ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর মৃত্যু

শল্য

মহাভারতের সকল মহারথীদের মধ্যে অন্যতম বীর যোদ্ধা ছিলেন মদ্রদেশের অধিপতি মহারাজ শল্য । তাঁর বোন মাদ্রীর সঙ্গে হস্তিনাপুরের সম্রাট পান্ডুর বিয়ে হয়েছিল। তাই তিনি ছিলেন সম্পর্কে নকুল সহদেব তথা সকল পান্ডব ও কৌরবদের মামা।  মদ্ররাজ শল্যকে আমরা সর্বপ্রথম দেখতে পাই পাঞ্চালের রাজকন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায়। অন্য সব রাজা ও রাজপুত্রদের মতো তিনিও সেই সভায় আয়োজিত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং বাকি সবার মতোই হেরে গিয়েছিলেন। তারপর যখন ব্রাহ্মণবেশি অর্জুন লক্ষ্যভেদ করে রাজকন্যা দ্রৌপদীকে লাভ করলেন, তখন সব রাজা ও রাজপুত্ররা ভীষণ রেগে গেলেন। অর্জুনকে যুদ্ধে হারিয়ে তাঁর কাছ থেকে দ্রৌপদীকে কেড়ে নেওয়ার জন্য সবাই মিলে অর্জুনকে আক্রমণ করলেন। তখন কর্ণের সঙ্গে অর্জুনের এবং মদ্ররাজ শল্যের সঙ্গে ভীমের যুদ্ধ শুরু হল।   শল্য আর ভীম দুটি ক্ষ্যাপা হাতির মতো একে অপরকে লাথি ও ঘুষি মারতে লাগলেন। কিছুক্ষণ এইভাবে যুদ্ধ চলার পর ভীম শল্যকে দুই হাতে তুলে নিয়ে মাটিতে আছাড় মেরে ফেলে দিলেন। এক সামান্য ব্রাহ্মণের হাতে মহাবীর মদ্ররাজের এই দুর্দশা দেখে দর্শকরা হাসতে লাগলেন। অবশেষে ভীমকে কিছুতেই হারাতে না পেরে শল্য নিজের হার স্বীকার করে নিলেন।  

 মহারাজ শল্যকে আবার দেখা যায় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে উদ্যোগপর্বে। মদ্রদেশের এক অক্ষৌহিণী সৈন্য নিয়ে শল্য আসছিলেন পান্ডবপক্ষে যোগদান করার জন্য। কিন্তু দুর্যোধনের ইচ্ছা ছিল যে মদ্ররাজ যেন কৌরবপক্ষে যোগ দেন। তাহলে দুর্যোধনের সৈন্যসংখ্যা ও শক্তি দুটিই পান্ডবদের তুলনায় বৃদ্ধি পাবে। দুর্যোধনের এই ইচ্ছার কথা জানতে পেরে তাঁর মামা গান্ধাররাজ শকুনি তাঁকে একটি উপায়ের কথা বলে দেন।    

সেইমত দুর্যোধন শ্রেষ্ঠ কারিগরদের দিয়ে মদ্ররাজের আসার পথে একটি ভীষণ সুন্দর অতিথিশালা তৈরি করান। সেখানে দামি দামি আসবাবপত্র ও সুস্বাদু খাদ্য-পানীয়ের বন্দোবস্ত করেন। এরপর দুঃশাসনকে সঙ্গে নিয়ে নিজে দুর্যোধন অতিথিশালার দাসের ছদ্মবেশে তৈরি হয়ে থাকেন শল্যকে সেবা করার জন্য। 

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

কিছুক্ষণ পর মদ্ররাজ এসে হাজির হন সেই অতিথিশালায়। দুর্যোধন ও দুঃশাসন তাঁকে ও তাঁর অনুচরদের প্রাণ ঢেলে সেবা করেন। শল্য ভাবলেন মহারাজ যুধিষ্ঠিরই বুঝি তাঁকে আপ্যায়ন করার জন্য এইসব আয়োজন করেছেন। তাই সেই সেবায় খুশি হয়ে মদ্ররাজ তাঁর অনুচরদের আদেশ করেন, “এই অতিথিশালা যে তৈরি করেছে তাকে ডেকে নিয়ে এসো। আমি তাকে পুরস্কার দেব।”    তখন দুর্যোধন ও দুঃশাসন ছদ্মবেশে শল্যের সামনে উপস্থিত হলেন। শল্য তাঁদের কারিগর ভেবে পুরস্কার দিতে চাইলে দুর্যোধন তাঁকে বলেন, “আগে আপনি প্রতিজ্ঞা করুন যে আমরা যা চাইব আপনি আমাদের তাই দেবেন।” শল্য প্রতিজ্ঞা করলে দুর্যোধন নিজের পরিচয় দিয়ে তাঁকে সৈন্যসহ কৌরবপক্ষে যোগ দিতে অনুরোধ করেন। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মদ্ররাজ অন্য উপায় না দেখে দুর্যোধনের কথা মেনে নেন। 

এই কথা জানতে পেরে পান্ডবরা খুব দুঃখ পান। তাঁরা সবাই মিলে শল্যের সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং তাঁর এমন কাজের কারণ জানতে চান। শল্য তখন তাঁর সঙ্গে হওয়া ছলনার কথা বলেন এবং আরও জানান যে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তখন যুধিষ্ঠির বলেন, “মামা, আপনাকে আমাদের জন্য একটি কাজ করে দিতে হবে।” শল্য সম্মতি জানালে যুধিষ্ঠির বলেন, “যখন কর্ণের সঙ্গে অর্জুনের যুদ্ধ হবে, তখন আপনি কর্ণের সারথি হবেন এবং এমন কিছু কাজ করবেন যাতে কর্ণের মনোবল ভেঙে যায়”। শল্য বললেন, “আমি তোমার কথামত কাজ অবশ্যই করব। আমি দুর্যোধনের ছলনার জন্য তোমাদের পক্ষে যোগ দিতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু আমার আশীর্বাদ সবসময়ই তোমাদের সঙ্গে থাকবে। আমার বিশ্বাস যে এই যুদ্ধে তোমরাই বিজয়ী হবে।” 

শল্যকে প্রণাম করে পান্ডবরা সেখান থেকে চলে এলেন। তারপরে শুরু হল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। দুই পক্ষের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ আরম্ভ হল। একে একে পান্ডবদের হাতে পতন হল ভীষ্মের, মারা গেলেন আচার্য দ্রোণ। দ্রোণের মৃত্যুর পর সেনাপতি হলেন কর্ণ। যুদ্ধের সতেরোতম দিনে দুর্যোধন কর্ণকে অনুরোধ করলেন অর্জুনকে বধ করে তাঁর প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্য। কর্ণ তখন বললেন তাঁর একজন ভালো সারথির অভাব আছে। এই কথা শুনে দুর্যোধন মদ্ররাজ শল্যকে অনুরোধ করলেন কর্ণের সারথি হওয়ার জন্য। মহারাজ শল্য প্রথমে কপট রাগ দেখিয়ে শেষে সম্মতি দিলেন। শল্যকে সারথি করে কর্ণ যুদ্ধযাত্রা করলেন। যুধিষ্ঠিরকে দেওয়া কথা রাখার জন্য শল্য বারবার অর্জুন ও কৃষ্ণের ক্ষমতার সঙ্গে কর্ণের তুলনা করতে লাগলেন এবং কর্ণকে উপহাস করতে লাগলেন। ক্রমাগত এই কথা শুনতে শুনতে কর্ণের মনোবল টলে গেল। এই অবস্থাতেই কর্ণ অর্জুনের সম্মুখীন হলেন। প্রবল যুদ্ধের পর কর্ণকে বধ করলেন অর্জুন। কর্ণের মৃত্যুর পর কৌরবপক্ষের সেনাপতি হলেন শল্য। তিনি প্রথম থেকেই অসাধারণ বিক্রমের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। অর্জুন অন্যদিকে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় পান্ডবরা চারজন মিলেও শল্যকে আটকাতে পারলেন না। কিছুক্ষণ পরেই ভীমের নিষেধ অমান্য করে তাঁর সামনেই পান্ডবসৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে লাগল। নিজের সৈন্যদের ছত্রভঙ্গ অবস্থা দেখে যুধিষ্ঠির প্রতিজ্ঞা করলেন, “হয় আজ আমি শল্যকে বধ করব, অথবা নিজে শল্যের হাতে মৃত্যুবরণ করব।” তারপর ভীমকে সামনে, অর্জুনকে পিছনে এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকিকে দুইপাশে নিয়ে তিনি শল্যের সঙ্গে এমন ঘোর যুদ্ধ শুরু করলেন যে কৌরবদের আর আতঙ্কের সীমা রইল না।   

এরমধ্যে একবার শল্যের বাণে ভীষণ আহত হয়েও যুধিষ্ঠির তাঁকে অজ্ঞান করে দিলেন। কিন্তু শল্যের জ্ঞান হতেও বেশি সময় লাগলো না। তারপর যুধিষ্ঠির শল্যের কবচ কেটে দিলে শল্য যুধিষ্ঠির ও ভীম দুজনেরই কবচ ভেঙে দিলেন। তাঁর বাণে যুধিষ্ঠিরের ধনুক ও সারথির মাথা কাটা গেল। কৃপাচার্য যুধিষ্ঠিরের রথের ঘোড়াগুলিকে মেরে ফেললেন। এই দেখে ভীম ভীষণ রেগে গিয়ে শল্যের রথ, ঘোড়া ও ধনুক কেটে ফেললেন। শল্য তখন খড়্গ ও ঢাল হাতে যুধিষ্ঠিরের দিকে ছুটে চললেন।  ভীম নয়টি বাণ মেরে শল্যের খড়্গের মুষ্টি কেটে ফেললেন। তবুও শল্য সিংহের মতো যুধিষ্ঠিরের দিকে ছুটে আসছেন দেখে যুধিষ্ঠির স্বর্ণনির্মিত এক অতি ভীষণ করালবদন শক্তি শল্যের দিকে ছুঁড়ে মারলেন। শল্য সেই শক্তিকে লুফে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করা সত্ত্বেও তা শল্যের বুক ভেদ করে পাতালে প্রবেশ করল। যুদ্ধের আঠারোতম দিনে অর্থাৎ অন্তিম দিনে মৃত্যু হল মদ্ররাজ মহাবীর শল্যের।

তথ্যসূত্র


  1.  ‘মহাভারত’,কালীপ্রসন্ন সিংহ,  শল্যপর্ব, অধ্যায় ১৬-১৭, পৃষ্ঠা ৩১-৩৭
  2. ‘ছেলেদের মহাভারত', উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বসাক বুক স্টোর প্রাইভেট লিমিটেড, তৃতীয় মুদ্রণ, শল্যপর্ব, পৃষ্ঠা ৭৯-৮০, কর্ণপর্ব, পৃষ্ঠা ১৬৯-১৭০, উদ্যোগপর্ব, পৃষ্ঠা ১১৪-১১৬, আদিপর্ব, পৃষ্ঠা ৪৫-৪৭

আপনার মতামত জানান