আশুতোষভট্টাচার্য

আশুতোষ ভট্টাচার্য

আশুতোষ ভট্টাচার্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একজন স্বনামধন্য সাহিত্যিক ও লোকসংস্কৃতিবিদ। মূলত লোকসংস্কৃতিবিদ্ হিসেবে পরিচিত হলেও বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। পুরুলিয়ার ছৌ নৃত্যকে বিশ্বমঞ্চে তিনিই প্রথম তুলে ধরেন।

১৯০৯ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার ঝালুয়া গ্রামে মামাবাড়িতে আশুতোষ ভট্টাচার্যের জন্ম হয়। এই জেলারই বকজোড়গান্দি গ্রামে ছিল তাঁর পৈতৃক ভিটে। পিতা মুরারিমোহন ভট্টাচার্য ছিলেন পেশায় একজন আইনজীবী।

প্রথম থেকেই আশুতোষ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কিশোরগঞ্জ উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয় থেকে ১৯২৬ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে ১৯২৮ সালে আই.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে বাংলা সাহিত্যে ও পরে সংস্কৃতে এম.এ পাশ করেন তিনি। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৫৯ সালে পি.এইচ.ডি লাভ করেন আশুতোষ।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

আশুতোষ ভট্টাচার্যের কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষক হিসেবে। আসানসোল রেলওয়ে স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করতেন। এরপর ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন তিনি। পরবর্তী কালে ১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে অধ্যাপক এবং পরে বিভাগীয় প্রধান হন। ১৯৭৮ সালে তিনি অধ্যাপনা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

তবে শুধু মাত্র অধ্যাপনার কাজেই তিনি নিজেকে নিয়োজিত রাখেননি। অধ্যাপনার মাঝে তিনি কয়েক বছর প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ ভেরিয়ার এলউইনের সহকারী গবেষক হিসেবে আ্যনথ্রোপলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায় সাত বছর কাজ করেছিলেন। এ ছাড়াও লোকসংস্কৃতি  পরিষদ, নিখিলবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনেও প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। লোকসাহিত্য ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, রাশিয়া সহ বিভিন্ন দেশে তিনি লোকসংস্কৃতি বিষয়ে ভাষণ  দিয়েছিলেন। পুরুলিয়ার বিখ্যাত ছৌ নৃত্যকে তিনিই প্রথম বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন।

আশুতোষ ভট্টাচার্য ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাহিত্যিক ও লোকসংস্কৃতিবিদ্। লোকসংস্কৃতি হল পল্লিবাসী মানুষের কল্পনার ও সৃষ্টিশীলতার এক অপূর্ব রূপ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লোকসংস্কৃতি কে ‘জনপদের হৃদয় কলরব’ বলে অভিহিত করেছেন। লোকসাহিত্য প্রধানত ৮টি শাখায় বিভক্ত – লোকসঙ্গীত, গীতিকা, লোককাহিনী, লোকনাট্য, ছড়া, মন্ত্র, ধাঁধা ও প্রবাদ। বাংলা লোকসাহিত্যের এই আটটি শাখা নিয়েই রচিত হয়েছে আশুতোষ ভট্টাচার্যের বাংলার লোকসাহিত্য (১ম – ৬ষ্ঠ খন্ড)। বাংলা লোকসঙ্গীত যেমন পার্থিব জীবন, প্রেম ইত্যাদি তুলে ধরেছে তেমনি তত্ত্বের গভীর কথাও ব্যক্ত করেছে। আধ্যাত্মিক দর্শনের গূঢ় তত্ত্বের প্রকাশ রয়েছে লোকগানে। গীতিকা হল গান গাওয়ার উপযোগী ছন্দোবদ্ধ রচনা। মৈমনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা প্রভৃতি বিখ্যাত গীতিকার উদাহরণ। লোককাহিনী হল লোকমুখে প্রচলিত কাহিনী। ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’, ‘সিন্দাবাদ’ এই গুলি লোক কাহিনীর উদাহরণ। গীত-বাদ্য-নৃত্য সহযোগে লোকনাট্য পরিবেশিত হয়। পুতুল নাচ লোকনাট্যেরই একটি মাধ্যম। সামাজিক আচার পালনের অন্যতম অঙ্গ ছড়া, মন্ত্র ও ধাঁধা।

লোকসাহিত্য ছাড়া আশুতোষ ভট্টাচার্য ‘বাংলা মঙ্গল কাব্যের ইতিহাস’, ‘বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস’, ‘বাংলা সামাজিক নাটকের বিবর্তন’ বিষয়ক তিনটি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। এ ছাড়াও একাধিক গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর।

ছৌ নৃত্যের অন্যতম পৃষ্ঠ পোষক ছিলেন তিনি। ছৌ শিল্পীদের সংগঠিত করে দেশ বিদেশে ছৌ নৃত্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। তিনি ‘রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ ফোক কালচার’ প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৬০ সালে।‘লোকশ্রুতি’ নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেন তিনি। লোকসাহিত্য ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন আশুতোষ। তাঁর রচিত ইতিহাস ধর্মী রচনা, কাব্য, ছোট গল্প, উপন্যাস ও ভ্রমণ কাহিনী প্রভৃতি রচনাগুলিও উল্লেখযোগ্য। তাঁর মৌলিক ও সম্পাদিত অন্যান্য গ্রন্থগুলি হল- ‘বাংলার কথা সাহিতের ইতিহাস’ (১৯৬৪), ‘মহাকবি শ্রী মধুসুদন'(১৯৬৪), ‘রবীন্দ্র নাট্যধারা'(১৯৬৬), ‘রবীন্দ্রনাথ ও লোকসাহিত্য'(১৯৭৩), ‘দ্বিজেন্দ্রলালের প্রহসন’ (১৯৭৪), ‘বাইশ কবির মনসামঙ্গল'(১৯৫৪), ‘শিবায়ন'(১৯৫৬), ‘গোপীচন্দ্রের গান'(১৯৫৯), ‘পদ্মপুরাণ’ (১৯৭০), ‘কৃত্তিবাসী রামায়ন'(১৯৭৬), ‘কাশীদাসী মহাভারত'(১৯৭৬), ‘নটীবিনোদিনী রচনাসমগ্র’ (১৯৮৭), ‘পুরুলিয়া থেকে প্যারিস'(১৯৭৫), ‘সোভিয়েতে বঙ্গসংস্কৃতি’ (১৯৬৫), ‘সুন্দরী ইন্দোনেশিয়া'(১৯৭৬), ‘ইরান ভ্রমণ’ (১৯৭৭), ‘অজানা অস্ট্রেলিয়া'(১৯৭৮), ‘জাপানের আঙ্গিনায়'(১৯৮১), ‘অন্ধকারের আন্দামানে’ (১৯৮৩) ইত্যাদি।

সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক (১৯৫০) এবং শিশির স্মৃতি স্বর্ণপদক (১৯৬১)-এ ভূষিত করে। আশুতোষ ভট্টাচার্য ১৯৮৩ সালে কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির বি সি এল স্বর্ণপদক লাভ করেন। এছাড়াও দিল্লির সঙ্গীত নাট্য অকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হওয়ার সম্মান লাভ করেন।

১৯৮৪ সালের ১৯ মার্চ কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।।

আপনার মতামত জানান