প্রতিবিম্ব পাশাপাশি উল্টে যায় কিন্তু উপর নিচে উল্টায় না কেন

প্রতিবিম্ব পাশাপাশি উল্টে যায় কিন্তু উপর নিচে উল্টায় না কেন

আজকের আলোচনা একটি অনুসন্ধিৎসু মনের জানতে চাওয়াকে নিয়ে। মাষ্টারমশাই ভুল করে বলেছেন সমতল দর্পণে উল্টানো প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। তাতে প্রথমে ছাত্রের ধারণা হয় প্রতিবিম্বের মাথা নিচে, পা ওপরের দিকে চলে যায়। ব্যাপারটার সাথে অবশ্যই সে বাস্তবের মিল খুঁজে পায় না । পরে জানতে পারে এই উল্টানো হলো পাশাপাশি উল্টানো। অর্থাৎ বস্তুর ডান দিক বাম দিকের মত মনে হয় আর বাম দিক ডান দিকের মত। কিন্ত কৌতূহলী মনে প্রশ্ন থেকেই যায়, ওল্টাবে যদি তবে কেন পাশাপাশি ওল্টাবে? মাথা নিচে পা ওপরে হবে না কেন? আয়নায় দেখতে গিয়ে সবাই লক্ষ করেছি বিষয়টা। সবাই কমবেশি এর কারণ জানি অথবা ব্যাপারটা ছোটবেলায় পড়েছি। বেশিরভাগই শুধু “পার্শ্বীয় প্রতিফলন” (lateral inversion), “অসদ বিম্ব (virtual image)” এগুলো জেনে খিদে মিটিয়েছি । আমাদের আজকের বিষয় এই পুঁথিগত জানার বাইরে । সমতল দর্পনে বস্তুর প্রতিবিম্ব পাশাপাশি উল্টে যায় কিন্তু উপর নিচে উল্টায় না কেন উল্লম্ব প্রতিফলন বা vertical inversion হয় না কেন?

প্রতিবিম্ব পাশাপাশি উল্টে যায় ১
চিত্র – ১

প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার সমতল দর্পণে তৈরি হওয়া বস্তুর প্রতিবিম্ব কখনোই পাশাপাশি উল্টায় না। অর্থাৎ প্রতিবিম্ব (পাশাপাশি) উল্টে যাওয়ার ধারণাটিই ভুল। আমরা পার্শ্বিয় প্রতিফলন বলি বটে কিন্তু সমতল দর্পণ বা আয়নায় যে প্রতিবিম্ব আমাদের চোখে পড়ে সেটি হল সামনে পেছনে উল্টে যাওয়া প্রতিবিম্ব। বিষয়টা একটু সহজ করে বলা যাক। চিত্র -১ -এ একটি রঙিন ব্লক দেখা যাচ্ছে, আয়নাতে যার প্রতিবিম্ব তৈরি হয়েছে। আয়নার প্রতিফলক তলে আগত আলোক রশ্মিগুলি তীর চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়েছে। ব্লকটির সম্মুখ ভাগে লাল রং এবং পিছনের দিকে হলুদ রং করা হয়েছে । ব্লকটির ডান দিকে সবুজ এবং বাম দিকে নীল রং করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে আয়নায় প্রতিবিম্বের হলুদ অংশটি এবং লাল অংশটির স্থান পরিবর্তন হয়েছে। সবুজ ও নীল অংশটি অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। ছবিটি সমতল দর্পণ বা আয়নার সম্মুখ প্রতিফলনের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যদি আয়নার ছবিটির পার্শ্বীয় প্রতিফলন হত বা প্রকৃত অর্থে ডান দিক বাম দিকে পরিবর্তিত হত তবে নীল ও সবুজ অংশের স্থান পরিবর্তন হত। কিন্ত সম্মুখ পরিবর্তন হওয়ার ফলে বাক্সের হলুদ ও লাল অংশেরই পরিবর্তন হয়েছে।

প্রতিবিম্ব পাশাপাশি উল্টে যায়
চিত্র – ২

আরেকটি উদাহরণ নেওয়া যাক। একটি আয়নার সামনে গিয়ে আপনি যদি আপনার বাম হাতটি তোলেন তবে প্রতিবিম্বটি তার ডান হাতটি উপরে করবে এবং আপনি যদি ডান হাত তোলেন তবে প্রতিবিম্বের বাম হাতটি উঠবে। কিন্ত যদি আপনি ডান হাত তুলে সেই হাতের একটা আঙ্গুল দিয়ে ডান দিকটা নির্দেশ করেন আপনার প্রতিবিম্ব তখন একই দিক নির্দেশ করবে এবং উল্টো দিক নির্দেশ করবে না (চিত্র -২ দ্রষ্টব্য)। যেকোনো বস্তুর বাম দিক বা ডান দিক সঠিক ভাবে নির্ণয় করতে গেলে তার সামনের দিক এবং পিছন দিকের ব্যাপারে ধারণা থাকা প্রয়োজন। আয়না বা যেকোনো সমতল দর্পণের বৈশিষ্ট্য হলো এটি সামনের দিককে পিছনের দিকে ঘুরিয়ে দেয় ফলে বস্তুর ডান দিক বাম দিকে ঘুরে যায়। অর্থাৎ যেই প্রতিবিম্ব টা তৈরি হয় সেটি মোটেও পাশাপাশি উল্টে যাওয়া বা পার্শ্বিয় প্রতিফলনের জন্যে নয় এটি সম্মুখ প্রতিফলনের জন্যে। এই কারণেই আপনার মুখোমুখি দাড়িয়ে থাকা আপনার প্রতিবিম্বের ডান দিকটা হয় আপনার বাম দিকে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

প্রতিবিম্ব পাশাপাশি উল্টে যায় - ৩
চিত্র – ৩

পড়ার বইতে পার্শ্বীয় প্রতিফলন পড়তে গিয়ে আমরা “AMBULANCE” লেখাটির উদাহরণ প্রচুর পেয়েছি। অ্যাম্বুলেন্স গাড়ির সামনে লেখাটি উল্টো করে লেখা থাকে যাতে সামনের কোনো গাড়ির চালক তার পাশের আয়নায় সঠিক লেখাটি দেখতে পায়। এবার ভাবুন যদি গাড়ির উইন্ডশিল্ড গ্লাসের সামনে এই উল্টো লেখাটি রাখা হয়, পেছনে বসা অ্যাম্বুলেন্স চালক লেখাটিকে কেমন দেখবেন? লেখাটি চালকের কাছে সোজা হয়েই ধরা দেবে। কিন্ত চালক যদি উইন্ড শিল্ডের সামনের দিকে চলে আসেন তবে তাঁর কাছে লেখাটি সম্পূর্ণ উল্টো লাগবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে দর্শকের (অ্যাম্বুলেন্স চালক) স্থান পরিবর্তন করতে হচ্ছে বা সামনের গাড়ির চালকের ক্ষেত্রে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে হচ্ছে। চিত্র – ৩ এ দেখতে পারেন READ লেখাটির সোজা দিকটি আপনার দিকে এবং উল্টানো দিকটি আয়নার দিকে মুখ করে রাখা। আয়নায় উল্টানো লেখাটির প্রতিবিম্ব সোজা ভাবে দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ আয়নায় বস্তুর পিছনের দিকটি উল্টে গিয়ে সম্মুখ ভাগটি দেখা যাচ্ছে। এর থেকেপরিষ্কার বোঝা যায় যে আয়নায় প্রতিবিম্ব সামনে পিছনে উল্টে যায় এবং প্রতিবিম্ব পাশাপাশি উল্টে যায় না।

প্রতিবিম্ব পাশাপাশি উল্টে যায়
চিত্র – ৪

খানিকটা এরকমই জিনিস আমরা দেখি জীবন বিজ্ঞানের বইতেও। হৃৎপিন্ডের ছবি দেখে অনেকের মনেই প্রশ্ন এসেছে বাম অলিন্দ ডান দিকে আঁকা কেন আর ডান অলিন্দ বামে আঁকা কেনো। আমাদের শিক্ষকরা তখন বইএর মলাটের দিকটা বুকের কাছে ধরে ছবিটার অভিমুখ উল্টে বুঝিয়েছেন যে বইটা উল্টে ধরলে (চিত্র – ৪ দ্রষ্টব্য) ছবিটা ঠিকই মনে হবে। আমরা সাধারণত আমাদের অবস্থানের সাপেক্ষে যেকোনো জিনিসকে সামনে বা পিছনে ঘুরিয়ে নিতে পারি তাই এই ব্যাপারটা বিশেষ লক্ষ করা যায় না। আয়নার ক্ষেত্রেও এই একই ব্যাপার ঘটে কিন্ত এক্ষেত্রে আমরা আমাদের সাপেক্ষে বস্তুর অভিমুখ পরিবর্তন করতে পারি না তাই মনে হয় সবকিছুই পাশাপাশি উল্টে গেছে। কিন্ত বাস্তবে সামনের এবং পিছনের অভিমুখের পরিবর্তন হয়।

প্রতিবিম্ব পাশাপাশি উল্টে যায়
চিত্র – ৫

এবার মূল যে প্রশ্নটি সেটায় আসা যাক। আয়নায় উল্টাবেই যদি তবে সামনে-পিছনে কেন উল্টাবে, ওপরে নিচে কেন নয়? এর উত্তর পেতে গেলে আমাদের একধরনের গোলীয় দর্পণ, অবতল দর্পণ নিয়ে আলোচনা করতে হবে। আমরা রোজ যে চামচ ব্যবহার করি তার সামনের দিকটি একটি অবতল দর্পণের উদাহরণ (চিত্র – ৫ দ্রষ্টব্য)। এই দর্পণে গঠিত প্রতিবিম্ব সাধারণত বস্তুর অবস্থান ভেদে বিভিন্ন হয় এবং মূলত উপর নিচে উল্টে যায় । ওপর নিচে উল্টে যাওয়া এই ধরনের প্রতিবিম্বকে বলে সদ্ বিম্ব। কিন্ত বস্তুকে যদি দর্পণের মুখ্য ফোকাস ও মেরুর (pole) মাঝে নিয়ে আসা হয় তবে প্রতিবিম্ব সোজা এবং অসদ্ হয় । এই একটি ক্ষেত্রেই অবতল দর্পণ অসদ বিম্ব তৈরি করে (চিত্র – ৬ দ্রষ্টব্য)। Plane mirror বা সমতল দর্পণের ফোকাস দূরত্ব অসীমে হয়। অর্থাৎ সমতল দর্পণকে যদি একটি অবতল দর্পণ হিসেবে দেখা হয় তবে বলা যেতে পারে দর্পণের সাপেক্ষে বস্তুর অবস্থান যাই হোক না কেন তা মুখ্য ফোকাস বিন্দু ও মেরুর মাঝেই হবে ও সর্বদা প্রতিবিম্বের ওপর নিচ সমতল দর্পণে সোজাই দেখা যাবে। 

প্রতিবিম্ব পাশাপাশি উল্টে যায় - ৬
চিত্র – ৬

এই আলোচনা থেকে আশা করি সহজেই বোঝা গেল যে “সাধারণ আয়নায় প্রতিবিম্ব পাশাপাশি উল্টে যায়” – এই ধারণা ভুল এবং শুধুমাত্র বিশেষ ক্ষেত্রে (অবতল দর্পণ) প্রতিবিম্ব উপর নিচে উল্টায়।

আপনার মতামত জানান