সুন্তালেখোলা ভ্রমণ

সুন্তালেখোলা ভ্রমণ

ডুয়ার্সের মনোরম রহস্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে সুন্তালেখোলা (Suntalekhola) এক আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। সামসিং, সুন্তালেখোলা আর রকি আইল্যান্ড যেন একসূত্রে গ্রথিত। ডুয়ার্সে ঘুরতে এসে এই তিনটি জায়গা ঘুরতে আসেন না, এমন মানুষ নেই বললেই চলে। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত সুন্তালেখোলার নির্জন পার্বত্য প্রকৃতি মন ভুলিয়ে দেয়, নিয়ে যায় কোন এক স্বপ্নরাজ্যে। নিত্যদিনের কর্মব্যস্ত জীবনকে সরিয়ে রেখে কয়েকদিনের ছুটিতে ঘুরে আসাই যায় সুন্তালেখোলা।

কালিম্পং জেলার কালিম্পং সদর মহকুমার অন্তর্গত গরুবাথান সম্প্রদায় উন্নয়ন ব্লকের মধ্যেই রয়েছে এই সুন্তালেখোলা। সামসিং থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন হাজার ফুট উপরে অবস্থিত এই সুন্তালেখোলার কাছেই রয়েছে নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যান।

সবুজ চা বাগান, পাহাড় আর অরণ্য প্রকৃতির সমাবেশে গড়ে উঠেছে এই সুন্তালেখোলা আজও বহু পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। তার সঙ্গেই রয়েছে অপরূপ মায়াময় মূর্তি নদী। ছোট-বড় অজস্র নুড়ি-পাথরের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে এই মূর্তি নদী আর এর উপরে রয়েছে কাঠের পাটাতনে দেওয়া একটি ঝুলন্ত সেতু। সেতু পেরিয়ে রাস্তা চলে গিয়েছে জঙ্গলের মধ্যে আর সেই রাস্তা ধরে কিছুদূর এগোলেই দেখা মেলে বন বিভাগের মূল ফটক। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঘন জঙ্গল নেমে এসেছে সুন্তালেখোলায়। শান্ত, নির্জন অরণ্যে কেবলই ঝিঁঝির ডাক, পাখির কূজন আর মূর্তি নদীর অবিরাম কুলুকুলু ধ্বনিতে মন ভরে উঠতে বাধ্য। একদিকে নীল আকাশ, ঘন সবুজ বন আর অন্যদিকে গর্বোদ্ধত পাহাড়ের ঢাল, সব মিলিয়ে এক স্বপ্নরাজ্য। এখানেই এসে মিশেছে নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যানের ঘন জঙ্গলের দক্ষিণ-পূর্ব সীমানা। সুন্তালেখোলার ‘নেচার এডুকেশন অ্যান্ড ওয়াইল্ডারনেস রিসর্ট’ একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটনকেন্দ্র। নেপালি ভাষায় ‘সুন্তালে’ শব্দের অর্থ হল কমলালেবু আর ‘খোলা’ মানে নদী। মনে করা হয়, সুন্তালে নামের কোনও একটি নদীস্রোত একসময় এখান দিয়েই বয়ে যেত আর সেই থেকেই এই অঞ্চলের এরূপ নামকরণ করা হয়েছে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ট্রেনে করে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে খুব সহজেই গাড়ি ভাড়া করে সরাসরি সুন্তালেখোলা পৌঁছানো যায় কিংবা নিউ মাল জংশনে নেমেও একইভাবে গাড়ি করে এখানে আসা যায়। উভয়ক্ষেত্রেই গাড়িভাড়া বাবদ হাজার দুয়েক থেকে আড়াই হাজার টাকা মত খরচ হতে পারে। তাছাড়া বাসে আসতে হলে শিলিগুড়ি থেকে বাসে করে প্রথমে চালসা এবং তারপরে চালসা থেকে গাড়ি করে মাতল্লি-সামসিং হয়ে আনুমানিক ২০ কিমি. পথ পেরিয়ে সুন্তালেখোলা চলে আসা যায়। এই অঞ্চলের নিকটবর্তী বিমানবন্দর বাগডোগরা, বিমানে এলে সেখানে নেমে সরাসরি গাড়ি ভাড়া করে সুন্তালেখোলা পৌঁছে যাওয়া যায়। তবে এখানে মনে রাখতে হবে গাড়ি করে সুন্তালেখোলার চেকপোস্ট পর্যন্তই কেবল আসা যায়, তারপর ভিতরে প্রবেশের জন্য স্থানীয় গাড়ি ভাড়া করতে হয়। নেচার ক্যাম্প বা সুন্তালেখোলা রিসর্ট পর্যন্ত এই স্থানীয় গাড়ির ভাড়া আন্দাজ ২৫০ টাকা।

সুন্তালেখোলায় থাকার জন্য বেশ কিছু বাংলোর মত বাড়ি এবং স্থানীয় মানুষদের পরিচালনায় কিছু হোম-স্টে রয়েছে। সামসিং-এর কাছাকাছিও পশ্চিমবঙ্গের বন দপ্তরের অধীনে অনেকগুলি ছোট-খাটো কটেজ রয়েছে। সুন্তালেখলা বন উন্নয়ন নিগমের বাংলো কিংবা রিভার ক্যাম্পেও রাত্রিবাস করা যায়। তবে এখানে আসতে চাইলে আগে থেকে ঘর বুক করে নেওয়াই উচিত।

নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যানের একেবারে সংলগ্ন এই সুন্তালেখোলা নেচার রিসর্টের মূল আকর্ষণ পাখি দেখা। পাখিপ্রেমী পর্যটকদের হাত থেকে দূরবীন নামতেই চায় না এখানে এলে। পুকুর সারস, কালো ঈগল, লাল ছোপ বুলবুল, কাঠপায়রা, হাড়িচাচা, ড্রঙ্গো, সবুজ ম্যাগপাই ইত্যাদি নানা জাতের পাখি এখানে দেখা যায়। তাছাড়া সুন্তালেখোলা ফরেস্ট বাংলো থেকে নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যান পর্যন্ত পাহাড়ি পথে ট্রেক করেও যাওয়া যায়। রঙ-বেরঙের প্রজাপতি, পাখির কলতানে মেশানো এই মায়াবী শান্ত পরিবেশে না এলে অপূর্ণতা রয়ে যেতে বাধ্য। চা-বাগান আর ঘন জঙ্গলে প্রাণ ভরে বিশুদ্ধ অক্সিজেন নিতে নিতে ভুলেই যেতে হয় নাগরিক ব্যস্ততা, নাগরিক ক্লান্তি। মূর্তি নদী যেন সারাক্ষণ আপনার সঙ্গী হয়ে থাকবে এখানে। জঙ্গলের শোভা দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কাটিয়ে দেওয়া যায় সুন্তালেখোলায়। বিবাহিত দম্পতি অথবা প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে এখানকার লাভার্স পয়েন্ট এক অত্যাশ্চর্য আকর্ষণের জায়গা। বন আর নদীর ধারে সুন্তালেখোলা রিভার ক্যাম্পটিও অনাবিল আনন্দে ভরিয়ে দেবে আপনাকে। বন্ধুদের সঙ্গে এলে এখানে তাঁবুর ভিতরে কিছুক্ষণ কাটিয়ে বন্য পরিবেশ উপভোগ করতে পারেন সহজেই। তবে এখানে তাঁবুতে থাকতে হলে আগে থেকে বন দপ্তরের সাইটে গিয়ে নাম নথিভুক্ত করে তাঁবু বুকিং করতে হয়। রিভার ক্যাম্প থেকে নিউ মাল জংশনের দূরত্ব মাত্র ২০ কিমি.। সুন্তালেখোলার বিশেষ দ্রষ্টব্য এখানকার রিভার ক্যাম্প, নেচার রিসর্ট, মূর্তি নদী আর এছাড়া সাইটসিইং করতে চাইলে অনায়াসে চলে যাওয়া যায় নিকটবর্তী সামসিং কিংবা রকি আইল্যান্ড। তবে সমগ্র ডুয়ার্স ঘোরার পরিকল্পনা থাকলে শুধু সুন্তালেখোলা ভ্রমণের পরিবর্তে ঝালং, প্যারেন, গরুমারা, চাপড়ামারি, জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানও ঘুরে নিতে পারেন একইসঙ্গে। গভীর অরণ্যের মধ্যে একা একা বেশিদূর যাওয়া ঠিক হবে না। শীতকালে বা গরমকালে এলে মূর্তি নদীতে বেশি জল থাকে না, তবু না বুঝে শুনে নদীর মধ্যে বেশিদূর চলে যাওয়া ঠিক না। ট্রেকিং করার জন্য উপযুক্ত দক্ষ গাইড সঙ্গে রাখা জরুরি। বিকেল গড়ানোর আগেই জঙ্গল ঘুরে হোটেলে পৌঁছে যাওয়া দরকার। সবশেষে মনে রাখতে হবে জঙ্গল, পাহাড় কিংবা নদী কোনওভাবেই নোংরা করা উচিত নয়।  

বছরের যে কোনও সময়েই সুন্তালেখোলা চলে আসা যায়। তবে বর্ষাকালে সুন্তালেখোলার অরণ্য প্রকৃতি অপরূপ মোহময়ী হয়ে ওঠে আর শীতে গাছে গাছে কমলালেবু ভরে ওঠে। সবুজ অরণ্যের মাঝে এই কমলালেবুর গাছগুলি বহুবর্ণী প্রকৃতির রূপ আরও বাড়িয়ে তোলে। তবে বর্ষাকালটা সুন্তালেখোলা ভ্রমণের জন্য এড়িয়ে চলাই ভাল।

এই অঞ্চলের নুডলস আর মোমোর স্বাদ অতুলনীয় বলেই মানা হয়, তাই ঘুরতে এসে এই খাবার চেখে দেখতে ভুলবেন না।

নিকটবর্তী সামসিং-এর বাজারে কাঠের তৈরি সুদৃশ্য ঘর সাজানোর জিনিসপত্র পাওয়া যায় আর পাওয়া যায় স্থানীয় চা বাগানের টাটকা চা। কেউ চাইলে সঙ্গে করে চায়ের প্যাকেট কিনে নিয়ে আসতেই পারেন। সেই চায়ের চুমুকে বাড়িতে বসেই মনে পড়ে যাবে এখানের রঙিন স্মৃতি।

ট্রিপ টিপস

  • কীভাবে যাবেন –  ট্রেনে করে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে কিংবা নিউ মাল জংশনে নেমে খুব সহজেই গাড়ি ভাড়া করে সরাসরি সুন্তালেখোলা পৌঁছানো যায়। তাছাড়া বাসে আসতে হলে শিলিগুড়ি থেকে বাসে করে প্রথমে চালসা এবং তারপরে চালসা থেকে গাড়ি করে মাতল্লি-সামসিং হয়ে আনুমানিক ২০ কিমি. পথ পেরিয়ে সুন্তালেখোলা চলে আসা যায়। নিকটবর্তী বাগডোগরা বিমানবন্দর থেকে একইভাবে সুন্তালেখোলা আসার জন্য গাড়িভাড়া পাওয়া যায়।
  • কোথায় থাকবেন –  সুন্তালেখোলায় থাকার জন্য বেশ কিছু বাংলোর মত বাড়ি এবং স্থানীয় মানুষদের পরিচালনায় কিছু হোম-স্টে রয়েছে। সামসিং-এর কাছাকাছিও পশ্চিমবঙ্গের বন দপ্তরের অধীনে অনেকগুলি ছোট-খাটো কটেজ রয়েছে। সুন্তালেখলা বন উন্নয়ন নিগমের বাংলো কিংবা রিভার ক্যাম্পেও রাত্রিবাস করা যায়
  • কী দেখবেন – সুন্তালেখোলার অরণ্য প্রকৃতি, মূর্তি নদী, নেচার রিসর্ট কিংবা রিভার ক্যাম্প এখানকার বিশেষ দ্রষ্টব্য। তাছাড়া চাইলে নিকটবর্তী সাইটসিইং হিসেবে অনায়াসে ঘুরে আসা যায় নিকটবর্তী সামসিং কিংবা রকি আইল্যান্ড।
  • কখন যাবেন – বছরের যে কোনও সময় সুন্তালেখোলা আসা যায়। তবে বর্ষাকালটা এড়িয়ে চলাই ভাল।
  • সতর্কতা –
    • গভীর অরণ্যের মধ্যে একা একা বেশিদূর যাওয়া ঠিক হবে না।
    • শীতকালে বা গরমকালে এলে মূর্তি নদীতে বেশি জল থাকে না, তবু না বুঝে শুনে নদীর মধ্যে বেশিদূর চলে যাওয়া ঠিক না।
    • ট্রেকিং করার জন্য উপযুক্ত দক্ষ গাইড সঙ্গে রাখা জরুরি।
    • বিকেল গড়ানোর আগেই জঙ্গল ঘুরে হোটেলে পৌঁছে যাওয়া দরকার।
    • জঙ্গল, পাহাড় কিংবা নদী কোনওভাবেই নোংরা করা উচিত নয়।  
  • বিশেষ পরামর্শ –
    • পাখি দেখার ইচ্ছে থাকলে সুন্তালেখোলাতে অবশ্যই শীতকালে আসতে হবে। এই সময়েই প্রচুর প্রজাতির পরিযায়ী পাখিদের ভিড় লক্ষ্য করা যায় এখানকার জঙ্গলে।

আপনার মতামত জানান