রূঢ় সমালোচক”।

পুরাণে যেমন একটি দেশের একটি জাতির একটি বড় কালপর্বের প্রেক্ষাপট জানা যায় বিভিন্ন প্রবাদেও তেমন বিভিন্ন অভিজ্ঞতার নির্যাস একটি বাক্যে ফুটে ওঠে৷ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের প্রবাদের মধ্যে সামঞ্জস্য ও ভাবগত মিল পাওয়া যায়৷ প্রবাদ সম্পর্কে আরও একটি কথা চালু আছে যে প্রতিটি প্রবাদই সত্যি৷ প্রতিটি প্রবাদে রয়েছে বহুদিনের বহু মানুষের অভিজ্ঞতা, সময় ও সমাজের উপলব্ধি।  মনের ভাব অর্থবহ ও যথাযথভাবে যুক্তিসঙ্গতভাবে উপস্থাপনাই প্রবাদের মূল কথা। প্রতিটি ভাষার প্রবাদ সে ভাষার একান্ত নিজস্ব সম্পদ। প্রবাদবাক্যের শব্দগুলির নিজস্ব অর্থগুলির মর্মার্থ থাকে না৷  সেক্ষেত্রে আমাদের জানতে হবে পুরো বাক্যের মর্মার্থ। প্রতিটি প্রবাদের পেছনে রয়েছে নানা রকম কাহিনী বা গল্প। এই গল্প কাহিনীগুলোর কোনোটা পৌরাণিক, কোনোটা ঐতিহাসিক, কোনোটা আবার আধুনিক। প্রবাদের অর্থ হতে হবে গভীর ও তাৎপর্যময়। প্রবাদের অর্থ তীক্ষ্ণ যা সহজেই শ্রোতা ও পাঠককের মনে আশ্রয় নেবে। প্রবাদের অর্থ সর্বদাই রূপকধর্মী।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

প্রবাদ মূল ভাব অনুযায়ী নানা ভাগে ভাগ করা যেতে পারে – যেমন
সাধারণ অভিজ্ঞতামূলক: কান টানলে মাথা আসে।
নীতিমূলক: অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট।
সমালোচনামূলক: উচিত কথায় মামা বেজার।
সামাজিক রীতিবিষয়ক: অতি লোভে তাঁতি নষ্ট
ব্যঙ্গাত্মক: চোরে চোরে মাসতুতো ভাই

এছাড়া বাংলা প্রবাদের বিষয়গুলিও বৈচিত্র্যময়। যেমন,
দেবদেবী বিষয়ক: রাখে হরি মারে কে? 
পৌরাণিক চরিত্র বিষয়ক: একা রামে রক্ষা নেই সুগ্রীব দোসর।
ইতিহাস প্রসিদ্ধ চরিত্র বিষয়ক: রাণী ভবানী আর ফুল জেলেনী। 
সমাজ বিষয়ক: তিলক কাটলেই বোষ্টম হয় না।
পরিবার বিষয়ক: মেয়ে বাঁচলে জামাই আদর।

প্রবাদের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অধ্যাপক সুশীলকুমার দে বলেছেন, ‘‘এগুলি রচনা করিবার জন্য রচিত হয় নাই, মানুষের মনে আপনি জন্মিয়াছে, তাই মানুষের মুখে আপনি প্রচলিত হইয়াছে। প্রথম যিনি, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের জ্বালা-পরম্পরার দুঃসহতা… অনুভব করিয়াছিলেন, তিনি তাঁহার প্রত্যক্ষ ভাবটি দৈনন্দিন সাধারণ বুদ্ধির টুকরা হিসাবে বিবৃত করিয়া যে ক্ষিপ্র টিপ্পণী কাটিয়াছিলেন, তাহা ক্রমে অভ্যস্ত বাক্যে, জনশ্রুতিতে বা প্রবাদে পরিণত হইয়াছিল।’’ বাংলা ভাষায় প্রাচীনতম সাহিত্য ‘চর্যাপদ’ তারপর মধ্যযুগে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব সাহিত্য, কৃত্তিবাসী রামায়ন, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ প্রমুখের রচনাই অজস্র প্রবাদের উৎস৷ প্রবাদের পাশাপাশি আমাদের কাছে অতিপরিচিত শব্দ ‘প্রবচন’। বাংলায় ‘বচন’ শব্দটির ব্যাপক প্রচলন আছে৷ যেমন ডাকের বচন, খনার বচন, চাণক্য বচন প্রভৃতি৷ প্রকৃতপক্ষে প্রবাদ বলতে আমরা এখন যা বুঝি তা একসময় প্রবচন দিয়ে বেঝানো হত৷ রবীন্দ্রনাথ অবশ্য অন্যমত পোষন করতেন। প্রভাতকুমারকে লেখা তাঁর একটা চিঠিতে তিনি বলেছেন প্রবাদে একটা গল্পের ভাব আছে কিন্ত প্রবচন সেই তুলনায় অনেকটাই ছাঁটা-কাটা। যদিও বর্তমান সময়ে প্রবাদ-প্রবচন প্রায় সমার্থক এবং পরিপূরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে৷ প্রবাদ হল জনসাধারণের উক্তি তাই এর ভাষা হল সরল, সহজেই এর অভিব্যক্তি মনে থেকে যায়৷ প্রবচনের ক্ষেত্রে কোন বাক্যের অর্থের আক্ষরিক অনুবাদ করলে অনূদিত বাক্যটি কখনই প্রবচনে পরিনত হয় না৷ যেমন, To kill two birds with one stone এর বাংলা অনুবাদ ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারা’। এটি কেবলমাত্র উপরের ইংরাজি বাক্যের ভাষান্তর, ‘রথ দেখা কলা বেচা’ হল অনুরূপ বাংলা প্রবাদ৷

বলাবাহুল্য, প্রত্যেক প্রবাদের উৎপত্তির পিছনে রয়েছে কোন কাহিনী বা ঘটনা। সেই সব কাহিনীর কিছু কিছু আমাদের জানা আবার অনেক কিছুই গেছে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে। বিভিন্ন প্রবাদের উৎস বা তার পিছনের গল্পগুলি জানতে দেখুন এখানে।  

তথ্যসূত্র


  1. https://blogs.eisamay.indiatimes.com/
  2. https://www.prothomalo.com/
  3. বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি - পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ; ৯৬পৃঃ
  4. প্রবাদের উৎস সন্ধান - সমর পাল, শোভা প্রকাশ / ঢাকা ; ৯ পৃঃ

আপনার মতামত জানান