রামামূর্তি রাজারামন

রামামূর্তি রাজারামন

ভারতের একজন সুবিখ্যাত পদার্থবিদ এবং অধ্যাপক হিসেবে পরিচিত রামামূর্তি রাজারামন (Ramamurti Rajaraman)। বর্তমানে তিনি দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (JNU) পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। গবেষণার পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন একাধিক বিজ্ঞানমূলক গ্রন্থ।

১৯৩৯ সালের ১১ মার্চ রামামূর্তি রাজারামনের জন্ম হয়। ১৯৫৮ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতক স্তরের পরীক্ষায় পাশ করার পরে ১৯৬৩ সালে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন রামামূর্তি। তাঁর শিক্ষক ছিলেন বিজ্ঞানী হ্যান্স বেথ (Hans Bethe)। ১৯৬৩ সালেই টি.আই.এফ.আর (TIFR)-এ একটি সংক্ষিপ্ত পোস্ট-ডক্টরাল কর্মকালের পর তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যেতে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক রূপে ফিরে আসেন। ১৯৬৯ সালে প্রিন্সটনের ‘ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডি’তে দুই বছর কাটিয়ে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। এরপর প্রথমে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন রামামূর্তি। তারপর ব্যাঙ্গালোরের ‘ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স’ (IISc)-এ তিনি অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করার পর সবশেষে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার এমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন তিনি।

রাজারামনের গবেষণার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল তাঁর কাজের বৈচিত্র্য। ১৯৬২ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় তাঁর কাজ পারমাণবিক বহুদেহ তত্ত্ব (nuclear many body theory), প্রাথমিক কণা, কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব, সলিটন পদার্থবিদ্যা (soliton physics), কোয়ান্টাম হল প্রভাব (quantum hall effect), এবং পরিসংখ্যানগত বলবিদ্যা (aspects of Statistical Mechanics)-র দিকগুলিতে বিচরণ করে। এছাড়াও ২০০০ সাল থেকে তিনি বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ, ভারতের অসামরিক এবং সামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি এবং উচ্চশিক্ষা সহ জননীতির প্রযুক্তিগত ও পরামর্শমূলক কাজেও গভীরভাবে নিযুক্ত রয়েছেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

 ১৯৬২-৬৩ সালে তাঁর পিএইচডি থিসিসের জন্য রাজারামন ব্রুকনার প্রতিক্রিয়া (Brueckner reaction)  নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তিনি এই প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত আরও নতুন গবেষণা করার জন্য একটি পদ্ধতির রূপরেখাও দিয়েছেন। পরবর্তীকালে হ্যান্স বেথ রাজারামন প্রদত্ত এই রূপরেখাকে পারমাণবিক পদার্থের তিন-নিউক্লিয়ন সমস্যার (three-nucleon problem) জন্য একটি সারগর্ভ তত্ত্বে রূপান্তরিত করেন। এই উন্নয়নগুলি ১৯৬৭ সালে বেথ সহ রাজারামনের পর্যালোচনা নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তীকালে, বি.এইচ.জে.ম্যাককেলার, রাজারামনের পারমাণবিক পদার্থের উপর নিউক্লিয়নের মধ্যে অন্তর্নিহিত ত্রি-দেহ (intrinsic three-body) এবং উচ্চতর বহু-দেহ (higher many-body)  শক্তির প্রভাব বিষয়ে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। তাঁর গবেষণা সন্দর্ভে পৃথকভাবে রাজারামন দেখিয়েছেন যে নিউক্লিয়ন-নিউক্লিয়ন পারস্পরিক সম্পর্ক নিউট্রন নক্ষত্রে পায়ন ঘনীভবনকে (pion condensation) দমন করে।

সত্তরের দশকে রাজারামন কণা পদার্থবিদ্যা তথা পার্টিকল ফিজিক্সকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তার গবেষণাকে প্রসারিত করেন। সেই সময়ে এস-ম্যাট্রিক্স (S-matrix) এবং রেজ পোল (regge pole) কৌশল ব্যবহার করে উচ্চ শক্তির হ্যাড্রন স্ক্যাটারিং (hadron scattering) বিশ্লেষণ করা হচ্ছিল। যেহেতু হ্যাড্রন স্ক্যাটারিং-এ ফ্রোইসার্ট-মার্টিন অ্যাসিম্পটোটিক সীমা (Froissart-Martin asymptotic bounds) দুর্বল মিথস্ক্রিয়াগুলির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তাই রাজারামন শূন্য-ভর নিউট্রিনোগুলির (zero-mass neutrinos) একটি স্ব-সংগতিপূর্ণ তত্ত্ব তৈরি করেছিলেন।

১৯৮২ সালে রাজারামন এবং তাত্ত্বিক জন বেল (John Bell) ভগ্নাংশের ফার্মিয়ন সংখ্যা (fractional fermion number) সহ কোয়ান্টাম অবস্থার অদ্ভুত ঘটনাটি পরীক্ষা করেছিলেন যা জ্যাকিউ এবং রেব্বি (Jackiw and Rebbi) দ্বারা তাত্ত্বিকভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল। এই ফলাফলগুলি প্রথম দর্শনে সাধারণ জ্ঞান লঙ্ঘন করেছিল বলে মনে করা হয়। রাজারামন এবং বেল এই ধাঁধাটির সমাধান করেছিলেন। দুটি গবেষণাপত্রে তাঁরা সমস্যাটির সমাধান সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, একটি ধারাবাহিক ডিরাক তত্ত্বে এবং অন্যটি পলি-অ্যাসিটিলিনের জাফরী মডেল (lattice model)-এ। তাঁরা দেখিয়েছিলেন যে ইলেক্ট্রনের অনুপস্থিত ভগ্নাংশ (missing fraction of the electron) সিস্টেমের প্রান্তে লুকিয়ে থাকে, যেমনটি তখন থেকে কিছু পরীক্ষায় দেখা গেছে।

১৯৮৫ সালে বিজ্ঞানী আর. জ্যাকিউ-এর সঙ্গে রাজারামন গেজ তত্ত্বের উপর কাজ করেছিলেন। তাঁরা দেখিয়েছিলেন গেজ তত্ত্ব অসঙ্গত নয়, এটি সাধারণ বিশ্বাসের বিপরীত কথা বলে। তাঁরা ‘চিরাল সুইংগার মডেল’ (Chiral Schwinger Model, CSM)-এর সমাধান করেছিলেন। একইভাবে, রাজারামন বিজ্ঞানী জৈনের ফ্লাক্স-ইলেক্ট্রন কম্পোজিট (flux-electron composites) এর জন্য ফিল্ড অপারেটর তৈরি করেছিলেন। তিনি বাইলেয়ার কোয়ান্টাম হল সিস্টেম (Bilayer quantum hall systems)-এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যও অধ্যয়ন করেছেন। জীম্যান কাপলিং (zeeman coupling)-এর একটি কাজ হিসাবে এ. এইচ. ম্যাকডোনাল্ড (A.H. MacDonald), টি. জাঙ্গউইর্থ (T. Jungwirth) এবং রাজারামন লেয়ার বায়াস (layer bayas) এবং ইন্টারলেয়ার টানেলিং (interlayer tunneling) এই দুটি ফিলিং ফ্যাক্টর (filling factor)-এর ফেজ ডায়াগ্রাম নির্মাণ করেছেন। তাঁরা দেখিয়েছিলেন যে, এর নিচের অংশে ভাঙা প্রতিসাম্যের (broken symmetries) একটি সমৃদ্ধ কাঠামো রয়েছে যার মধ্যে একটি ক্যান্টেড অ্যান্টি-ফেরোম্যাগনেটিজম (canted anti-ferromagnetism) প্রদর্শন করে।

রাজারামন ১৯৭৪ সালে পোখরানে প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষার অনেক আগে ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছেন। যদিও ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি শুরু করার পরেও, তিনি অনুভব করেছিলেন পারমাণবিক সংযম এবং হুমকি হ্রাসের জন্য তাঁর প্রচেষ্টা করা উচিত। এই লক্ষ্যে তিনি নিজেকে আরও গভীরভাবে পারমাণবিক প্রযুক্তি এবং নীতি সম্পর্কে শিক্ষিত করেছেন। তিনি পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের নেতা ফ্রাঙ্ক ভন হিপেল (Frank vol Hippel)-এর নেতৃত্বে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বারবার পরিদর্শন করে সাহায্য করেছিলেন।

ভারতে এবং বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নিবন্ধ রচনা, টেলিভিশনে উপস্থিতি এবং বক্তৃতার মাধ্যমে রাজারামন দক্ষিণ এশিয়ায় এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের পারমাণবিক সমস্যাগুলির সমাধান করার চেষ্টা করেছেন। পারমাণবিক অস্ত্র দুর্ঘটনা, নাগরিক প্রতিরক্ষা, ভারতের পারমাণবিক মতবাদ, ন্যূনতম প্রতিরোধ ও অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক-মিসাইল (anti-ballistic-missile) এবং আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা নিয়ে তিনি কাজ করেছেন।

রাজারামন ছিলেন বিজ্ঞান ও বিশ্ব বিষয়ক পাগওয়াশ সম্মেলনের (Pugwash Conference) কাউন্সিলার এবং পারমাণবিক অপসারণ ও নিরস্ত্রীকরণের জন্য এশিয়া প্যাসিফিক লিডারশিপ নেটওয়ার্কের ফিসাইল ম্যাটেরিয়ালস (Fissile Materials, বিচ্ছিন্ন পদার্থ) সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক প্যানেলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং অতীতের সহ-সভাপতি। বর্তমানে ছয় বছর ধরে পরমাণু বিজ্ঞানীদের বুলেটিনের নিরাপত্তা বোর্ডের সদস্যপদে আছেন বিজ্ঞানী রামামূর্তি রাজারামন।

ফুকুশিমা ট্র্যাজেডির আগে থেকেই তিনি ভারতের পারমাণবিক শক্তি কর্মসূচিতে নিরাপত্তা এবং স্বচ্ছতার বিষয়ে লিখে আসছেন। ভারতীয় জনসাধারণের মধ্যে পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে বিতর্কিত মতামত প্রশমিত করতে সাহায্য করার জন্য তিনি ভারতের পারমাণবিক শক্তি প্রোগ্রামের উপর একটি বই সংকলন এবং সম্পাদনা করেন যার অবদানকারীরা সরকারী পরমাণু শক্তি বিভাগের নেতা থেকে শুরু করে পরমাণু বিরোধী কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত। তিনি ২০১২ সালের পারমাণবিক নিরাপত্তা সূচক তৈরির জন্য নিউক্লিয়ার থ্রেট ইনিশিয়েটিভ (Nuclear Threat Initiative, NTI)-এর বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ছিলেন।

পারমাণবিক গবেষণায় তাঁর অসামান্য অবদান সত্ত্বেও, রাজারামন সম্ভবত তাঁর শিক্ষকতার জন্য আরও বেশি স্মরণীয় হয়ে আছেন। যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে অধ্যাপনা করেছেন, সেখানে তিনি পদার্থবিদ্যা, বিশেষ করে কোয়ান্টাম তত্ত্বের শিক্ষকতায় দক্ষতার জন্য পরিচিত। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা গবেষণায় নতুন অগ্রগতি ব্যাখ্যা করে ভারতে এবং বিদেশে গ্রীষ্মকালীন এবং শীতকালীন বিদ্যালয়গুলিতে তিনি যে অসংখ্যবার স্বল্পকালীন সময়ের জন্য শিক্ষকতা করেছেন তার জন্যও একই কথা বলা যায়।

গবেষণা এবং শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি অনেক বিজ্ঞানমূলক গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত একটি জনপ্রিয় বই হল ‘সলিটন্স অ্যাণ্ড ইন্সট্যান্টন্স : অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু সলিটন্স অ্যাণ্ড ইন্সট্যান্টন্স ইন কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি’ (Solitons and Instantons: An Introduction to Solitons and Instantons in Quantum Field Theory)।

পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন শাখায় মূল্যবান অবদানের জন্য অধ্যাপক রামামূর্তি রাজারামন অনেক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর কাজের ব্যস্ততা সত্ত্বেও দক্ষিণ আফ্রিকায় শান্তি এবং পারমাণবিক নিরাপত্তার প্রচারের চেষ্টার জন্য তিনি আমেরিকান ফিজিকাল সোসাইটি (American Physical Society) প্রদত্ত ‘লিও সিলার্ড লেকচারশিপ পুরস্কার’ (Leo Szilard Lectureship Award) পেয়েছেন। এছাড়াও পেয়েছেন ‘শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার’, ‘ডক্টর জি.পি.চ্যাটার্জী স্মৃতি পুরস্কার’, ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি প্রদত্ত এস.এন.বোস পদক। তিনি দুবার ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের কাউন্সিলের সদস্য এবং সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি। রাজারামন ইতালিতে অবস্থিত ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ সায়েন্টিস্ট’-এ ‘সন্ত্রাসী আইন প্রশমন’ (Mitigation of Terrorist Acts) বিভাগের স্থায়ী মনিটরিং প্যানেলের সদস্য ছিলেন। 

বর্তমানে ৮২ বছর বয়সেও অধ্যাপক রামামূর্তি রাজারামন পদার্থবিদ্যার নানা দিকে গবেষণা করে চলেছেন এবং তাঁর সঙ্গে চলছে তাঁর অধ্যাপনা ও বক্তৃতা দান।   

আপনার মতামত জানান