এস সুষমা বনাম পুলিশ কমিশনার মামলা

এস সুষমা বনাম পুলিশ কমিশনার মামলা 

ভারতবর্ষের মতো দেশে যৌনতা বিষয়ে স্বল্পশিক্ষা এবং ফলস্বরূপ ভ্রান্ত ধারণার নানারকম উদাহরণ ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যাবে। সমকামী সম্পর্ককে বোঝার এবং স্বাভাবিক জ্ঞানে মান্যতা দেওয়ার মতো মানুষের অভাব এ-দেশে বরবারই ছিল৷ বরং সেইসব সম্পর্কে থাকা মানুষেরা সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে বঞ্চনা, কুৎসা, কখনও বা হুমকিও পেয়ে এসেছেন। এমনই এক প্রেক্ষাপটে এস সুষমা বনাম পুলিশ কমিশনার মামলা (S. Sushma v. Commissioner of Police) কিছু ঐতিহাসিক সাংবিধানিক সিদ্ধান্তের জন্ম দিয়েছিল, যার গুরুত্ব সংবেদনশীল মানুষ মাত্রই অনুভব করতে পারবেন। দুজন সমকামী নারীর ভালোবাসার সম্পর্ক নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়ে যখন কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়, দীর্ঘ মোকদ্দমার পর আদালত তখন এই এলজিবিটিকিউআইএ+ সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য নানারকম সামাজিক অধিকারের রায় ঘোষণা করে তাদের সম্পর্ককে যথোপযুক্ত মর্যাদা প্রদান করে এবং বৈধ বলে মান্যতা দেয়। এছাড়া এই এস সুষমা বনাম পুলিশ কমিশনার মামলা -র রায়ে রূপান্তর থেরাপিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এই রায়ের ঐতিহাসিক এবং সর্বোপরি সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। 

এস. সুষমা এবং ইউ. সীমা আগরওয়াল নামে দুজন নারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করবেন একসঙ্গে। এরকম সাহসী সিদ্ধান্তকে অনুদার মানসিকতার জন্য স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের পরিবার মেনে নিতে পারেনি। ফলত দুজনকেই পারিবারিক নানা চাপের মুখে পড়তে হয়। তাঁদেরকে প্রাণপন আলাদা করবার চেষ্টা চলে দু-তরফ থেকেই। শেষপর্যন্ত বিচ্ছিন্নতার ভয়ে চেন্নাইয়ে নিজেদের বাড়ি থেকে তাঁরা পালিয়ে গিয়েছিলেন মাদুরাইতে। সেখানে বেশকিছু এনজিও এবং এলজিবিটিকিউআইএ+ সম্প্রদায়ের মানুষদের সহায়তায় তাঁরা সুরক্ষিত থাকেন এবং আবাসনের ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয় তাঁদের।

অন্যদিকে এই দুজনের বাবা-মা, পরিবারের লোকজন থানায় নিখোঁজ মেয়েদের জন্য অভিযোগ দায়ের করে। এই ডায়েরি নথিবদ্ধ হওয়ার পরে উক্ত আবাসনে এসে হানা দেয় পুলিশ এবং সুষমা ও তাঁর সঙ্গিনীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে৷ এই ঘটনায় তাঁরা ভয় পেয়ে যান এবং নিরাপত্তার অভাব বোধ করতে থাকেন। একরকম নিরাপত্তাহীনতা থেকেই সুষমা এবং সীমা সোজা হাইকোর্টে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। আদালতের কাছে তাঁরা পুলিশি হয়রানি বন্ধ করার এবং বাবা-মা পরিবার ও সামাজিক যে-কোনোরকম হুমকি আর বিপদ  থেকে সুরক্ষার জন্য পুলিশি নিরাপত্তার আবেদন জানিয়ে দরখাস্ত করেন। এভাবেই সুষমার ঐতিহাসিক মামলার সূত্রপাত ঘটে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

মাদ্রাজ হাইকোর্টের এস সুষমা বনাম পুলিশ কমিশনার মামলা – র প্রধান বিচারপতি ছিলেন আনন্দ ভেঙ্কটেশ। তিনি প্রথমত সুষমা ও তাঁর সঙ্গিনী এবং তাঁদের অভিভাবকদের মূলত বাবা-মাকে একজন মনোবিজ্ঞানী বিদ্যা দিনাকরণের কাছে কাউন্সিলিং-এর পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই কাউন্সিলিং-এর প্রথম পর্ব সমাপ্ত হলে ২০২১ সালের ২৮ এপ্রিল বিদ্যা একটি রিপোর্ট পেশ করেছিলেন। সেই প্রতিবেদনে মনোবিজ্ঞানী স্পষ্টতই উল্লেখ করেন, যে, সুষমা ও সীমা তাঁদের নিজেদের সম্পর্কটি নিয়ে বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত নয় বা কোনোরকম ধারণার অস্পষ্টতা এবং বিভ্রান্তি তাঁদের মধ্যে নেই। বরং তাঁরা সমাজের আর পাঁচজনের মতো শিক্ষা চালিয়ে যেতে চান, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চান। এমনকি তাঁরা যে পিতামাতা, পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে চান, সেকথাও স্পষ্ট করে উল্লেখ করা আছে বিদ্যার সেই প্রতিবেদনে। যদিও সুষমাদের এবিষয়েও আশঙ্কা ছিল যে, পরিবার তাঁদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার প্রয়াস করতে পারে। কিন্তু এই সম্পর্কের জন্য সমাজে যে-ধরনের কলঙ্কের বোঝা এবং যে দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির মুখোমুখি হতে পারে তাঁদের পরিবার সেবিষয়েও ভীষণরকমই সচেতন ছিলেন সুষমা ও সীমা। অন্যদিকে তাঁদের বাবা-মায়েদের মধ্যে উদ্বিগ্নতার মেঘ ঘনিয়ে উঠেছিল৷ তাঁরা চাইছিলেন মেয়েরা অনূঢ়া অবস্থায় ব্রহ্মচর্য পালন করেই জীবন কাটিয়ে দিক। বংশ কিংবা দত্তক ইত্যাদি বিষয়গুলি কিভাবে সম্পন্ন হতে পারে এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা নিয়েও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল বাবা-মায়ের মধ্যে। সেসময় আবেদনকারীদের আইন উপদেষ্টা কোর্টের কাছে আবেদন করেন, যেন এই ধরনের সমস্ত কেস নিয়েই আলোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়।

দুপক্ষের চিন্তা, মতামত খতিয়ে দেখে এবং ঘটনার সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলি বিশ্লেষণ করেই এই মামলার ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করা হয়েছিল। মামলার রায় ঘোষণার জন্য প্রথমে বিচারপতি নিজে একটি মানসিক-শিক্ষামূলক প্রক্রিয়ায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। এমন সংবেদনশীল একটি মামলার রায় কোনোরকম ব্যক্তিগত পক্ষপাতে দুষ্ট হওয়া যে নিতান্তই অনুচিত এবং গর্হিত, সেবিষয়ে সচেতন ছিলেন বলেই বিচারক এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। একে একরকম ব্যক্তিগত প্রস্তুতি বলা চলে। পাশাপাশি সততা এবং নিরপেক্ষ বিচারের প্রতি দায়বদ্ধতার এটি এক উৎকৃষ্ট উদাহরণও বটে।

ভারতবর্ষের মতো দেশে সমকামীদের জন্য সংস্কারমূলক আইন প্রণয়নের জন্য এই মামলার এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। নানাদিক খতিয়ে দেখে বিচারপতি আনন্দ ভেঙ্কটেশ নিশ্চিত হয়ে যান যে, কীভাবে সামাজিক প্রত্যাখান এবং নিষেধাজ্ঞার কারণে নানারকম নৃশংতার সম্মুখীন হতে হয় তাদের। ভেঙ্কটেশ অনুভব করেছিলেন এবিষয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা প্রয়োজন। এই মামলায় এলজিবিটিকিউআইএ+ সম্প্রদায়ের মানুষদের সাংবিধানিক অধিকারের প্রসঙ্গে উঠে এসেছিল ভারতীয় সংবিধানের ১৪, ১৫ এবং ২১ অনুচ্ছেদের কথা, যেখানে বৈষম্য বিরোধী আইন বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। অনুচ্ছেদ ১৪তে সকলের জন্য সমান অধিকারের যে কথা রয়েছে, অনুচ্ছেদ ১৫তে সেই সমতার নীতিটি আরও দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সর্বোপরি অনুচ্ছেদ ২১-এ জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার এবং গোপনীয়তা রক্ষা করার অধিকারের উল্লেখ রয়েছে। সুষমা মামলার ক্ষেত্রে এই অনুচ্ছেদগুলির বিশেষত এই ২১ অনুচ্ছেদটির বিশেষ ভূমিকা ছিল।

এলজিবিটিকিউআইএ+ মানুষদের জীবন ও মর্যাদার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিচারপতি এই অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গ তোলেন।
আদালত দীর্ঘ শুনানির ও বিচার বিশ্লেষণের পর বেশ কয়েকটি নির্দেশিকা দিয়েছিলেন। প্রথমত এই মামলার বিচার করতে গিয়ে আদালত রূপান্তর থেরাপির মতো প্রাণ হানিকর একটি পদ্ধতির ওপর সম্পূর্ণরূপে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এমনকি এই কাজের সঙ্গে জড়িত যেকোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার ছাড়পত্র দিয়েছিল আদালত। যদি কোনো এলজিবিটিকিউআইএ+ সম্প্রদায়ের মেয়ে বা পুরুষের নিঁখোজের অভিযোগ থানায় জমা পড়ে তবে তৎক্ষনাৎ কোনো  প্রশ্ন না করে সেই নিঁখোজ অভিযোগটিকে বন্ধ করতে হবে। মিনিস্ট্রি অব স্যোশাল জাস্টিস এন্ড এমপাওয়ারমেন্টকে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে তালিকাভুক্ত করার নির্দেশ দেয় আদালত, যাদের বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়ের সমস্যাগুলিকে মোকাবিলা করার দক্ষতা রয়েছে। ঠিকানা ও যোগাযোগের বিশদ বর্ণনাসহ সেই জাতীয় এনজিওগুলির তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার ঔচিত্য বিষয়েও আদালত গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিল। উক্ত সম্প্রদায়ের কোনো মানুষ যদি হয়রানি বা অন্য কোনো সমস্যার সম্মুখীন হন তবে তারা তাদের অধিকার এবং সুরক্ষার জন্য তালিকাভুক্ত এনজিওর কাছে গিয়ে অভিযোগ জানাতে পারেন। এই ধরনের সমস্যাগুলির প্রত্যেকটিকেই পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে কাউন্সিলিং, আর্থিক সহায়তা কিংবা জেলা আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষের সহায়তায় আইনি ব্যবস্থা ইত্যাদি সর্বোত্তম উপযুক্ত পদ্ধতির মাধ্যমে সমাধান করার কথা বলে আদালত। আদালত যে-কোনো গৃহহীন এলজিবিটিকিউআইএ-দের আশ্রয় দেবার জন্য অঙ্গনওয়াড়ি আশ্রয়কেন্দ্র বা গরিমা গৃহের মতো আবাসস্থলগুলির যথোপযুক্ত পরিবর্তন করার নির্দেশ দিয়েছিল। এহ সম্প্রদায়কে মূলধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য এবং তাদের বিরুদ্ধে জমা কুসংস্কারগুলির অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে বেশকিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলে আদালত। এলজিবিটিকিউআইএ+ সম্প্রদায় সম্পর্কে অভিভাবকদের সংবেদনশীল ও সচেতন করা এবং তাদের মধ্যে লিঙ্গ বিন্যাসের ধারণাগুলি স্পষ্ট করে তোলা তার মধ্যে অন্যতম। এমনকি স্কুল কলেজের পাঠ্যবইতে পরিবর্তন এনেও এবিষয়ক সচেতনতামূলক পাঠের অন্তর্ভুক্তিকরণের কথা বলেছেন আদালত। আরও বলা হয়েছে, যে, একজন ব্যক্তি সমকামী কিংবা ট্রান্সজেন্ডার যাই হোক না কেন, তার সঙ্গে চাকরির সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক বা প্রাসঙ্গিকতা নেই।

আদালত ২০২১ সালের ৭ জুন পুলিশ এবং কারা কর্তৃপক্ষকে এলজিবিটিকিউআইএ+ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হওয়া অপরাধের প্রতিরোধ এবং সুরক্ষার জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলির বিষয়ে নিয়মিত নানা কর্মসূচি পালন করার নির্দেশ দেয়। উক্ত সম্প্রদায়ের আইনী অধিকার সম্পর্কে সংবেদনশীলতা কর্মসূচি পরিচালনা করার জন্যও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয় আদালত। ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস অ্যাক্ট ২০১৯-এর অষ্টম অধ্যায় এবং ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস অ্যাক্ট ২০২০-এর ১১ সংখ্যক নিয়মানুযায়ী, নির্ধারিত অপরাধ এবং তদনুযায়ী শাস্তি সম্পর্কে পুলিশদের মধ্যে সচেতনতা এবং সংবেদনশীলতা তৈরি করার হুকুম দেয় আদালত। সেবছর ১ সেপ্টেম্বর ভারতের রাজ্য সরকারগুলিকে পুলিশ আচরণ বিধিতে একটি নির্দিষ্ট ধারা যুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। সেটি হল, এলজিবিটিকিউআইএ+ সম্প্রদায় বা কোনো এনজিওর ওপরে পুলিশি হয়রানিকে অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং এইরকম আচরণের সঙ্গে যুকৃত কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়া উচিত কর্তব্য।
শিক্ষাক্ষেত্রের জন্যেও বেশকিছু নির্দেশিকা জারি করে আদালত, যেমন, লিঙ্গ-নিরপেক্ষ শিক্ষার্থীর জন্য লিঙ্গ-নিরপেক্ষ বিশ্রামাগারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা, একাডেমিক রেকর্ডে রূপান্তরিত ব্যক্তির নাম ও লিঙ্গ পরিবর্তনের ব্যবস্থা, ভর্তি, প্রতিযোগিতামূলক কিংবা প্রবেশিকা পরিক্ষার আবেদনপত্রে লিঙ্গ নির্বাচনের স্থলে মেল, ফিমেলের পাশাপাশি ট্রান্সজেন্ডারের অন্তর্ভুক্তিকরণ ইত্যাদি। 

১০৭ পৃষ্ঠার এই রায় নিশ্চিতভাবেই ঐতিহাসিক। কিন্তু আইন যেমন থাকে তার কিছু ফাঁকও থেকে যায়৷ এই রায়ের ক্ষেত্রেও কোথাও কোথাও তেমনটা লক্ষ্য করা যাবে। এই রায়ে রূপান্তর থেরাপির সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেই কেবল শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এই কাজের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উল্লেখ সেখানে নেই। দ্বিতীয়ত, এলজিবিটিকিউআইএ+ মানুষেরা  সামাজিক বৈষম্যের সম্মুখীন হতে পারেন এমন সরকারী, বেসরকারি কর্মক্ষেত্র বা প্রতিষ্ঠানের কথাই বলা হয়েছে কেবল, কিন্তু পার্ক বা সমুদ্র সৈকতের মতো স্থানগুলির কথা নেই সেখানে।
এইসকল কিছু খামতির পরেও একথা বলতেই হয় ভারতবর্ষের মতো দেশে সুষমা মামলার রায় সত্যিই প্রয়োজনীয় এবং ঐতিহাসিক একটি পদক্ষেপ ছিল।

আপনার মতামত জানান