প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশেই কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরী করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। বিশ্বের পালনীয় সেই সমস্ত দিবসগুলির মধ্যে একটি হল বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস (World patient safety day)।
প্রতিবছর ১৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী রোগীর স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া ও এই বিষয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সারা বিশ্ব জুড়ে বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস পালিত হয়ে থাকে।
রোগী সুরক্ষার মধ্যে যে বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় সেগুলি হল রোগ নির্ণয়ে ক্রুটি, সংক্রমণ, ওষুধ প্রদানে ক্রুটি, ভুল জায়গায় অস্ত্রোপচার, পুনরায় ভর্তি হওয়া প্রভৃতি প্রসঙ্গ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরিখে প্রতিবছর আর্থিকভাবে অনুন্নত দেশগুলিতে নিরাপত্তার অভাবে প্রায় ২৬ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর এই বিপুল সংখ্যা কমানোর জন্য এবং রোগীদের আরও বেশী সচেতন করার উদ্দেশ্যে বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
২০১৯ সালে ৭২ তম আন্তজার্তিক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্মেলনে বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস পালনের প্রস্তাবটি পেশ করা হলে এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানায় বিশ্বের ১৯৪টি দেশ। ২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথমবার বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস পালন করে। তাঁরা প্রাথমিকভাবে যত্নের অভাবে কোন রোগীর স্বাস্থ্যসেবা প্রক্রিয়া চলাকালীন যাতে ক্ষতি না হয় এবং স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন ক্ষতির ঝুঁকিগুলিকে হ্রাস করার উদ্দেশ্য এই দিনটি পালন করার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। রোগীর সাথে তাঁর পরিবারের মানুষরাও যাতে রোগীর সেবা করার পাশাপাশি নিজেদের যত্ন নিতে পারেন, সেই বিষয়ে যত্নবান হতে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। চিকিৎসক ও নার্স বা স্বাস্থ্য কর্মীদের রোগীদের প্রতি আরও যত্নবান হওয়ার জন্য বার্তা দেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই দিনটি পালনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সকল দেশকে আন্তর্জাতিক স্তরে রোগীদের সুরক্ষা বিষয়ে সচেতন হওয়ার জন্য আবেদন জানানো হয়।
বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ এবং আলোচনা সভা ইত্যাদির মাধ্যমে সাধারণত এই দিনটি পালন করা হয়ে থাকে। প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে মনুমেণ্ট বা কোন ঐতিহাসিক স্থাপত্যে, রাস্তায় কমলা আলো জ্বালিয়ে এই দিনটিকে পালন করা হয়। ২০২০ সালে অতিমারীর কারণে কোন আলোচনা সভার আয়োজন করা যায়নি বদলে বিভিন্ন ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। ২০২১ সালে বিভিন্ন ভার্চুয়াল সভার মাধ্যমে দিনটি উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
প্রতিবছর নির্দিষ্ট কিছু প্রতিপাদ্য বা থিমের মাধ্যমে দিনটি পালন করা হয়। প্রথম বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস পালিত হয় ২০১৯ সালে। সেই বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘রোগী সুরক্ষা : একটি বিশ্ব স্বাস্থ্য অগ্রাধিকার” (Patient Safety: A Global Health Priority’.)। দ্বিতীয় বছর ২০২০ সালে করোনা মহামারীকালে এই দিনটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘স্বাস্থ্য কর্মীর সুরক্ষা : রোগীর সুরক্ষার জন্য অগ্রাধিকার'(Safe health workers, Safe patients’)। রোগী এবং স্বাস্থ্যকর্মী একে অন্যের সাথে জড়িত। করোনা মহামারীতে ডাক্তার নার্স, স্বাস্থ্য কর্মী ও প্রথম সারির যোদ্ধাদের বিভিন্ন দেশ বীরের সম্মান জানালেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁদের উপরে আক্রমণ হয়। মেক্সিকোয় চিকিৎসক, নার্সদের উপরে শারীরিক নিগ্রহ হয়। তাঁদের ডিম ছুৃঁড়ে মারা হয়। ফিলিপিন্সে এক নার্সকে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারা হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে স্বাস্থ্যকর্মীদের উপরে নানা ধরনের মানসিক অত্যাচার হয়। কোথাও তাদের ভাড়া বাড়ী থেকে তুলে দেওয়া হয় তো কোথাও পাড়ার মানুষেরা তাদের বয়কট করেন। এই অবস্থায় স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করলে তাঁদের কাজে আরও ত্রুটি থেকে যেতে পারে। এই কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবসে এই স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এই বিশেষ প্রতিপাদ্যটি গ্রহণ করে। ২০২১ সালের প্রতিপাদ্য ছিল ‘মাতৃত্ব এবং সদ্যোজাতের নিরাপত্তা’ (Safe maternal and newborn care)। প্রত্যেকটি রোগী ও তাঁর সেবায় যুক্ত সকলকে সক্রিয়ভাবে রোগীর সুরক্ষার জন্য আরও বেশী গুরুত্ব দেওয়ার জন্য সচেষ্ট হতে কর্মসূচি নিতে বলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। প্রতিদিন প্রায় ৮১০ জন গর্ভবতী মহিলা সারা বিশ্বে মারা যান শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে। এবং প্রায় ৬৭০০ জন সদ্যজাত শিশু মারা যায় সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। মহামারী কালে এই বিষয়গুলির উপর বিশেষভাবে নজর দেওয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফ থেকে এই প্রতিপাদ্যটি গ্রহণ করা হয় । বিভিন্ন দেশের সরকারকে কাঠামোগত উন্নয়নের জন্য উৎসাহিত করা হয় যেগুলি তাদের গর্ভবতী মা ও সদ্যোজাতদের আরও বেশী সুরক্ষা প্রদান করবে। ২০২২ সালের প্রতিপাদ্য ছিল ‘ওষুধ-সম্পর্কিত নিরাপত্তা’ (Medication Safety) এবং সেই বছরের স্লোগান ছিল ‘ক্ষতি ছাড়া ওষুধ’ (Medication Without Harm)। ২০২৩ সালের প্রতিপাদ্য হল ‘রোগীর নিরাপত্তার জন্য রোগীদের জড়িত করা’ (Engaging patients for patient safety)।
One comment