বাংলা হাস্যরসাত্মক সাহিত্যের জগতে শিবরাম চক্রবর্তী (Shibram Chakrabarty) এক অবিস্মরণীয় নাম। শব্দের নানা কারিকুরিতে উৎকৃষ্ট ‘পান’ (Pun) সৃষ্টিই তাঁর রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাহিত্যসৃষ্টির পাশাপাশি তাঁর ব্যক্তিজীবনও এক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে সকলের কাছে। বেশিরভাগ সময় শিশুসাহিত্য রচনাতেই মনোনিবেশ করলেও বা তাঁর পরিচিতির অনেকটা জুড়ে শিশুসাহিত্যের তকমা থাকলেও বহু ‘সিরিয়াস’ লেখাও লিখেছেন তিনি। শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা বিখ্যাত ছোটোগল্প ‘দেবতার জন্ম’ এক কালজয়ী সৃষ্টি। এছাড়াও তাঁর উপন্যাস ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন বিখ্যাত পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা’ এবং ‘ভালোবাসা পৃথিবী ঈশ্বর’ নামে তাঁর দুই খণ্ডের আত্মজীবনী বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। ব্যক্তিজীবনে কখনো দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে স্বদেশি করতে গিয়ে জেল খাটা, আবার কখনো নেতাজি সুভাষচন্দ্রের সুপারিশে চাকরি পেয়েও বিশৃঙ্খল জীবনের জন্য সেই চাকরি হারানো। কখনো যুগান্তর পত্রিকার স্বত্ব কিনে ফেলা, কখনো আবার সিনেমা হলের সামনে কাগজ বিক্রি করা সব কাজই করেছেন শিবরাম।
১৯০৩ সালের ১২ ডিসেম্বর কলকাতার দর্জিপাড়ায় নয়নচাঁদ দত্ত লেনে শিবরাম চক্রবর্তীর জন্ম হয়। তবে তাঁর জন্মসাল নিয়ে শিবরাম নিজে নানাসময় নানা কথা বলেছেন, কখনো বলেছেন তিনি জসীমউদ্দিনের সমবয়সী, কখনো আবার তিনি নিজের বয়সকে কলকাতায় প্রথম ট্রাম চলার দিনের সঙ্গে তুলনা করতেন। তাঁর বাবা শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী ছিলেন মালদার চাঁচোল রাজবাড়ির সন্তান। তাঁর বাবাকে ছোটোবেলা থেকেই তিনি দেখেছেন সংসারবিমুখ, সম্পদের প্রতি লোভহীন থাকতে আর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রভাব তাঁর মধ্যেও পড়েছিল। তাঁর মা শিবরানিও সর্বদা আধ্যাত্মিক জগতে থাকতেন। শিবরাম ছাড়াও আরো দুই সন্তান ছিল শিবপ্রসাদ ও শিবরানির, তাঁদের নাম শিবসত্য ও শিবহরি। শিবরামের ছোটো ভাই শিবহরি মারা গিয়েছিলেন খুবই কম বয়সে। বাবা-মায়ের প্রভাবে সংসারের প্রতি মায়া বা আকর্ষণ শিবরামেরও কোনোদিন গড়ে ওঠেনি। খুবই অল্প বয়সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল শিবরাম আর কোনোবার পাহাড়ে, কোনোবার সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতো। কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেলেও তাঁর মায়ের স্থির বিশ্বাস ছিল মা দুর্গা স্বয়ং শিবরামকে রক্ষা করবেন।
এই ধরণের তথ্য লিখে আয় করতে চাইলে…
আপনার নিজের একটি তথ্যমূলক লেখা আপনার নাম ও যোগাযোগ নম্বরসহ আমাদের ইমেল করুন contact@sobbanglay.com এ
শিবরামের প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয়েছিল স্থানীয় রামনাথ পণ্ডিতের পাঠশালায় আর তারপরে চাঁচোলের সিদ্ধেশ্বরী ইন্সটিটিউশনে ভর্তি হন তিনি। তাঁর বাবার নিজস্ব গ্রন্থাগারে অঢেল বইপত্র পড়ে জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাতেন কিশোর শিবরাম চক্রবর্তী। স্কুলে পড়াকালীন স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন শিবরাম এবং সেই জন্য তাঁকে জেলও খাটতে হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন জীবনের লক্ষ্য বিষয়ে প্রবন্ধ লেখার সময় তিনি লিখেছিলেন দেশপ্রেমিক হতে চাওয়ার ইচ্ছের কথা লিখেছিলেন। চাঁচোলে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ অসহযোগ আন্দোলনের প্রচারে সভা করতে এলে তাঁর সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন শিবরাম দেশসেবা করার জন্য। দেশবন্ধুরই পরামর্শে মেসে থেকে স্কুলে ভর্তি হন তিনি। চিত্তরঞ্জন দাশের চাপেই কোনোক্রমে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করেন শিবরাম আর তারপর আবার পূর্ণমাত্রায় স্বদেশির কাজে নেমে পড়েন তিনি। তারপর আর প্রথাগত পড়াশোনা বেশিদূর এগোয়নি তাঁর। কিন্তু নিজের আগ্রহে ও উৎসাহে পড়েছেন নানা বিষয়, বিভিন্ন বিষয়ের অগাধ জ্ঞান ছিল তাঁর। স্বদেশিদের জেলে যেতে দেখে তাঁরও একবার খুব ইচ্ছে হয় জেলে যাবার, কিন্তু তাঁর চেহারা দেখে কোনো পুলিশেরই সন্দেহ হওয়ার জো ছিল না। কিন্তু একদিন ঠিক পুলিশের হাতে নিজে ধরা দিয়ে জেলে গেলেন আর সেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তাঁর ছোটোবেলার প্রেমিকা রিনির। কিছুদিনের মধ্যে আবার অন্য জেলে বদলি হয়ে যাওয়ায় সেই স্মৃতি বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
কৈশোর বয়স থেকেই লেখালিখির শুরু শিবরামের। প্রথমে কবি হিসেবেই তাঁর সাহিত্যজীবনের সূত্রপাত ঘটেছিল। ১৯২২ সাল নাগাদ ‘ভারতী’ পত্রিকার ফাল্গুন সংখ্যায় ‘কোকিল ডাকে’ নামে একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। চাঁচোল থেকে তারাপদ মৈত্র সম্পাদিত ‘মুরলী’ পত্রিকায় নিয়মিত কবিতা লিখতেন শিবরাম চক্রবর্তী। এছাড়াও কিছু কিছু প্যারোডি লিখেছিলেন তিনি। ‘রুদ্রমূর্তি ও মডারেটর স্ফূর্তি’ তাঁর অন্যতম একটি প্যারোডি কবিতা। ১৯২৩ সালে ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ‘উর্বশী’ কবিতার প্যারোডি লিখে প্রকাশ করায় দেড় মাসের জন্য কারাবাস করতে হয়েছিল তাঁকে। এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে যুগান্তর পত্রিকার স্বত্ব এই সময় ৫০০ টাকার বিনিময়ে তিনি কিনে নিয়েছিলেন এবং যখন তাঁর এই কবিতা প্রকাশ পায়, শিবরাম নিজেই ছিলেন এই পত্রিকার সম্পাদক। এছাড়াও বনফুল এবং শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কয়েকটি কবিতারও প্যারোডি করেছিলেন তিনি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কবিতা প্যারোডি করে জেলে যাওয়ার ঘটনা সত্যই বিরল।
১৯২৫ সালে তাঁর লেখা প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় ‘চুম্বন’ এবং এর পরের বছর আরো একটি কবিতার বই প্রকাশ পায় ‘মানুষ’ নামে। এই সময়েই ১৯২৯ সালে ‘আজ ও আগামীকাল’ নামে বিখ্যাত একটি প্রবন্ধ লিখেছেন শিবরাম, লিখবেন ‘চাকার নীচে’ নামে তাঁর সেই বিখ্যাত একাঙ্ক নাটক। সবশেষে ১৯৩০ সালে শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা ‘যখন তারা কথা বলবে’ নামে দ্বিতীয় আরেকটি একাঙ্ক নাটক প্রকাশ পাবে। ‘পৃথিবী বানানো’, ‘জন্মদিনের রিহার্সাল’, ‘জমাখরচ’, ‘কথাশিল্পী’ ইত্যাদি ছোটোদের উপযোগী বহু সরস কবিতাও লিখেছেন তিনি। নবপর্যায় ‘যুগান্তর’ এবং ‘আত্মশক্তি’ পত্রিকার সম্পাদনা করার সময়েই দুটি উপন্যাস লিখেছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী – ‘জমিদারের রথ’ এবং ‘ছেলে বয়সে’ (১৯২৫)। তাঁর লেখা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধগুলিও এই সময়েই লেখা যা পরে ‘মস্কো বনাম পণ্ডিচেরি’ বইতে সংকলিত হয়। ‘সাধারণ মানুষ ও সুপারম্যান’, ‘সঙ্ঘ মানেই সাঙ্ঘাতিক’, ‘বিজ্ঞানের সার্থকতা’, ‘সহজ হওয়া লেখক’, ‘হাসির গল্প হাসিল করা’, ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’ ইত্যাদি শিবরামের লেখা বিখ্যাত সব ‘সিরিয়াস প্রবন্ধ’। বলাই বাহুল্য শিবরাম চক্রবর্তীকে সাহিত্যমহলে যেভাবে প্রক্ষেপিত করা হয় তাতে তাঁর এই প্রবন্ধগুলির নিরিখে ভাবনার বদল করা জরুরি হয়ে পড়ে। ১৯৬০ সালে তাঁর আরেকটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশ পায় ‘ফানুস ফাটাই’ নামে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘দেনাপাওনা’র নাট্যরূপ দিয়েছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী ‘ষোড়শী’ নামে। কিন্তু ‘ভারতী’ পত্রিকায় সেই নাট্যরূপ প্রকাশ পেলে শিবরামের বদলে শরৎচন্দ্রের নাম ছাপা হয়। পত্রিকার সম্পাদক ভেবেছিলেন অচেনা শিবরামের বদলে শরৎচন্দ্রের নাম ছাপা হলে পত্রিকার বিক্রি বেশি হবে। এখানেই শেষ নয়, এই ‘ষোড়শী’কে ঘিরে এক অন্যায়-অবিচারের ঝড় চলে শিবরামের উপর দিয়ে। এই নাট্যরূপ তিনি শিশির কুমার ভাদুড়ীর হাতে দিয়ে আসেন এবং শিশির ভাদুড়ীর এই নাটক পছন্দ হওয়ায় নাট্যনিকেতন মঞ্চে তিনি এর অভিনয়ও করেন। কিন্তু নাট্যরূপদাতা হিসেবে শিবরাম যেদিন তাঁর প্রাপ্য টাকা নিতে আসেন, তার কিছু আগেই টিকিট বিক্রির সব টাকা শরৎচন্দ্র তুলে নিয়ে চলে যান। এই ঘটনায় অত্যন্ত ব্যথিত এবং অর্থকষ্টে ভোগা শিবরামকে শিশির কুমার ভাদুড়ী সেই দিন তাঁর নিজের সঞ্চিত মাত্র ১২০ টাকার একটি সেল্ফ চেক কেটে দেন। ইবসেনের নাটকের প্রভাব অনেকেই এই নাট্যরূপে লক্ষ করেছেন ঠিকই, কিন্তু এর পরে একেবারে মৌলিক দুটি নাটক লেখেন শিবরাম ‘চাকার নীচে’ এবং ‘যখন তারা কথা বলবে’।
১৯৩৭ সালে ‘রামধনু’ পত্রিকায় তাঁর লেখা ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশ পায়। এর কিছুদিন আগে ‘মৌচাক’ পত্রিকার সম্পাদক সুধীরচন্দ্র সরকার শিবরামের হাতে পনেরো টাকা দিয়ে ছোটোদের জন্য লিখতে বলেন এবং ‘পঞ্চাননের অশ্বমেধ’ নামে তাঁর প্রথম শিশু-কিশোর উপযোগী গল্প প্রকাশিত হয়। ‘মৌচাক’, ‘রামধনু’, ‘রংমশাল’ পত্রিকায় তখন নিয়মিত লেখা বেরোচ্ছে শিবরামের। তাঁর সৃষ্ট ‘হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধন’ এই দুই চরিত্র বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর লেখা বিখ্যাত গল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার’, ‘ঋণং কৃত্বা’, ‘চেঞ্জে গেলেন হর্ষবর্ধন’, ‘গোবর্ধনের প্রাপ্তিযোগ’, ‘হারাধনের দুঃখ’, ‘ঘোড়ার সঙ্গে ঘোরাঘুরি’, ‘হাতির সঙ্গে হাতাহাতি’, ‘ঢিল থেকে ঢোল’ ইত্যাদি।তাঁর উপন্যাস ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন বিখ্যাত পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা’ এবং ‘ভালোবাসা পৃথিবী ঈশ্বর’ নামে তাঁর দুই খণ্ডের আত্মজীবনী অত্যন্ত বিখ্যাত।
সমগ্র জীবনে মৌচাক পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার এবং প্রফুল্ল স্মৃতি পুরস্কার অর্জন করেছেন শিবরাম চক্রবর্তী।
১৯৮০ সালের ২৮ আগস্ট শিবরাম চক্রবর্তীর মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র
- https://en.wikipedia.org/
- https://shodhganga.inflibnet.ac.in/
- https://www.bongodorshon.com/
- https://www.anandabazar.com/
