শিলিগুড়ি

শিলিগুড়ি

পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ি জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গড়ে ওঠা একটি ইতিহাস বিজড়িত প্রাচীন জনপদ হল শিলিগুড়ি (Siliguri)। শিলিগুড়ি কে ‘উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার’ বলা হয়ে থাকে।

পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে ২৬.৭১° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.৪৩°পূর্ব দ্রাঘিমাংশে প্রায় ২৬০ বর্গকিমি স্থান জুড়ে অবস্থিত শিলিগুড়ি জনপদ। এর চারপাশে রয়েছে ঘন জঙ্গল। মহানন্দা নদী ঠিক এই জনপদের মাঝ বরাবর প্রবাহিত হয়েছে। সমুদ্রতল থেকে শিলিগুড়ির উচ্চতা প্রায় ৪০০ ফুট। এই জনপদের উত্তরে বাংলাদেশ এবং দক্ষিনে উত্তর দিনাজপুর জেলা ,পূর্বদিকে জলপাইগুড়ি ও কালিম্পং জেলা এবং পশ্চিমদিকে নেপাল অবস্থিত। জলপাইগুড়ি শহর থেকে শিলিগুড়ির দূরত্ব মাত্র ৩৫ কিলোমিটার।

যে কোনো জনপদেরই নামকরণের ইতিহাস বেশ রোমাঞ্চকর। শিলিগুড়ির নামকরণ নিয়েও একইরকম অনুভূতি কাজ করে। ‘ শিলিগুড়ি ’ নামের সাধারণ অর্থ হল ছোট ছোট নুড়ি-পাথরের ঢিবি। কিন্তু উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত এই জনপদ যখন সিকিমের অন্তর্ভুক্ত ছিল তখন এর নাম ছিল ‘শিলচাগুড়ি’। এর চারপাশে সেসময় ছিল গভীর ডোলকা অরণ্য। পরে সেই শিলচাগুড়ি থেকেই রূপান্তরিত হয়ে এই জনপদের নাম হয় শিলিগুড়ি ।

শিলিগুড়ির ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে দেখা যায় ১৯০৭ সালে ব্রিটিশরা কার্শিয়াং থেকে শিলিগুড়ি কে আলাদা করে একটি পৃথক মহকুমা হিসেবে গড়ে তোলে। আরো আগে এই অঞ্চল যখন সিকিমের অন্তর্গত ছিল, সেসময় কৃষিকাজ ভালো হত বলে এখানে বহু কিরাতি আর নেপালিরা এসে বসবাস শুরু করে। তখন মহানন্দা নদী বয়ে যেত শিলিগুড়ির দক্ষিণ দিক দিয়ে। ভুটানিরা আর সিকিমের অধিবাসীরা এই নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। ১৮১৫ সালে ব্রিটিশ আর নেপালের রাজার মধ্যে যে সগৌলির চুক্তি হয় তার ফলেই শিলিগুড়ির চেহারা বদলাতে শুরু করে। ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশরা দার্জিলিং অধিকার করার পরে দার্জিলিং যাওয়ার পথে এই মনোরম জনপদটিরও সংস্কার করেন তারা। ১৯০৩ সালে শিলিগুড়ি থানা তৈরি হওয়ার আগে থেকেই ব্রিটিশরা এই জনপদকে যোগ্য করে গড়ে তুলছিলেন যাতে দার্জিলিং পাহাড়ে যাবার পথে এই স্থানে বিনোদন বা অন্য কাজে বিশ্রাম নেওয়া যায়। ব্রিটিশদের আসার আগেই এখানে ১৮৭৮ সালে তৈরি হয়ে যায় শিলিগুড়ি রেলস্টেশন। এই রেলস্টেশন তৈরি হওয়ারও আগে ‘গ্যাঞ্জেস রোড’ ধরে দার্জিলিং পাহাড়ে যেতে হত, এটাই ছিল একমাত্র রাস্তা। এখন ১২৬ মাইল দীর্ঘ এই গ্যাঞ্জেস রোড ‘বর্ধমান রোড’ নামে পরিচিত। দার্জিলিং পাহাড়ে আসার জন্য বর্ধমানের মহারাজা এই রাস্তা নির্মাণ করিয়েছিলেন বলে এই নামকরণ হয়েছে। শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন থেকে মহানন্দা নদী পর্যন্ত যে রাস্তাটা এই গ্যাঞ্জেস রোডের সঙ্গে যুক্ত ছিল তাকে হিলকার্ট রোড বলা হতো। এই হিলকার্ট রোড বরাবর দার্জিলিংয়ে পৌঁছানো যায়। অনেকে বলেন এই হিলকার্ট রোডের কাছেই ছিল হাতিশালা। সেখানে বিশাল শালকাঠের খুঁটিতে তিনটি হাতি বাঁধা থাকতো। আর সেই হাতি দেখার জন্য এলাকার শিশু-কিশোরদের আগ্রহের অন্ত ছিল না। শিলিগুড়ির প্রবীণ নাগরিক সুশীল রাহার স্মৃতিচারণায় জানা যায় প্রায়দিনই হাতিশাল থেকে একটি হাতি বেরিয়ে মহানন্দা নদী অতিক্রম করে চলে যেত সুকনার জঙ্গলে। আরো জানা যায় শিলিগুড়ির রোড স্টেশন এলাকার একটি প্রাচীন কদম গাছের নীচে তখন ছিল গরুর গাড়ির চাকা ও অন্যান্য সরঞ্জাম তৈরির কারখানা। তখনো টয় ট্রেন চালু হয়নি, শিলিগুড়ি থেকে পাহাড়ে যাবার একমাত্র উপায় ছিল গাধা বা খচ্চরের পিঠে চড়ে যাওয়া। কাঁচা পাথুরে রাস্তায় মানুষজন খালি পায়েই হাঁটাচলা করতো। গরুর গাড়ি ছিল প্রধান যানবাহন। স্বাধীনতার আগে মিলনপল্লী, বাবুপাড়া, তিলক ময়দান, মহাবীরস্থান এইসব জায়গাগুলি গড়ে উঠেছিল। ফলে এই স্থানগুলিতে সেই প্রাচীনত্বের গন্ধ লেগে রয়েছে আজও।

রেলপথ বসানো হলে হিলকার্ট রোডের পাশ দিয়ে চলে গেল দার্জিলিং হিমালয়ান রেলের ন্যারোগেজ রেললাইন। এই রেলপথ ধরে সোজা চলে যাওয়া যেত কালিম্পং পর্যন্ত। কিন্তু সেই রেলপথ আজ নেই। হিলকার্ট রোড স্টেশনের নাম বদলে হয়েছে হাসমিচক। এই রেলপথের প্রসঙ্গেই বলতে হয় শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা প্রথম ব্রডগেজ রেলপথ স্থাপিত হয় ১৯২৬ সালে। অন্যদিকে মহানন্দা নদীর উপরে সেই সময় ছিল বাঁশের সাঁকো যা তৈরি হয়েছিল ১৮৭৮ সাল নাগাদ। পরে এই কাঠের পাটাতনের উপর লোহার ফ্রেম জুড়ে সেখান দিয়ে রেল চলাচলের রাস্তা তৈরি করা হয়। ১৯৩১ সালের আগে এখানে জনবসতি ছিল না বললেই হয়। কিন্তু জনগণনার সমীক্ষা অনুযায়ী ১৯৬১ সালের পর থেকে এখানে প্রবলভাবে জনসংখ্যা বাড়তে শুরু করে। বাংলা যখন পশ্চিমবঙ্গ আর পূর্ব পাকিস্তানে ভাগ হল সেসময় অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে এখানে তৈরি হয়েছিল ‘শিলিগুড়ি-করিডোর’ যা পরে সিকিমের সঙ্গে ভারতের সংযোগসূত্র গড়ে তোলে।

জনপ্রিয় ভ্রমণকাহিনি লেখক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য্যের বাড়ি শিলিগুড়ির কাছেই। আঞ্চলিক ইতিহাস বিশেষজ্ঞ সুশীল রাহাও এই শিলিগুড়িতেই জন্মেছেন। স্থানীয়দের কাছে তিনি বেণু রাহা নামেই সমধিক পরিচিত। একসময় এখানকার বিখ্যাত ফটোগ্রাফার ছিলেন শান্তি সিংহ। তাঁর ‘সিনহা স্টুডিও’-র পরিচিতি সেই সময়ই তুঙ্গে ছিল। আনন্দবাজার পত্রিকায় সেসময় সাদা-কালো ছবি ওয়াশ করে ছাপার জন্য পাঠাতেন এলাকার আরেক ফোটোগ্রাফার হরেন দত্ত, আদতে শান্তি সিংহের সহকারী ছিলেন তিনি। তবে এই তালিকায় আরো নাম যোগ করা যায়। শুনলে আশ্চর্য হতে হয় ২০১২ সালের গ্রীষ্ম-অলিম্পিকের মহিলা একক টেবিল টেনিস খেলায় প্রতিনিধিত্বকারী অঙ্কিতা দাস কিংবা ঐ বছরই লণ্ডন অলিম্পিকে জাতীয় চ্যাম্পিয়নের খেতাব পাওয়া কিশোর সৌম্যজিৎ ঘোষ এই জনপদেরই বাসিন্দা। ইতিহাসের নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রধান নেতা কমরেড চারু মজুমদারের জন্ম এই শিলিগুড়ি শহরে। একদা সরু তারের উপর দিয়ে সবথেকে বেশি দূরত্ব হেঁটে আর চুলের সাহায্যে ৪০ টনের টয় ট্রেন টেনে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম তুলেছিলেন এখানকার মানুষ শৈলেন্দ্রনাথ রায়।

উত্তরবঙ্গের শিক্ষার চর্চা বরাবরই বেশ উন্নত। শিলিগুড়িতেও প্রচুর বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বেশিরভাগই ইংরেজি-মাধ্যম বিদ্যালয় যাদের মধ্যে ডন বসকো শিলিগুড়ি, দিল্লি পাবলিক স্কুল, শিলিগুড়ি বরদাকান্ত বিদ্যাপীঠ ইত্যাদি অত্যন্ত উচ্চ মানের প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া সেনাবাহিনীতে কর্মরত সেনাদের ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার জন্য রয়েছে আর্মি পাবলিক স্কুল আর সেবক রোডের কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়। স্থানীয় একমাত্র বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় হল শিলিগুড়ি বয়েজ হাই স্কুল যার ইতিহাস অতি প্রাচীন। সুদূর ১৯১৮ সালে এই বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। উচ্চশিক্ষার জন্য এখানে রয়েছে শিলিগুড়ি কলেজ, নর্থ বেঙ্গল সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কালিপদ ঘোষ তরাই মহাবিদ্যালয়, শিলিগুড়ি মহিলা মহাবিদ্যালয় ইত্যাদি কলেজ। এদের মধ্যে শিলিগুড়ি কলেজই সবার প্রথম ১৯৫০ সালে স্থাপিত হয়। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। নর্থ বেঙ্গল ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল এখানকার দুটি বিখ্যাত চিকিৎসা-প্রতিষ্ঠান যেখানে ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছা নিয়ে বহু স্থানীয় ও অন্য জেলার ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তি হয়। শিলিগুড়ি গভর্নমেন্ট পলিটেকনিক কলেজ, শিলিগুড়ি ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি আর সুরেন্দ্র ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাণ্ড ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রযুক্তিবিদ্যার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় এখানেই অবস্থিত।

টি(Tea)-টিম্বার(Timber)আর ট্যুরিজম(Tourism) এই ত্রয়ী ‘T’ নিয়েই শিলিগুড়ির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বলা যায়। এর বাইরে শিলিগুড়ির লোকজীবনের দুর্গাপুজো, গণেশ পুজো, দীপাবলী তো রয়েইছে। স্থানীয় নেপালি-গোর্খাদের তিহার, দেশাই কার্শিয়াং-এর মতো এখানেও খুব ধুমধাম করে পালিত হয়। লোকনৃত্য এখানকার বিশেষ আকর্ষণ। শিলিগুড়িতে বেশ কিছু নজরকাড়া স্থান রয়েছে। তার মধ্যে কিছু কিছু আবার প্রাচীন ইতিহাস বিজড়িত। ইউনেস্কোর নির্বাচিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে এখানকার দার্জিলিং-হিমালয়ান রেলওয়ের টয়ট্রেনে চড়ে বাতাসিয়া লুপের গন্ধ মেখে দার্জিলিং যাওয়ার অভিজ্ঞতা সচরাচর কেউই ভুলতে পারেন না। রয়েছে তিস্তা নদীর উপরে ১৯৩০ সালে নির্মিত বিখ্যাত সেবক ব্রিজ। এখন যার নাম করোনেশন ব্রিজ যা দার্জিলিং আর কালিম্পংকে সংযুক্ত করেছে। জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদারের বহু লেখায় এই সেবক ব্রিজের কথা উঠে এসেছে। শিলিগুড়ির কাছেই গাজোলডোবা ভিউ পয়েন্টে বহু পরিযায়ী পাখির আনাগোনা রয়েছে আর সবশেষে মহানন্দা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির কথা না বললে অন্যায় হয়।

সব মিলিয়ে শীতের কুয়াশামাখা এই শৈলশহর স্বপ্নপরীর মতো মোহিনী মায়ায় বারবারই মন ভোলায় পর্যটকদের।পাহাড়ের গায়ে গায়ে যেন অন্য জীবনের স্বাদ-গন্ধ লেগে থাকে।

One comment

আপনার মতামত জানান