পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিধ্বংসী খালিস্তানি আন্দোলন দমনের কাজে সাফল্য অর্জন করে বিখ্যাত হন সর্দার বিয়ন্ত সিং। রক্তাক্ত পাঞ্জাবকে অখণ্ড ভারতের অংশ হিসেবে টিকিয়ে রাখতে তাঁর অবদান কিছু কম ছিল না। কিন্তু নৃশংস আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে বিয়ন্ত সিংকে মেরে ফেলে সন্ত্রাসবাদীরা। আজও সর্দার বিয়ন্ত সিং হত্যাকাণ্ড (Sardar Beant Singh Assasination) ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।
১৯২২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি লুধিয়ানার দোরাহার কাছে বিলাসপুর গ্রামে একটি জাঠ পরিবারে সর্দার বিয়ন্ত সিং-এর জন্ম হয়। লাহোরে সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ হওয়ার পরে প্রথমে তিনি ভারতের সেনাবাহিনীতে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন করেন এবং তারপর ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে তিনবার পাঞ্জাবের রাজ্য বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালে সন্ত্রাসবাদী হামলায় আক্রান্ত উত্তর-ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন সর্দার বিয়ন্ত সিং। সেই পরিস্থিতিতে মাত্র কয়েক সপ্তাহও মুখ্যমন্ত্রী পদে বহাল থাকা কঠিন ছিল। সেই সময়কার ভারতে সবথেকে সমৃদ্ধ রাজ্য হিসেবে স্বীকৃত পাঞ্জাবকে গ্রাস করেছিল সুদূরপ্রসারী বিশৃঙ্খলা এবং নৈরাজ্যের মেঘ। সুসজ্জিত শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা প্রায় ১২ বছর ধরে খালিস্তানের একটি স্বাধীন মাতৃভূমির জন্য লড়াই করছিল। এই খালিস্তানি আন্দোলনের কবলে প্রায় ১৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। শিখ সন্ত্রাসবাদীরাই কার্যত পাঞ্জাব শাসন করছিল সেই সময়। সমগ্র উত্তর ভারত জুড়েই শিখ জঙ্গিরা এলোপাথাড়িভাবে গণহত্যা চালাচ্ছিল। এর ফলে লক্ষ লক্ষ হিন্দু পাঞ্জাব ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সেই প্রথমবার সশস্ত্র গেরিলা যোদ্ধারা সম্পূর্ণভাবে পাঞ্জাব রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নেয় এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে খর্ব করে। খালিস্তানি আন্দোলনকারীরা তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকেও হত্যা করতে চেয়েছিল যার ফলস্বরূপ ১৯৮৪ সালে দুই শিখ দেহরক্ষীর হাতে ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ১৯৮৬ সালে তারা এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমান থেকে আইরিশ উপকূলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় যাতে প্রায় ৩৫০ জন লোক নিহত হয়।
১৯৯২ সালে সর্দার বিয়ন্ত সিং যখন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, সে সময় পাঞ্জাবে প্রত্যেকদিন গড়ে ২৫ জন করে মারা যাচ্ছে। সমগ্র রাজ্যটি পরিণত হয়েছিল একটি জঙ্গি শিবিরে। নিয়মিতভাবে ট্রেন লুট, যাত্রীদের হত্যার ঘটনা ঘটছিল। পাঞ্জাবের একজন প্রাক্তন সেনাপ্রধান সহ ক্রমান্বয়ে কয়েকজন রাজ্যপাল একত্রেও এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেননি। বহু ভারতীয় অনুমান করেছিল যে এবারে বোধহয় ভারতের সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হবে। কিন্তু মাত্র ১০ মাসের মধ্যেই বিয়ন্ত সিং-এর নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। সন্ত্রাসবাদীরা পালাতে শুরু করে, নিরাপত্তারক্ষীরা ধীরে ধীরে রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে থাকে। সন্ত্রাসবাদীদের হাত থেকে পাঞ্জাবকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সর্দার বিয়ন্ত সিং কঠোর হাতে দক্ষ পরিচালনার মাধ্যমে বেশ কিছু পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদী হামলা থেকে পাঞ্জাবকে মুক্ত করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেই সময় পাঞ্জাবের শিখ যুবকদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্কে একটি নায়কোচিত ধারণা গড়ে উঠেছিল, তা সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করেছিলেন বিয়ন্ত সিং। ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পরে শিখদের সম্পর্কে যে নিন্দনীয় মনোভাব গড়ে উঠেছিল দেশবাসীর মনে তাও পরিবর্তন করতে সাহায্য করেছিলেন তিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সন্ত্রাসবাদীদের গভীর চক্রান্তে বিয়ন্ত সিং মারা যান। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে সর্দার বিয়ন্ত সিং হত্যাকাণ্ড তাই এক বেদনাবহ অধ্যায়।
১৯৯৫ সালের ৩১ আগস্ট চণ্ডীগড়ের সেক্রেটারিয়েট কমপ্লেক্সে একটি আত্মঘাতী নৃশংস বোমা বিস্ফোরণে সর্দার বিয়ন্ত সিং মারা যান। তাঁর পাশাপাশি ঐ সময় আরো ১৭ জন নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু হয় যার মধ্যে ৩ জন ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীও ছিলেন। সেই দিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাঞ্জোধ সিং মান-এর সঙ্গেই অফিসে আসছিলেন তিনি। ঐ সময় বাব্বার খালসা ইন্টারন্যাশনাল দলের সদস্য দিলাওয়ার সিং বাব্বার নিজের পেটে বোমা বেঁধে বিস্ফোরণ ঘটান এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিয়ন্ত সিংয়ের মৃত্যু হয়। এই পরিকল্পনার আড়ালে ছিলেন বলবন্ত সিং রাজোয়ানা নামের এক ব্যক্তি। রাজোয়ানাই সর্দার বিয়ন্ত সিং হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত নৃশংস অধ্যায়ের মূল কাণ্ডারি ছিলেন বলে প্রমাণিত হয়। কে ছিলেন এই বলবন্ত সিং রাজোয়ানা? জানা যায় ১৯৮৭ সালে পাঞ্জাব পুলিশ বিভাগে একজন কনস্টেবল হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। বাব্বার খালসা ইন্টারন্যাশনাল দলের মতাদর্শের উপর সহমর্মী ছিলেন রাজোয়ানা এবং তিনি মনে করতেন যে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সর্দার বিয়ন্ত সিং নির্বিচারে সরকারি তকমায় শিখ যুবকদের হত্যা করেছেন। ১৯৯৬ সালের ২২ ও ২৩ জানুয়ারি সর্দার বিয়ন্ত সিং হত্যাকাণ্ড মামলা চলাকালীন ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩১৩ নং ধারা অনুসারে রাজোয়ানা তাঁর বয়ানে জানান যে, বহু শিখ পাঞ্জাবিকে হত্যা করার পর যখন পাঞ্জাব জুড়ে শান্তি নেমে আসে, আন্দোলন স্তব্ধ হয়; সেই সময় সর্দার বিয়ন্ত সিং নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে জাহির করছিলেন এবং তিনি নিজেকে গুরু গোবিন্দ সিং-এর সঙ্গেও তুলনা করতে শুরু করেন। এই কারণেই সর্দার বিয়ন্ত সিংকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। এমনকি রাজোয়ানার বয়ান থেকে ১৯৮৪ সালের অপারেশন ব্লু-স্টার তথা শিখ-বিরোধী দাঙ্গার ঘটনার সাপেক্ষে তাঁর তীব্র ক্ষোভের কথা জানা যায়। সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্য সর্দার বিয়ন্ত সিং যেভাবে পুলিশ ও প্রশাসনকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন তা নিয়েই রাজোয়ানা সহ অন্যান্য বিরোধীপক্ষের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। মামলা চলাকালীন রাজোয়ানা আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোনও উকিল নেননি, কারণ তিনি স্পষ্টই জানিয়েছিলেন যে বিয়ন্ত সিংকে হত্যা করে তিনি সামান্যতম অনুতপ্ত নন। ২০০৭ সালে আদালতে রাজোয়ানার মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হলে বহু শিখ নাগরিক এর বিরোধিতা করে যার ফলে ভারত সরকার তাঁর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ স্থগিত করে। ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি ব্যাংকক থেকে সর্দার বিয়ন্ত সিং হত্যাকাণ্ড মামলায় জড়িত আরেক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ যার নাম জগতার সিং। তাঁর বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের হয়। বুরেইল কারাগারে জগতার সিং এখনও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বন্দি।