ভারতের প্রথম মহিলা স্কাই-ডাইভার হিসেবে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন র্যাচেল থমাস (Rachel Thomas) । সুমেরুতে সাত হাজার ফুট উচ্চতা থেকে স্কাই-ডাইভিং করে তিনি এক বিরল কৃতিত্বের অধিকারিণী হয়েছেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তিনি নিজের প্রতিভার প্রকাশ ঘটানোর সঙ্গে ভারতের প্রতিনিধিত্বও করেছেন। স্কাই-ডাইভিং-এ কৃতিত্বের জন্য ভারতের চতুর্থ নাগরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
১৯৫৫ সালের ৯ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের রেল-শহর চিত্তরঞ্জনে র্যাচেল থমাসের জন্ম। তাঁর বাবা আলেকজান্দ্রা ইর্ত্তেচেয়া এবং মা এলিজাবেথ ইর্ত্তেচেয়া দুজনেই ভারতীয় রেলের কর্মচারী ছিলেন। তাঁদের আদি বাড়ি ছিল কেরালায়। র্যাচেলের একটিমাত্র ছোট বোনের নাম সুসান।
এই ধরণের তথ্য লিখে আয় করতে চাইলে…
আপনার নিজের একটি তথ্যমূলক লেখা আপনার নাম ও যোগাযোগ নম্বরসহ আমাদের ইমেল করুন contact@sobbanglay.com এ
র্যাচেল থমাস -এর যখন মাত্র সতেরো বছর বয়স, তখন তাঁর বিয়ে হয় আর্মি অফিসার ক্যাপ্টেন কে. থমাসের সঙ্গে আর বিয়ের পরের বছরই তাঁর প্রথম পুত্রসন্তান ডেনিস জন্মগ্রহণ করে। তার দুই বছর পরে মেয়ে অ্যানির জন্ম হয়। কিন্ত বিবাহিত জীবনের দশ বছর পরে র্যাচেলের বিচ্ছেদ হয়। র্যাচেল থমাস -এর মেয়ে অ্যানি ১৯৯৮ সালে ভারতের সুন্দরী প্রতিযোগিতা ‘ফেমিনা মিস ইন্ডিয়া’য় অংশগ্রহণ করে প্রথম স্হান অধিকার করেছিলেন।
র্যাচেলের পড়াশোনা শুরু হয় চন্দননগরের সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট স্কুলে। এরপরে তিনি আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে স্বর্ণপদক সহ স্নাতক উত্তীর্ণ হন এবং তারপর আগ্রার বাকুন্তি দেবী কলেজ থেকে শিক্ষাবিজ্ঞান বিষয়ে প্রথম বিভাগে পাশ করেন।
র্যাচেলের কর্মজীবন শুরু হয় আগ্রায় সেন্ট জর্জ স্কুলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। বেশ কিছুদিন ওই স্কুলে শিক্ষকতা করার পরে তিনি ভারতীয় রেল বিভাগে যোগদান করেন। র্যাচেলের স্কাই ডাইভিং জীবন শুরু হয় ১৯৭৯ সালে আগ্রাতে থাকাকালীন। সেনাবাহিনীর এক জমায়েতে তিনি জানতে পারেন স্কাই ডাইভিং-এর সম্বন্ধে। সেই বছরই ২০ এপ্রিল তিনি আগ্রার ‘স্কাই ডাইভিং ফেডারেশন অফ ইণ্ডিয়া’ থেকে ভারতের প্রথম মহিলা স্কাই ডাইভার হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু করেন এবং ‘এ’ লাইন্সেস সহ স্কাই ডাইভিং-এর প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করেন। সাড়ে চার হাজার ফুট উচ্চতা থেকে ঝাঁপ শূন্যে লাফ দিয়ে প্রথম ভারতীয় মহিলা স্কাই ডাইভার হিসেবে ইতিহাস তৈরি করেন র্যাচেল থমাস। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, তিনি এর আগে কোনোদিনই স্কাই ডাইভিং করেননি। তখন তাঁর চব্বিশ বছর বয়স এবং দুই সন্তানের জননী তিনি। র্যাচেলের প্রথম প্রদর্শিত ডাইভিংটি ছিল জব্বলপুরের আর্মি অর্ডিন্যান্সে। সেখানে তিনি প্যারা কমান্ডার হিসেবে প্রর্দশনীতে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৩ সালে র্যাচেল ‘অ্যারো ক্লাব অফ ইণ্ডিয়া’ আয়োজিত ‘ফেডারেশন এ্যারোনটিক্যাল ইন্টারন্যাশানাল অ্যানুয়াল কনফারেন্স’-এ অংশগ্রহণ করেন। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার প্যারা-শুটিং ফেডারেশনের সভাপতি ক্লড গ্লিলার্ডের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তিনি র্যাচেলকে সেই বছরই অনুষ্ঠিতব্য অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় প্যারাশুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে অংশহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানান এবং র্যাচেল থমাস সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর থেকে তিনি আমেরিকায় গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য বৃত্তি লাভ করেন। সেই বছরই নর্থ ক্যারোলিনার রেয়ারফোর্ড থেকে দক্ষ ডাইভার হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ শেষ করেন র্যাচেল এবং দেড়শোটি ডাইভিং সম্পূর্ণ করেন। ১৯৮৭ সালে চতুর্থ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের হয়ে তিনি প্রথম প্রতিনিধিত্ব করেন সিওলে। ১৯৮৮ সালে তিনি সুইডেনে উনিশতম বিশ্ব-প্যারাশুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এই চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি ছয় ধরনের ডাইভিং প্রদর্শন করেন। ১৯৮৯ সালে থাই ওপেন প্যারা-শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন র্য্যাচেল।
শুধু বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নয়, ভারতেও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় র্যাচেল অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৯১ সালে হিডনে অনুষ্ঠিত ‘এয়ারফোর্স অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন অর্গানাইজেশন’ আয়োজিত প্রথম জাতীয় স্কাই ডাইভিং প্রতিযোগিতায় তিনিই প্রথম মহিলা প্রতিযোগী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯৫ সালে আগ্রায় তৃতীয় জাতীয় স্কাই ডাইভিং চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
র্যাচেল ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্হানে তাঁর প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছেন। ১৯৯৫ সালে ভারতের প্রথম যুব উৎসবে তিনি তৎকালীন ভারতের রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মার উপস্থিতিতে স্কাই ডাইভিং করেন যেখানে রাষ্ট্রপতি তাঁর উদ্দেশ্যে অভিনন্দনবার্তা জ্ঞাপন করেন। ১৯৯৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি অরুণাচল প্রদেশের ইটানগরে আয়োজিত রাজ্য উৎসবে তিনি স্কাই ডাইভিং প্রদর্শন করেন। আর ঠিক পরের বছর ১৯৯৭ সালে আর্মি অ্যাডভেঞ্চার টিমের পোলো ম্যাচের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে র্যাচেল নিজের স্কাই ডাইভিং প্রদর্শন করেন। সেখানেও প্রধান অতিথি ছিলেন রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মা। ভারতীয় বায়ুসেনার টিমের সঙ্গে র্যাচেল ব্যাঙ্গালোরে যুদ্ধবিমান মিগ-৮ থেকে দশ হাজার ফুট উচ্চতায় ঝাঁপ দেন, সময়টা তখন ১৯৯৮ সাল। ১৯৯৯ সালে পঞ্চম লক্ষ্মৌতে পঞ্চম যুব উৎসবে অংশগ্রহণ করেন তিনি। সর্বদাই কর্মব্যাপ্ত রয়েছে তাঁর জীবন।
২০০০ সালে জর্ডনের যুবরাজ হামযাব বিন হুসেন তাঁর পিতা রাজা হুসেনের স্মরণে একটি সম্মানীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন যেখানে র্যাচেল যুবরাজ হুসেনের সঙ্গে স্কাই ডাইভিং করেন। ২০০১ সালে র্যাচেল পাঁচটি দেশের স্কাই ডাইভারদের সঙ্গে একত্রে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন আর এর পরের বছর ২০০২ সালে যুব উৎসবে হরিয়ানার হিসারে প্রথমবারের জন্য তিনি বেলুন থেকে স্কাই ডাইভ প্রদর্শন করেন। ঐ বছরই উত্তর মেরুতে স্কাই ডাইভিং করে বিশ্বরের্কড গড়ার পরে তিনি ২০০৩ সালে শেষবারের মতো যুব উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। কারণ এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে পিঠের হাড় ভেঙে যাওয়ার পরই তিনি স্কাই ডাইভিং থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
র্যাচেলের সবচেয়ে বড় কৃতিত্বের মধ্যে ছিল উত্তর মেরুতে -৪৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সাত হাজার ফুট উচ্চতা থেকে স্কাই ডাইভিং করা। এটি ছিল র্যাচেলের একটি স্বপ্ন আর নিজের এই স্বপ্নকে বাস্তব করার জন্য খুব খারাপ আবহাওয়াতে হিমবাহের উপরে ছয়দিন অবস্থান করেছিলেন তিনি। এক ভয়ানক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই তাঁকে সেসময় যেতে হয়েছে। ভারতীয় রেলের দেড়শো বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে তিনি এই বিশেষ পদক্ষেপটি নেন। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে উত্তর মেরুতে স্কাই ডাইভিং করে তিনি বিশ্বরের্কড গড়ে তোলেন।
শুধুমাত্র নিজেই স্কাই ডাইভিং করে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেননি তিনি, বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেছেন র্যাচেল থমাস। ১৯৮৭ সালে তাঁকে বিশেয অনুমতি দেওয়া হয় ভারতীয় বায়ুসেনার আগ্রার প্যারা-শুটিং স্কুলে ট্রেনিং দেওয়ার জন্য যেখান থেকে তিনি প্রথম তাঁর ‘স্কাই ডাইভিং কেরিয়ার’ শুরু করেন। ১৯৮৯ সালে ‘এরো ক্লাব, তুর্কি’তে তাঁকে বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয় প্যারা-শুটিং ট্রেনিংয়ের জন্য। রাশিয়ার ওলোসোও থেকেও প্রশিক্ষক হিসেবে অনুমতি আসে র্যাচেল থমাসের।
বিভিন্ন সময়ে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্যারা-শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে বিচারকের আসন অলংকৃত করেছেন। ১৯৯২ সালে অস্ট্রিয়াতে ২১তম বিশ্ব প্যারা-শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের প্রথম স্বীকৃত বিচারক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন তিনি এবং এরপর ১৯৯৪ সালে চিনে ২২তম বিশ্ব প্যারা-শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপেও বিচারক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৯৫ সালে তুর্কিতে আয়োজিত হয় ‘তৃতীয় ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ’ যাতে শেষবারের মতো তিনি বিচারকের আসনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ভারতের প্যারা-শুটিং কমিশনের হয়ে নানা সময় তিনি সারা পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৯৯১ সালে সুইজারল্যাণ্ডে আন্তর্জাতিক প্যারা-শুটিং কমিশনের বৈঠকে তিনি ভারতের প্রতিনিধি হয়ে যোগদান করেন। এরপরে ১৯৯২ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্যারা-শুটিং কমিশনেও তিনি ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন যেখানে তিনি তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ করে ভারতকে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করেন। আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘ইন্টারন্যাশনাল প্যারা-শুটিং কমিশন’-এ ১৯৯৪তে প্রতিনিধিত্ব করেন র্যাচেল। আর ঐ বছরই ভারতের আগ্রায় অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক প্যারা-শুটিং প্রতিযোগিতায় তিনি সংগঠক হিসেবে প্রভূত সহায়তা করেন। এই অনুষ্ঠানে সারা পৃথিবীর মোট পঁয়ত্রিশটি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল। সবশেষে বলতে হয়, নরওয়েতে আন্তর্জাতিক প্যারা-শুটিং-এর বৈঠকে ১৯৯৫ সালে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
র্যাচেল থমাস সারা জীবনের কৃতিত্বের জন্য বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৯৩ সালে তিনি রেলওয়ে মিনিস্ট্রির তরফে পুরস্কার পান। ১৯৯৫ সালে তিনি ‘ইন্দিরা গান্ধী প্রিয়দর্শিনী’ পুরস্কারে সম্মানিত হন। পরে ২০০৩ সালে ‘পিপল অফ লিমকা বুক’-এ নথিভুক্ত হয় তাঁর নাম। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম র্যাচেল থমাসকে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে সম্মানিত করেন ২০০৫ সালে।
র্যাচেল থমাস বর্তমানে তাঁর কন্যার সঙ্গেই দুবাইতে থাকেন।
তথ্যসূত্র
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.deccanchronicle.com/
- https://www.edexlive.com/
- https://www.coca-colaindia.com/
