উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদের ত্রিবেণী সঙ্গমে অবস্থিত সতীপীঠ প্রয়াগ একান্ন সতীপীঠের একটি অন্যতম পীঠ। এলাহাবাদের ত্রিবেণী সঙ্গম সাধারণভাবেই তীর্থযাত্রীদের কাছে একটি পবিত্র স্থান কারণ এই স্থান গঙ্গা, যমুনা এবং সরস্বতী নদীর মিলনস্থল। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে এখানে সতীর দশটি আঙুল পতিত হয়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী অলোপী মাতা তথা ললিতা এবং ভৈরব হলেন ভব। অনেকের মতে এখানে ভৈরব হলেন বেণীমাধব। প্রয়াগ সতীপীঠের পাশাপাশি এই শক্তিপীঠ দেবী অলোপী মন্দির হিসেবেও পরিচিত। প্রতি বছর নবরাত্রির সময় এই প্রয়াগ শক্তিপীঠে বহ্য পুণ্যার্থী ভক্তের সমাগম ঘটে।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজের বাপের বাড়িতেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছাতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব এই দেহ কাঁধে নিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেন। মহাদেবের তান্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখণ্ডগুলিই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। সেই রকম একটি পীঠ হলো প্রয়াগ সতীপীঠ। বলা হয় সতীর দুই হাতের মোট দশটি আঙুল ভূপতিত হয়ে জন্ম হয়েছে এই প্রয়াগ সতীপীঠের।
দেবীর অলোপী নামকরণ নিয়ে অনেকগুলি পৌরাণিক ধারণা প্রচলিত আছে যা থেকে এই সতীপীঠের উৎপত্তি বা গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সতী এখানে দেবী অলোপী নামে পূজিতা। ‘অলোপ’ কথার অর্থ হল লুপ্ত না হওয়া। সতীর দেহ যখন বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রের আঘাতে খণ্ড-বিখণ্ড হল, তখন সর্বশেষ এই প্রয়াগেই দেবীর দশ আঙুল ছিন্ন হয়ে ভূপতিত হয় এবং এর ফলে সতীর দেহ লুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু দেবীর অস্তিত্ব রক্ষিত ছিল ঐ দেহখণ্ডগুলির মধ্যে। তাই লুপ্ত হয়েও দেবীর নাম হয় অলোপী। আবার অনেক স্থানীয় মানুষ বিশ্বাস করেন যে বহু প্রাচীনকালে এই ত্রিবেণী সঙ্গম অঞ্চল ঘন বনে ঢাকা ছিল আর সেই সব ঘন জঙ্গলে থাকতো দুর্ধর্ষ সব ডাকাত। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যখনই কোনো বিবাহযাত্রীর দল যেতো, ডাকাতরা তাদের সর্বস্ব লুঠ করতো। একবার এরকমই এক বিবাহযাত্রীর দলকে আক্রমণ করে সকল পুরুষকে হত্যা করে যখন ডাকাতরা পালকির দিকে ছুটে যায়, সেখানে অবিশ্বাস্যভাবে তারা দেখে কোনো কনে উপস্থিত ছিল না। এই কনে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র এবং তা কালের বিবর্তনে কিংবদন্তীতে পরিণত হয়। পুরাণে রয়েছে যে, সত্যযুগে ভণ্ডাসুর প্রবল প্রতাপে শিবের বর পেয়ে দেবতাদের হেনস্থা করছিল এবং ইন্দ্রের স্ত্রী শচীদেবীকে পাওয়ার উদ্দেশ্যে অসংখ্য অসুর সেনা নিয়ে কৈলাশ আক্রমণ করেন। দেবতারা অসুরদের হত্যা করলেও ভন্ডাসুর মহামায়ার বলে প্রাণ ফিরে পান এবং তারপর আরো তীব্রভাবে আঘাত হানতে থাকেন। এই সময় ইন্দ্র এবং অন্যান্য দেবতারা যজ্ঞের মাধ্যমে মহাশক্তির জাগরণ ঘটান। তখনই যজ্ঞের আগুন থেকে রক্তবস্ত্র পরিহিতা চহুর্ভূজা দেবী ললিতার আবির্ভাব ঘটে। ভণ্ডাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করে ললিতা স্বর্গলোক পুনরায় অসুরমুক্ত করেন।
প্রয়াগ শক্তিপীঠে মূলত তিনটি মন্দির আছে – অক্ষয়বট, মীরাপুর এবং অলোপী। এই সতীপীঠ সপ্ত মোক্ষপুরের অন্যতম। এই মন্দিরের বিশেষত্ব হল এখানে কোনো দেবীমূর্তি নেই। তার বদলে এখানে একটি কাঠের পালকিকে দেবীরূপে পূজা করা হয়। তবে এর পাশে নবদুর্গার বিগ্রহ রয়েছে এবং দেবীর বেদীর নীচে একটি গহ্বরে জল রয়েছে। মনে করা হয় যে এই জল আসলে স্বয়ং মা গঙ্গার। অক্ষয়বটের নীচে দেব ভৈরবের মন্দির গড়ে উঠেছে এখানে।
প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকেন। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। প্রয়াগ সতীপীঠে দেবী হলেন ললিতা তথা অলোপী এবং ভৈরব হলেন ভব। মতান্তরে প্রয়াগ সতীপীঠের ভৈরব হলেন বেণীমাধব।
প্রয়াগ স্থানটি সাধারণভাবে কুম্ভমেলার জন্য বিখ্যাত হলেও প্রয়াগ সতীপীঠে নবরাত্রি উৎসব খুবই বিখ্যাত। এই দিনেই বহু জায়গা থেকে পুণ্যার্থী ও ভক্তকুল দেবী অলোপীর মন্দিরে সমবেত হয়। একইসঙ্গে ভৈরবের মন্দিরে বেণীমাধব তথা ভব-এর পুজোও হয় শিবরাত্রির সময়।