সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud) ছিলেন একজন অস্ট্রীয় স্নায়ু চিকিৎসক এবং মনস্তত্ত্ববিদ যিনি মনোবিজ্ঞানকে প্রথম চিকিৎসা শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁকে ‘মনঃসমীক্ষণের জনক’ (Father of Psychoanalysis) বলা হয়।
অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের মোরাভিয়া প্রদেশের ফ্রেইবার্গ অঞ্চলে ১৮৫৬ সালের ৬ মে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের জন্ম হয়। তাঁর বাবা-মা ছিলেন ইহুদি, পশ্চিম ইউক্রেন এবং পোল্যান্ডের মধ্যবর্তী অঞ্চল গালিসিয়ার বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর বাবার নাম ছিল জেকব ফ্রয়েড এবং মায়ের নাম ছিল এমালিয়া নাথানশন। বাবা ছিলেন উলের ব্যবসায়ী। ফ্রয়েডের মা ছিলেন তাঁর বাবার তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী। ১৮৫৯ সালে জেকব ফ্রয়েড লিপজিগে চলে আসেন সেখান থেকে পরের বছর ভিয়েনায়। ফ্রয়েডের প্রাথমিক শিক্ষা ভিয়েনাতে শুরু হয়। তিনি পড়াশোনায় মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং জার্মান, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান ,স্প্যানিশ ,ইংলিশ, ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষার ওপর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। ১৮৭৩ সালে ফ্রয়েড স্পার্ল জিমনেসিয়াম থেকে স্নাতক হন। এইসময় জার্মান লেখক গোথের (Goethe) একটি লেখা তাঁকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে এবং তিনি চিকিৎসাকে তাঁর পেশা হিসেবে নিতে চান। এরপর তিনি ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় মনোবিদ্যার উপরে কাজ করতে শুরু করেন। ১৮৮১ সালে মার্চ মাসে তিনি এম.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৮২ সালে তিনি ভিয়েনার জেনারেল হসপিটালে ক্লিনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনি হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৮৮৫ সালে তিনি নিউরোপ্যাথলজির লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত হন। এই সময় তিনি ব্রেনের মেডুলার ওপর গবেষণা সম্পূর্ণ করেন।এর পরবর্তী সময়ে তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রে কোকেনের অবদান সম্পর্কিত গবেষণা শুরু করেন এবং দীর্ঘদিন তিনি এই বিষয়ের উপর গবেষণা করেছিলেন। তিনি বিয়ে করেছিলেন মার্থা বার্নেশকে।
১৮৮৬ সালে ফ্রয়েড তাঁর হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। ‘নার্ভাস ডিজঅর্ডার’ এর উপর তিনি বিশেষভাবে অনুশীলন করতে থাকেন। মনস্তত্ত্বের ওপর তাঁর বিভিন্ন বই প্রকাশিত হয়েছিল। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ভিয়েনার ১৯ নম্বর বের্গেসি(যেটি ছিল ফ্রয়েডের বাড়ি এবং ক্লিনিক)-তে রোগীরা আসত। ফ্রয়েডের চেষ্টায় মানসিক ব্যাধির চিকিৎসাতে মনঃসমীক্ষণের প্রয়োগ নতুনভাবে প্রচলিত হয়। শারীরিক চিকিৎসা জগতের পরিধির বাইরে মনোবিজ্ঞানের নতুন নতুন সূত্র চর্চায় তাঁর বহুমুখী আগ্রহ ও মনোযোগের পরিচয় পাওয়া যায়। সারা জীবন ধরে তিনি তাঁর সাইকো অ্যানালিটিক তত্ত্বকে নানানভাবে প্রকাশ করেছেন এবং এর নাম দিয়েছিলেন মেটাসাইকোলজি বা অধিবিদ্যা।
ফ্রয়েডের প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ইন্টারপ্রিটেশন অফ ড্রিমস'(১৯০০), ‘সাইকোপ্যাথলজি অফ এভরি ডে লাইফ'(১৯০১), ‘জোকস এন্ড দেয়ার রিলেশনস টু দি আনকন্সাস'(১৯০৫), ‘ফাইভ লেকচারস অন সাইকো অ্যানালিসিস'(১৯১০),’ দি ইগো এন্ড দি ইড'(১৯২৩) ইত্যাদি। ১৯৩৩ সালে নাৎসিদের নিষেধাজ্ঞায় ফ্রয়েডের যাবতীয় বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ফ্রয়েড তাঁর গবেষণায় দেখেছিলেন তীব্র আবেগ চেপে রাখার ফলে মানুষের মনে অসুখ জন্মায় এবং এর ফলে শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়। এছাড়াও হিস্টিরিয়ার ওপর ১৮৯৫ সালে একটি বই লেখেন ‘স্টাডি অন হিস্টিরিয়া’। এই বইটিকে প্রথম হিস্টিরিয়া রোগের একটি আকর গ্রন্থ বলা হয় ।এছাড়াও রয়েছে ‘দি অরিজিন অফ সাইকো অ্যানালিসিস’। তাঁর আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে স্বপ্নের প্রতীকী ব্যাখ্যা, যৌন মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ -ইত্যাদি বিষয়। স্বপ্ন নিয়ে তাঁর তত্ত্ব বলে মানুষের অবচেতন মনে অনেক কামনা-বাসনা অবদমিত অবস্থায় থাকে যার অনেক কিছুই স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
তিনি মানুষের মনের তিনটি স্তরের কথা বলেছেন- চেতন, অবচেতন ও অচেতন। অচেতনের দ্বিতীয় স্তর থেকে অবদমিত আবেগের জন্ম হয়। মানুষের হিংসা, ক্রোধ, বিরহ, নৈরাশ্য, অপূর্ণ কামনা-বাসনা ইত্যাদি নানান আবেগ অবদমিত আকারে অবচেতন মনে চাপা থাকে এবং প্রতীক আকারে তা একসময় চেতন মনে ফিরে আসে যা স্বপ্নের মাঝে ধরা পড়ে। এছাড়াও কয়েকটা সুদীর্ঘ গবেষণায় দেখা গেছে যে ,মানুষ তার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আদিম যৌন কামনা -বাসনার অধিকাংশের অবদমন ঘটিয়ে মানবসভ্যতাকে উন্নতির শিখরে নিয়ে গেছে। আর সেই অবদমিত কামনা বাসনা কখনও মানুষের স্বপ্নের আকারে কিংবা স্নায়ু রোগের উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয়। ফ্রয়েডের মতে, স্বপ্ন, ঠাট্টা-তামাশা, ভুলে যাওয়া প্রভৃতি কোনো মানসিক ঘটনাই আকস্মিক নয়, প্রতিটি ঘটনার পেছনে কোন না কোন কারণ রয়েছে। ফ্রয়েডের মতানুযায়ী, মনের চেতন অংশটি মনের একটা টুকরো অংশ মাত্র, বাকি সমস্তটাই অচেতন। তিনি তাঁর ‘লিবিডো’সংক্রান্ত আলোচনায় মনের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন। লিবিডোকে তিনি যৌনপ্রবৃত্তি মূলক সহজাত মানসিক শক্তি বলেছেন।যৌন অতৃপ্তি থেকেও ব্যক্তির আচরণে নানা অসঙ্গতি দেখা দিতে পারে। ফ্রয়েডের এই নতুন তত্ত্ব সাহিত্যিক – বুদ্ধিজীবী মহলে আলোড়ন ফেলেছিল। ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে বহু সাহিত্য রচনা ও চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। বর্তমান যুগেও এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। ১৯৩০ সালে ফ্রয়েড মনোবিদ্যার ওপর তাঁর অবদানের জন্য ‘গোথে(Goethe) পুরস্কার’ পান।
ফ্রয়েডের খ্যাতি সমগ্র বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্যক্তি ফ্রয়েড নিজের সামাজিক প্রতিপত্তি বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন । কিন্তু অবস্থা বদলাতে শুরু করে জার্মানিতে হিটলারের উত্থানের সাথে সাথে। শুরু হয় ইহুদিদের ওপর অকথ্য অত্যাচার। ভীত সন্ত্রস্ত চোয়ালের ক্যান্সারে আক্রান্ত অশীতিপর ফ্রয়েড বাধ্য হয়ে ভিয়েনা ছেড়ে ছেলে আর্নেস্ট জোন্সের সাহায্যে ইংল্যান্ড চলে যান। ৬ই জুন লন্ডনের ভিক্টোরিয়া স্টেশনে ভিড় করেছিলেন লন্ডনবাসীরা তাদের প্রিয় সিগমুন্ড ফ্রয়েডকে দেখার জন্য। ২০, ম্যারস্ফিল্ড গার্ডেন্সের আলো-হাওয়া পূর্ণ বাড়িতে কেটেছে ফ্রয়েডের জীবনের শেষ কয়েক বছর।
চব্বিশ বছর বয়স থেকেই তিনি তামাকজাত ধূমপান সেবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। সিগার ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। তিনি মনে করতেন, ধূমপান তাঁর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করত এবং এর মাধ্যমে তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণের চর্চা চালিয়ে যেতে সক্ষম হতেন। সহকর্মী উইলহেম ফ্লিয়েস তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে সতর্ক করা সত্ত্বেও তিনি ধুমপান শেষ পর্যন্ত ছাড়তে পারেননি। শেষ পর্যন্ত মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি। ১৯২৩ সালে মুখগহ্বরে লিউকোপ্লাকিয়া নামে একটি অল্প জমাট মাংসপিণ্ড দেখতে পান তিনি। পরে এটি কেটে বাদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি চিকিৎসকরা তাঁর এই রোগটিকে অনিয়ন্ত্রণযোগ্য বলে ঘোষণা করেন।
এরপরই তিনি তাঁর চিকিৎসক এবং বন্ধু ম্যাক্স স্কার ও মেয়ে আনা ফ্রয়েডের সঙ্গে পরামর্শ করে স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৩৯ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর যথেষ্ট পরিমাণে মরফিন গ্রহণ করে তাঁর মৃত্যু হয়।
উল্লেখিত তথ্যগুলো কতটুকু সত্য? রিফারেন্স হিসেবে কোন কোন বইগুলো অনুসরণ করেছেন?