ঘাম কী এবং আমাদের ঘাম হয় কেন

ঘাম কী এবং আমাদের ঘাম হয় কেন

কাজের প্রয়োজনে প্রখর রোদে রাস্তায় বেরোলে বা শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য ব্যায়াম করার সময় আমরা ঘামতে থাকি। শুধু কি তাই, আমরা খুব যখন দুশ্চিন্তায় থাকি, রসনা তৃপ্তির জন্য যখন সুস্বাদু মশলাদার খাবার খাই, ক্ষণিক আনন্দের জন্য মদ্যপান করি এবং আরো বহুবিধ কারণে আমরা ঘামতে থাকি। ঘাম ব্যাপারটাই খুব অস্বস্তিকর ও বিরক্তিকর। শরীরের সেই তরতাজা ভাবটা যেন আর থাকে না। ঘামকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমরা কত কিছুই না করতে থাকি – অ্যান্টি-পারস্পিরেশন ক্রিম লাগাই, টোনার লাগাই; আবার ঘামের গন্ধ থেকে মুক্তি পেতে রকমারি বডি স্প্রে বা ডিওডোরেন্ট ব্যবহার করি। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন আমাদের ঘাম হয় কেন বা এর প্রয়োজনীয়তা কী?

ঘাম নিঃসরণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি প্রক্রিয়া কারণ শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং ক্ষতিকারক কিছু রেচনবস্তুকে দেহ থেকে বের করে দিয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। ঘাম  অতি গরমে দেহকে শীতল করে হিটস্ট্রোক থেকে রক্ষা করে এবং কিছু জীবাণুকে দেহে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। আমরা এখানে ঘাম হয় কেন ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার ঘাম ও সেগুলি কখন হয় সেই বিষয়ে আলোকপাত করব।মনে রাখতে হবে, স্বাভাবিক, সুস্থ শরীরের তাপমাত্রা নির্দিষ্ট। পরিবেশের তাপমাত্রার (নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত) বৃদ্ধি বা হ্রাসে দেহের তাপমাত্রার তারতম্য হয় না। কারণ,মানুষের রক্তের একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা আছে এবং তা স্থিতিশীল। এই স্থিতিশীলতা রক্ষাকারী অংশ হল মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস।

ঘাম নিঃসরণ শরীরের একটি অত্যাবশ্যকীয় প্রক্রিয়া। ঘামে প্রধানত জল (৯৯%) ও ইলেক্ট্রোলাইট (তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থ) থাকে। প্রাথমিকভাবে সোডিয়াম ও ক্লোরিন আয়ন থাকলেও, খুব অল্প পরিমাণে পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামও থাকে। রেচনবস্তু হিসেবে ইউরিয়া, অ্যামোনিয়া, ইউরিক অ্যাসিড ইত্যাদিও থাকে। সোডিয়াম ও ক্লোরিনের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি থাকায় ঘামের স্বাদ নোনতা। নির্গত ঘামের পরিমানের ১% হল প্রোটিন যার মধ্যে থাকে ইমিউনোগ্লোবিন (জীবাণু ধ্বংসকারী) এবং গ্লাইকোপ্রোটিন। এছাড়াও থাকে খুবই অল্প পরিমাণে ফ্যাটি অ্যাসিড, ল্যাকটিক অ্যাসিড, অ্যাসকরবিক অ্যাসিড ইত্যাদি। এই কারণেই ঘাম সাধারনত অ্যাসিডধর্মী (pH : ৪ – ৬.৮)।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশটি দেহের থার্মোস্ট্যাট যন্ত্র হিসেবে কাজ করে অর্থাৎ এটি দেহের ভেতরে সবসময় একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ধরে রাখে, যাতে দেহের বিপাকীয় কাজগুলো স্বাভাবিক ভাবে হতে পারে।। আমাদের দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা হল ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। দেহের বাইরের অর্থাৎ পরিবেশের তাপমাত্রা কোনও কারণে যখন স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে বেড়ে যায় তখন হাইপোথ্যালামাস নিজেই নির্দিষ্ট হরমোন-রিলিজিং ফ্যাকটর ক্ষরণ করে, যা পিট্যুইটারি গ্রন্থিকে উদ্দীপিত করে বা সরাসরি ঘামগ্রন্থিকে উদ্দীপিত করে। পিট্যুইটারি গ্রন্থি উদ্দীপিত হলে ট্রপিক হরমোন ক্ষরণ করে নির্দিষ্ট কোষ বা গ্রন্থিকে নির্দেশ দেয়, ঘাম নিঃসরণের কাজে নিয়োজিত হরমান ক্ষরণ করতে। এবার সে হরমোনরা কাজে নেমে পড়লে দেহ থেকে ঘাম বেরোতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না বন্ধ করার নির্দেশ আসে। ক্ষরিত ঘামের মধ্যে যে জলীয় অংশ থাকে তা ত্বকের তাপ নিয়ে (লীনতাপ) বাষ্পীভূত হয়ে গেলে দেহ শীতল হয়।

এখন প্রশ্ন হল ঘাম তৈরি হয় কোথা থেকে? আমাদের দেহে দুই ধরনের ঘর্মগ্রন্থি থাকে – একক্রাইন (Eccrine) ও এপোক্রাইন (Apocrine), এই দুই প্রকার ঘর্মগ্রন্থি থেকেই ঘাম নিঃসৃত হয়ে থাকে। আসুন বিশদে জেনে নেওয়া যাক।
ক. একক্রাইন গ্রন্থি : মানবদেহে প্রায় কুড়ি লক্ষ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ একক্রাইন গ্রন্থি হাত ও পায়ের তালু, কপালসহ সারা শরীর জুড়ে থাকে। মানবদেহের প্রতি বর্গ সেন্টিমিটার এলাকায় প্রায় ১৫০-৩৪০টি এক্রাইন গ্রন্থি পাওয়া যায়। যদিও প্রত্যেক মানুষের দেহে এই সংখ্যা কমতেও পারে, বাড়তেও পারে। তবে এক্রাইন গ্রন্থি সবচেয়ে বেশি থাকে হাত ও পায়ের তালুতে। এই স্থানের গ্রন্থিগুলির মূল কাজ হল হাত ও পায়ের তালু আর্দ্র রাখা যাতে হাত ও পায়ের তালু শুষ্ক হয়ে ফেটে না যায়। কোনো বস্তুকে শক্তভাবে ধরার জন্যেও (Gripping) এই আর্দ্র তালু আমাদের সাহায্য করে।আমাদের দেহে দৈনিক যে পরিমাণ ঘাম উৎপাদিত হয়, তার বেশিরভাগটাই উৎপন্ন করে এক্রাইন গ্রন্থি। এই ঘাম জলীয় প্রকৃতির, স্বাদ লবণাক্ত হয় প্রধানত খাদ্যলবণের উপাদানগুলির উপস্থিতির কারণে।
একক্রাইন গ্রন্থি তিন ধরনের কোষ নিয়ে তৈরি –
১. ডার্ক সেল (Dark Cell): একক্রাইন গ্রন্থির বেশিরভাগ অংশ জুড়ে থাকা ডার্ক সেল ঘামের মধ্যে উপস্থিত থাকা প্রোটিন গ্লাইকোপ্রোটিন নিঃসরণ করে।
২. ক্লিয়ার সেল (Clear Cell): ত্বকের বেসমেন্ট মেমব্রেনের ওপর বা মায়োএপিথেলিয়াল সেলের ওপর অবস্থিত থেকে জল ও ইলেক্ট্রোলাইট নিঃসরণ করে।
৩. মায়োএপিথেলিয়াল সেল (Mioepithelial Cell): মাকু আকৃতির এই কোষগুলি ঘর্মগ্রন্থি ও ত্বকের বেসমেন্ট মেমব্রেনের ক্ষরণশীল কোষের মধ্যে অবস্থিত।

খ. এপোক্রাইন গ্রন্থি : সারা দেহে এই ঘর্মগ্রন্থি না থাকলেও ত্বকের রোমকূপের সঙ্গে এই গ্রন্থিগুলি যুক্ত থাকে, এর মাধ্যমে যে ঘাম নিঃসৃত হয় তা অনেকটা তৈলাক্ত প্রকৃতির।ত্বকের রোমকূপে সিবেসিয়াস গ্রন্থির ক্ষরণ, সিবাম ক্ষরণ হয় বলে, এই ঘাম সিবামের সঙ্গে মিশ্রিত হয়  এবং তৈলাক্ত। আমাদের দেহে উপস্থিত বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়াদের কারসাজিতে ঐ ঘাম বিশ্লেষিত হয়ে গন্ধযুক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরি হয় যার কারণেই ঘামে দুর্গন্ধ হয়। এই সব গ্রন্থিগুলি মানুষের শরীরের বাহুমূল, কুঁচকি, স্তন, জননাঙ্গের আশেপাশে থাকে। বয়ঃসন্ধির পরে, যৌন হরমোনের প্রভাবে এই গ্রন্থিগুলি সক্রিয় হয়। এই ঘাম অ্যাসিডিক বা সামান্য ক্ষারীয় হতে পারে লিপিড, বর্জ্য কার্বোহাইড্রেট, স্টেরয়েড ইত্যাদির উপস্থিতির কারণে।

একক্রাইন গ্রন্থির ঘাম-নিঃসরণ  দেহের তাপ নিয়ন্ত্রণে প্রধান ভূমিকা নেয়। কিন্তু প্রশ্ন হল:
১. ঘাম কীভাবে তৈরি হয় এবং
২. ঘাম নিঃসরণের মাধ্যমে কীভাবে দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়

প্রথমে জেনে নিই চলুন একক্রাইন গ্রন্থি দ্বারা ঘাম তৈরির পদ্ধতিগুলি সম্পর্কে। নিম্নলিখিত কতগুলি ধাপের মাধ্যমে এই পদ্ধতি সংগঠিত হয় –

ক) পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়লে ত্বকের তাপ-গ্রাহকগুলি উদ্দীপিত হয়, তাপের অনুভূতি বহন করে স্নায়ুকোষ পৌঁছে দেয় হাইপোথ্যালামাসের তাপ-নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রে। এবার হাইপোথ্যালামাস জরুরী অবস্থাকে স্থিতাবস্থায় আনতে কাজে নেমে পড়ে।  থার্মোরেগুলেটরি স্টিমুলি অর্থাৎ তাপ-উদ্দীপক স্নায়ু-সমাপ্তিগুলিকে (Nerve ending) এক্রাইন গ্রন্থির মধ্যে অ্যাসিটাইলকোলিন নামক নিউরো-ট্রান্সমিটার নিঃসরণ করতে উদ্দীপ্ত করে।
খ) যখন অ্যাসিটাইলকোলিন গ্রাহক উদ্দীপ্ত হয়, তখন কোষের সাইটোপ্লাজম এবং কোষের বাইরের জলীয় মাধ্যমের মধ্যে ইলেক্ট্রোলাইটের আদানপ্রদান চলতে থাকে।
গ) ক্লিয়ার সেলের ক্যালসিয়াম ইলেক্ট্রলাইটযুক্ত জলীয় পদার্থ ক্লিয়ার সেলের সাইটোপ্লাজমের মধ্যে প্রবেশ করে।
ঘ) ইলেক্ট্রলাইট ও জলের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ক্লিয়ার সেলের সাইটোপ্লাজম থেকে পটাসিয়াম ক্লোরাইড নামক ইলেক্ট্রোলাইটটি বেরিয়ে চলে যায়।
ঙ) এর ফলে আবার নাইট্রোজেন, পটাসিয়াম, ক্লোরাইড ইত্যাদি ইলেক্ট্রোলাইট সাইটোপ্লাজমের মধ্যে প্রবেশ করে। ক্লিয়ার সেলের সাইটোপ্লাজমের মধ্যে সোডিয়াম ইলেক্ট্রোলাইটের ঘনত্ব বাড়তে থাকে। সোডিয়ামের ঘনত্ব বেড়ে গেলে সোডিয়াম ইলেক্ট্রোলাইট কোষের বাইরে বেরিয়ে যায়। তার পরিবর্তে পটাসিয়াম ইলেক্ট্রোলাইট কোষের মধ্যে প্রবেশ করে। একই সঙ্গে ক্লোরাইড আয়ন কোষের মধ্যে প্রবেশ করে।
চ) সোডিয়াম-পটাসিয়াম-ক্লোরাইড কো-ট্রান্সপোর্টার সেল মেমব্রেনটির সোডিয়াম ইলেক্ট্রোলাইটের প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে থাকে। ক্লোরাইড ও সোডিয়াম ইলেক্ট্রলাইট তখন পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে সোডিয়াম ক্লোরাইড তৈরি করে যা ঘামের অন্যতম প্রধান উপাদান।
ছ) একক্রাইন গ্রন্থির নালিসদৃশ অংশ সোডিয়াম ক্লোরাইডের পুনঃশোষণ করে ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখে। এরপর ঘর্মগ্রন্থির মাধ্যমে ত্বক দিয়ে ঘাম নিঃসৃত হয়।

অ্যাপোক্রাইন গ্রন্থির ঘাম নিঃসরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে কয়েকটি যৌন হরমোন ।এগুলো হল ইস্ট্রোজেন, টেস্টোস্টেরন এবং অন্যান্য স্টেরয়েড হরমোন।

ঘাম তৈরি হয় কীভাবে তা বোঝা গেল এবার জেনে নিই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ(Thermoregulation) পদ্ধতি:

একক্রাইন গ্রন্থি ঘাম নিঃসরণ করে দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে প্রধান ভূমিকা নিলেও এই গ্রন্থির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত হয় সংবেদী স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশটিই মূলত দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। দেহের বাইরে, পরিবেশের তাপমাত্রা যখন খুব বেড়ে যায়, তখন হাইপোথ্যালামাস এক্রাইন গ্রন্থিকে পরোক্ষভাবে নির্দেশ দেয় ঘাম নিঃসরণ করার জন্য আর তখনই আমাদের দেহ থেকে ঘাম নিঃসরণ হয়। ত্বকের উপরিতলে ঘাম সঞ্চিত হয়। এই ঘাম শরীর থেকে লীনতাপ (Latent Heat Of Vapourisation) সংগ্রহ করে বাষ্পীভূত হয়ে যায়। ঘামের বাষ্পীভবনের জন্য যে শক্তির প্রয়োজন হয় তা হল তাপশক্তি। আমাদের শরীরে উৎপন্ন অতিরিক্ত তাপ ঘামের বাষ্পীভবনের জন্য ব্যবহার হয়ে গেলে দেহ শীতল হয়ে যায় আর আমাদের শীতল অনুভূতি দেয়। মজার ব্যাপার, গরম-ঠান্ডা সবই কিন্তু দেহের উপরিভাগ অর্থার ত্বকের অনুভূতি!

সাধারণ পরিস্থিতিতে ৫% একক্রাইন গ্রন্থি সক্রিয় থাকে ও দৈনিক ০.৫ লিটার থেকে ১ লিটার ঘাম উৎপন্ন করে। একক্রাইন গ্রন্থি সর্বাধিক দিনে ১০ লিটার অবধি ঘাম উৎপন্ন করতে পারে। দিনের বেলা প্রখর রৌদ্রে বা শারীরিক কসরতের সময় প্রতি ঘন্টায় ১.৪ লিটার ঘাম উৎপন্ন করে। প্রখর রৌদ্রে বেরোনোর বা শারীরিক কসরত শুরু করার মোটামুটি ৮ মিনিটের মধ্যে বেশিরভাগ এক্রাইন গ্রন্থি সক্রিয় হয়ে যায়। প্রতিটি গ্রন্থি থেকে প্রচুর পরিমাণে ঘাম নিঃসৃত হতে থাকে। তবে তাপ উদ্দীপকটি অপসারিত হলে বা ৪-৬ ঘন্টা একটানা তাপ উদ্দীপক কাজ করলে দেখা যায় এর প্রভাব শরীরের ওপর আর অতটা থাকে না। তাই ধীরে ধীরে ঘাম নিঃসরণ কমে যেতে থাকে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ঘামগ্রন্থি থেকে একধরণের উৎসেচক বেরোয় যা ঘাম-নালীতে শোষিত হয়। এর নাম ব্র্যাডিকাইনিন। এটি ঘাম-গ্রন্থি সংলগ্ন রক্তনালীর প্রসারণ ঘটায়। তার ফলে ঘাম বেরোতে শুরু করলে তা কিছুক্ষণ স্থায়ী হয়।

দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্যই প্রধানত ঘাম নিঃসরণ হলেও আরো কয়েকটি বিশেষ বিষয় আছে যার প্রভাবে ঘাম নিঃসরণ হয় –

১) সংকটকালীন জরুরি পরিস্থিতিতে: আমরা যখন ভয় পাই, উত্তেজিত হই, দুশ্চিন্তা করি বা খুব চাপের মধ্যে থাকি তখন আমরা ঘামতে থাকি। এই ঘামকে বলা হয় সংবেদনশীল ঘাম (Emotional Sweating)। সংবেদনশীল ঘামের প্রকৃতি বা উৎপাদনের কারণ কিন্তু একেবারেই আলাদা। দেহকে শীতল করার জন্য এই ঘাম হয় না। আমরা যখন কোনো বিপদের মধ্যে থাকি তখন আপদকালীন জরুরী হরমোন অ্যাড্রিনালিন (Adrenaline) প্রচুর পরিমাণে নির্গত হয়। জরুরি অবস্থায় এই হরমোন ক্ষরিত হয় এবং সংকটকালীন পরিস্থিতি থেকে দেহকে উদ্ধার করার জন্য – আমাদের হৃদগতি, শ্বাসগতি, রক্তবাহী নালীর মধ্যে রক্তপ্রবাহের বেগ বাড়িয়ে দেয় মস্তিষ্কে অতিরিক্ত অক্সিজেন যোগানের জন্য ,মাংসপেশির মধ্যে টান ভীষণভাবে বাড়িয়ে দেয়। অ্যাড্রিনালিনের প্রভূত নিঃসরণ (Adrenalin Rush) আবার এপোক্রাইন গ্রন্থিকে ঘর্ম নিঃসরণের জন্য সক্রিয় করে তোলে। তাই আমরা সংকটকালীন জরুরি পরিস্থিতিতে ঘামতে থাকি।

২) মশলাযুক্ত খাবার খেলে: মশলাযুক্ত খাবার মানেই মুখরোচক তা একটু খাওয়ার পরেই আমাদের মুখ জ্বলতে থাকে, মুখগহ্বরের মধ্যে কেমন একটা গরম অনুভূতি হতে থাকে আমরা ঘামতে থাকি। এই ঘামকে বলা হয় রসনাজনিত ঘাম (Gustatory Sweating)। আসলে ক্যাপসাইসিনের (Capsaicin) উপস্থিতি কোনো খাবারকে মশলাদার বানায়।ঝাল মশলাদার খাবার খেলে তার মধ্যে উপস্থিত ক্যাপসাইসিন মুখগহ্বরের তাপ সংবেদী কোষগুলির সঙ্গে বিক্রিয়া করে। তাপ সংবেদী কোষগুলি মস্তিষ্কে সিগন্যাল পাঠায় যে মুখের মধ্যে গরম পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। সেই মুহূর্তে দেহকে ঠান্ডা রাখার একটাই পদ্ধতি আছে – ঘর্ম নিঃসরণ। তাই এই পরিস্থিতিই ঘাম নিঃসরণ শুরু করে দেয়।

৩) মাংস ভক্ষণ করলে: বেশি পরিমাণে মাংস খেলে ঘাম নির্গত হতে থাকে। এই ঘামকে বলা হয় মাংস ভক্ষণজনিত ঘাম (Meat Sweat)। মাংস বেশি পরিমাণে খেলে বিপাক কার্যের জন্য প্রচুর পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়। এই শক্তির যোগানের সঙ্গে সঙ্গে দেহের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। দেহের তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ঘাম নিঃসরণের মাধ্যমে দেহকে শীতল করার সাধারণ পদ্ধতিটিও শুরু হয়ে যায়।

৪) মদ্যপান করলে: শারীরিক পরিশ্রমের সময় যেমন হৃদগতি বেড়ে যায়, রক্তবাহী নালি প্রসারিত হয়। মদ্যপান করলে শরীরে ঠিক সেইরকম পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে দেহকে ঠান্ডা রাখার জন্য ঘাম নিঃসরণ শুরু হয়ে যায়।

৫) জিনগত কারণে: ঘাম নিঃসরণ কতটা হবে তা অনেকটা জিনের ওপর নির্ভর করে। এক্ষেত্রে এমন কিছু কিছু জেনেটিক ব্যাধি আছে ঘামের মাত্রাভেদ ঘটিয়ে থাকে। যেমন – হাইপারহাইড্রোসিস (Hyperhidrosis) জেনেটিক রোগে মানুষ স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় চার গুণ ঘামে। ৫% আমেরিকান হাইপারহাইড্রোসিসের শিকার। হাইপোহাইড্রোসিস (Hipohidrosis) জেনেটিক রোগে মানুষ আবার স্বাভাবিকের তুলনায় কম ঘামে। ট্রাইমিথাইলামিনুরিয়া (Trimethyaminuria) নামক জেনেটিক রোগে ঘামের গন্ধ মাছ বা পচা ডিমের মতো হয়।

ফলে ঘাম যেমন শরীরের পক্ষে খুবই প্রয়োজনীয় তেমনই একেকসময় একেক প্রকৃতির ঘাম আমাদের শরীর থেকে নিঃসৃত হয় যা আমরা কখনো সেভাবে খেয়ালও করি না। প্রসঙ্গত, কোনভাবে ঘর্মগ্রন্থিগুলির মুখ বন্ধ হয়ে গেলে ঘামাচি হয়, সে সম্পর্কে বিশদে জানতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন।

One comment

আপনার মতামত জানান