ভলিবল খেলা সাধারণভাবে একটি স্পর্শ-বিহীন ইনডোর গেমস (Non-contact Indoor Games)। তবে ভলিবল আউটডোর গেমস হিসেবেও খেলা যায়। মূলত ছয় জন খেলোয়াড়ের দুটি দলের মধ্যে এই খেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সমগ্র ইউরোপ এবং পূর্ব এশিয়ায় ভলিবল খেলা অত্যন্ত জনপ্রিয়।
১৮৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ম্যাসাচুসেটসের হলইয়োকে ওয়াইএমসিএ-র (YMCA) শরীরচর্চার প্রশিক্ষক উইলিয়াম. জি. মর্গ্যান প্রথম ব্যাডমিন্টন খেলার নিয়ম-কানুন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘মিন্টোনেট’ (Mintonette) নামে নতুন এক খেলার উদ্ভাবন করেন। এই খেলাটির মধ্যে বেসবল, টেনিস এমনকি হ্যান্ডবল খেলার রীতিও মিশেছিল। ম্যাসাচুসেটসের হলইয়োক থেকে মাত্র দশ মাইল দূরের স্প্রিংফিল্ডে এর চার বছর আগে উদ্ভূত হয়েছিল বাস্কেটবল খেলা। মূলত ওয়াইএমসিএ-র বয়স্ক সদস্যদের জন্য তুলনায় কম শারীরিক কসরতপূর্ণ একটি খেলা উদ্ভাবনের পথেই জন্ম হয় মিন্টোনেটের। প্রাথমিক পর্বে এটি ইনডোর গেম হিসেবেই খেলা হত। তবে বাস্কেটবলের থেকে এই মিন্টোনেট তুলনায় কম গতিসম্পন্ন ছিল। খেলার নিয়ম-কানুনও তৈরি করেন প্রথম উইলিয়াম. জি. মর্গ্যান। প্রাথমিক পর্বে এই খেলার নিয়ম স্থির হয় –
- ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি উঁচু একটি জাল রাখা থাকত কোর্টের মাঝখানে।
- কোর্টের দৈর্ঘ্য হত ৫০ ফুট এবং প্রস্থে তা হত ২৫ ফুট।
- মোট নয়টি ইনিংসে সমগ্র খেলাটিকে বিভক্ত করা হত এবং প্রত্যেক ইনিংসে একটি দল তিনবার সার্ভ করার সুযোগ পেত।
- একবার সার্ভ ব্যর্থ হলে প্রত্যেক দল দ্বিতীয়বার সুযোগ পেত সার্ভ করার।
- প্রথম সার্ভ ছাড়া অন্য সময় জালের মধ্যে বল আঘাত করলে তা ফাউল হিসেবে বিবেচিত হত।
১৮৯৬ সালে অধুনা স্প্রিংফিল্ড কলেজে এই খেলার প্রথম আনুষ্ঠানিক ম্যাচে অ্যালফ্রেড হ্যালস্টেড এই খেলার প্রকৃতি বিচার করে এর নাম রাখেন ভলিবল (Volleyball)। আন্তর্জাতিক ওয়াইএমসিএ এই ভলিবল খেলার নিয়ম-কানুনে কিছু পরিবর্তন করে এবং এই সংস্থার মাধ্যমেই খেলাটি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯০০ সালের শুরুর দিকে ‘স্প্যাল্ডিং’ নামে একটি আমেরিকান স্পোর্টস পাবলিশিং কোম্পানি প্রথম এই খেলার নিয়ম-কানুন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে। অনেকেই বলে থাকেন এই স্প্যাল্ডিং কোম্পানিই ১৮৯৬ সালে ভলিবল খেলার জন্য প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিক বল তৈরি করে। ক্রমে ক্রমে খেলার রীতি-নীতি বদলাতে থাকে। ১৯১৬ সালে ফিলিপাইন্সে একটি ‘থ্রি হিট’ নিয়ম চালু হয়। ১৯১৭ সালে খেলার লক্ষ্য হিসেবে ২১ পয়েন্ট অর্জনের বদলে ১৫ পয়েন্ট অর্জনই স্থিরীকৃত হয়। ১৯১৯ সালে ‘আমেরিকান এক্সপিডিশনারি ফোর্সেস’ (American Expeditionary Forces) নতুন নতুন দেশে ভলিবল খেলাকে সম্প্রসারিত করতে প্রায় ১৬ হাজার ভলিবল বিতরণ করে। ১৯০০ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে প্রথম কানাডায় ভলিবল খেলা স্বীকৃতি পায়। ১৯৪৭ সালে গড়ে ওঠে ‘ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল ডি ভলিবল’ বা সংক্ষেপ এফআইভিবি (FIVB)। ১৯৪৯ সালে এই সংস্থার উদ্যোগে বিশ্বে প্রথম বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজিত হয় পুরুষদের জন্য এবং একইভাবে ১৯৫২ সালে মহিলাদের জন্যও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজিত হয়। ক্রমে ক্রমে ব্রাজিল, ইউরোপ, রাশিয়া, চিন এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশেও ভলিবল বর্তমানে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা। ‘বিচ ভলিবল’ নামে এই খেলার নতুন একটি রূপ-বৈচিত্র্য দেখা যায় যেখানে প্রতি দলে মাত্র দুজন করে খেলোয়াড় থাকে এবং তা সমুদ্রের ধারে বালিতে খেলা হয়। ১৯৯৬ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে বিচ ভলিবল অন্তর্ভুক্ত হয়। ‘ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ভলিবল ফর ডিসেবলড’ সংস্থার উদ্যোগে প্যারালিম্পিকেও এই ভলিবল অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে ১৯৬৪ সাল থেকে পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্যেই ভলিবল খেলাটি অলিম্পিকে নিয়মিতভাবে স্থান পেয়ে আসছে।
কোর্টের মাঝের জালের উপর দিয়ে বলকে বিপক্ষের কোর্টে পাঠানোই এই খেলায় প্রত্যেক দলের মূল লক্ষ্য থাকে। কেবলমাত্র হাত ব্যবহার করে মাঠের একেবারে মাঝখানে এসে বলে আঘাত করেন খেলোয়াড় এবং প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরা তখন বলটিকে বাউন্স করা থেকে আটকানোর চেষ্টা করেন। ৩টি বা ৫টি সেটে এই খেলাটি হয়। খেলার শেষে সবথেকে বেশি সেটে যে দল বেশি স্কোর করেছে, সেই দলই বিজয়ী ঘোষিত হয়। ভলিবল খেলার জন্য সমগ্র মাঠের দৈর্ঘ্য হওয়া উচিত ২৯.৫ ফুট এবং প্রস্থ হওয়া দরকার ৫৯.১ ফুট। ৩৯.৪ ইঞ্চি প্রস্থ বিশিষ্ট একটি জাল দিয়ে সমগ্র মাঠটি দুটি সমান মাপের বর্গাকার কোর্টে বিভক্ত থাকে। পুরুষদের খেলায় জালের উচ্চতা হয় ২.৪৩ মিটার এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে এই উচ্চতা হয় ২.২৪ মিটার। মাঠের মধ্যে জালের সমান্তরালে যে নির্দিষ্ট লাইনটি থাকে তাকে বলা হয় ‘আক্রমণাত্মক রেখা’ (Attacking Line)। ভলিবল খেলার জন্য প্রয়োজনীয় বলের পরিধি হওয়া উচিত ৮ ইঞ্চি এবং তার ওজন হওয়া দরকার কম বেশি ১০ আউন্স। খেলার সময় প্রত্যেক দলে ৬ জন করে খেলোয়াড় থাকে। এই খেলোয়াড়দের মধ্যে কেউ কেউ আক্রমণাত্মক অঞ্চলে বা কেউ আবার রক্ষণাত্মক অঞ্চলে নিজের অবস্থান নেয়। প্রত্যেকবার পয়েন্ট পাওয়ার পরে খেলোয়াড়দের অবস্থান ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরতে থাকে। প্রতিপক্ষের কোর্টের সীমানার মধ্যে মাটিতে বলটিকে বাউন্স করাতে পারলেই একটি দল এক পয়েন্ট পায়। আবার প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় যদি জালে বলটি মারেন, তাহলেও সেই দলটি পয়েন্ট পায়। বল সার্ভ করার সময় খেলোয়াড়কে বেস লাইনের পিছন থেকে কেবলমাত্র হাত ব্যবহার করে বলে আঘাত করতে হয়। একবার সফলভাবে সার্ভ করা হয়ে গেলে সেই খেলোয়াড় পুনরায় তার দলে সাধারণ খেলোয়াড় হিসেবে যোগ দিতে পারেন। বিপক্ষের কোর্টে বল ফেরত দেওয়ার আগে প্রত্যেক দলের খেলোয়াড় অন্তত তিনবার বলে আঘাত করতে পারেন। একজন খেলোয়াড় পরপর দুবার বলে আঘাত করতে পারবেন না। বাউন্ডারি লাইনে বলটি আঘাত করলে বলটিকে ‘ইন-প্লে’ (in-play) অর্থাৎ খেলার অংশীভূতই ধরা হয় এবং সেই সময় রক্ষণাত্মক দল বলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে নিজেদের কোর্টে ফিরে আসা থেকে প্রতিহত করতে পারে। যদি এই সময় বলটি বিপক্ষের কোর্টে গিয়ে পৌঁছায়, তবে সেই দল এক পয়েন্ট পায়। বর্তমানে প্রতিটি খেলার লক্ষ্য থাকে ২৫ পয়েন্ট অর্জন করা। ৩টি বা ৫টি সেটে সর্বোচ্চ পয়েন্ট অর্জনকারী দলই খেলায় বিজয়ী ঘোষিত হয়। এক্ষেত্রে বেসলাইনের বাইরে গিয়ে সার্ভ করা, বল ধরে রাখা বা বল সঙ্গে নিয়ে দৌড়ানো ইত্যাদি কাজ নিয়মবিরুদ্ধ বলে বিবেচিত হয়। খেলোয়াড়রা কোনওভাবেই জালটিকে স্পর্শ করতে পারবেন না এবং জালের নীচ দিয়ে কখনও বলকে আঘাত করা যাবে না। এই খেলার জন্য খেলোয়াড়দের সার্ভ (Serve), পাস (Pass), সেট (Set), অ্যাটাক (Attack), ব্লক (Block) ও ডিগ (Dig) ইত্যাদি দক্ষতা থাকা দরকার।
২০০০ সালে আন্তর্জাতিক স্তরে ভলিবল খেলার নিয়ম-কানুন বেশ কিছু পরিবর্তিত হয়। প্রথমত প্রতিপক্ষের কোর্টে জালের উপর দিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত সার্ভের সময় বল জালে আটকে গেলেও তা ফাউল হিসেবে ধরা হবে না। দ্বিতীয়ত সার্ভিস এরিয়াটির আয়তন বাড়ানো হয়েছিল যাতে খেলোয়াড়েরা এন্ড লাইনের পিছনে যে কোনও স্থান থেকে সার্ভ করতে পারেন। বল ধরা বা বলে পরপর দুবার স্পর্শের জন্য যে ফাউল ডাকা হত আগে, তা বদলে প্রত্যেক দলের জন্য অন্তত একবার একজন খেলোয়াড়ের বহু স্পর্শ (Multiple Touch) স্বীকৃত হয়। ২০০৮ সালে এনসিএএ (NCAA) মহিলাদের ভলিবল খেলার ক্ষেত্রে প্রথম চারটি সেটে জয়লাভের জন্য নির্ধারিত ৩০ পয়েন্টের বদলে ২৫ পয়েন্টে কমিয়ে আনা হয়। যদি পঞ্চম সেটে খেলা পৌঁছায়, তবে সেক্ষেত্রে ন্যূনতম পয়েন্ট নির্ধারিত হয়েছে ১৫।
ভলিবল খেলিয়ে দেশগুলির মধ্যে ব্রাজিল সর্বদাই প্রথম তিনে থাকে। পুরুষ ভলিবল খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভলিবল খেলোয়াড় হিসেবে আমেরিকান ভলিবল খেলোয়াড় ‘কার্চ কিরালি’ এবং মহিলা ভলিবল খেলোয়াড়দের মধ্যে আমেরিকান ভলিবল খেলোয়াড় ‘মিস্টি মে-ট্রেনর’ শ্রেষ্ঠ মহিলা ভলিবল খেলোয়াড় হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকেন।
ভারতে গ্রামাঞ্চলে এবং শহরাঞ্চলে ভলিবল সমানভাবে জনপ্রিয়। ২০১৩ সালে এই খেলায় ভারত সমগ্র এশিয়ার মধ্যে ৫ম স্থান এবং সমগ্র বিশ্বে ২৭তম স্থান অর্জন করে। ২০০৩ সালে বিশ্ব যুব চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের যুব খেলোয়াড়েরা দুর্দান্ত দক্ষতার পরিবেশন করেছিল। কিন্তু বর্তমানে ভারতের ভলিবলে প্রযোজক তথা অর্থলগ্নিকারীর অভাবে খেলার ভবিষ্যৎ দ্বিধা-দ্বন্দ্বময়। বর্তমানে ভারতে একমাত্র ভলিবল প্রতিযোগিতা হিসেবে আয়োজিত হয় প্রো-ভলিবল লিগ। ১৯৫১ সালে ভারতে তৈরি হয় ‘ভলিবল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া’ (Volleyball Federation of India)। তবে তার আগে ১৯৩৬ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে আন্তঃরাজ্য ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজিত হত বছরে দুবার করে। পাঞ্জাবের লুধিয়ানায় ভারতের ভলিবল ফেডারেশনের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।