জিয়াউর রহমান

জিয়াউর রহমান

বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান (Ziaur Rahman) বাংলাদেশের এক অন্যতম স্মরণীয় রাজনীতিবিদ। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতির পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অধীনে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ ফোর্সেস কমাণ্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় জেড ফোর্সের ব্রিগেড কমাণ্ডার ছিলেন তিনি এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ পদে উন্নীত হন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের হত্যার পর চরম বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়েই জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি (BNP) সেকালের বাংলাদেশে অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মর্যাদা পায়। তাঁর ক্ষমতায় আসার পরেই বাংলাদেশে বহুদলীয় রাজনীতির সূত্রপাত হয়। শাসনকালে ১৯ দফা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়ন সাধন। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাক্‌ স্বাধীনতা এবং মুক্ত বাজার অর্থনীতি শুরু হয়। ১৯৮৫ সালে তৈরি হওয়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘সার্ক’-এর ভিত্তিভূমি রচনায় জিয়াউর রহমানের বিশেষ অবদান ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নতুন পররাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী তিনি চীন, আমেরিকা এবং সৌদি আরবের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের জন্য ‘হিলাল-ই-জুরাত’ এবং ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত হন জিয়াউর রহমান।

১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ব্রিটিশ শাসিত ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত বগরা জেলার বাগবাড়িতে (মতান্তরে গাবতলীতে) জিয়াউর রহমানের জন্ম হয়। তাঁর ডাকনাম ছিল কমল। তাঁর বাবা মনসুর রহমান ছিলেন একজন রসায়নবিদ যিনি মূলত কাগজ ও কালি সংক্রান্ত নানাবিধ রাসায়নিক বিষয়ে গবেষণা করেছিলেন এবং কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে কাজ করতেন। জিয়াউরের মায়ের নাম ছিল জাহানারা খাতুন। বাগবাড়িতেই তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়। তাঁর দুই ছোট ভাইয়ের নাম যথাক্রমে আহমেদ কামাল এবং খলিলুর রহমান। পরবর্তীকালে ১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে খালেদা খানাম পুতুলের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। বিবাহের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে ‘অফিসার অফ দ্য ডিফেন্স ফোর্সেস’ পদে উন্নীত হয়েছিলেন তিনি। জিয়াউরের স্ত্রী খালেদা পুতুল পরে খালেদা জিয়া নামে পরিচিত হন যিনি তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই বিবাহের সময় করাচিতে থাকার কারণে জিয়াউরের বাবা মনসুর আসতে পারেননি এবং বিবাহের অনেক আগেই জিয়াউরের মা ও মারা গিয়েছিলেন।   

বগরা জেলা স্কুলে তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয়। পরে ১৯৪৬ সালে কলকাতার হেয়ার স্কুলে তাঁকে ভর্তি করে দেন তাঁর বাবা। কিন্তু এই স্কুলে বেশিদিন পড়াশোনা করেননি তিনি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে পর্যন্তই হেয়ার স্কুলে পড়তে পেরেছিলেন তিনি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের পাকিস্তানের নাগরিক হওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন জিয়াউরের বাবা মনসুর। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রথম রাজধানী করাচিতে চলে যান তিনি। ১১ বছর বয়সে জিয়াউর রহমান করাচির অ্যাকাডেমি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে ঐ স্কুল থেকেই তাঁর মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়। ১৯৫৩ সালে ডি. জে সিন্ধ গভর্নমেন্ট সায়েন্স কলেজে ভর্তি হন তিনি এবং ঐ একই বছরে কাকুলের পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে যোগ দেন জিয়াউর।

১৯৫৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি থেকে ১২তম পিএমএ দীর্ঘকালীন কোর্সে প্রথম দশ জনের মধ্যে স্নাতক উত্তীর্ণ হওয়ার পরে তাঁকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় লেফটেন্যান্ট হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এই সেনাবাহিনীতে কমাণ্ডো প্রশিক্ষণ, প্যারাট্রুপারের প্রশিক্ষণ এবং ইন্টেলিজেন্স কোর্সের বিশেষ প্রশিক্ষণও পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান । এক স্বল্পকালীন সফরে পূর্ব পাকিস্তান যান জিয়াউর রহমান এবং অত্যন্ত বিস্মিত হন মিলিটারিদের প্রতি বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের বিরূপ মনোভাব লক্ষ্য করে। তাঁরা অনেকেই মনে করতেন সামরিক খাতেই দেশের প্রভূত সম্পদ অপব্যয়িত হয়। তাছাড়া সেনাবাহিনীতে খুব কম সংখ্যক বাঙালি থাকায় এক অদৃশ্য বিভেদমূলক মনোভাবও কাজ করতো তাঁদের মধ্যে। আর এই কারণেই তরুণ বাঙালিরা সেনাবাহিনীতে আসতে চাইছে না বা তাঁদের আসতে দেওয়া হত না। করাচিতে দুই বছর কাজ করার পরে ১৯৫৭ সালে তাঁকে পূর্ববঙ্গ রেজিমেন্টে স্থানান্তরিত করা হয়। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মিলিটারি প্রশিক্ষণ স্কুলেও তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স বিভাগে কাজ করেছেন জিয়াউর রহমান। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে আইয়ুব খানের সামরিক নীতির কারণে জিয়াউর রহমানের মনে হয় সেনাবাহিনীর প্রতি বাঙালি মধ্যবিত্তের মানসিকতায় খানিক বদল ঘটানো দরকার। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ১০০-১৫০ সৈন্যের একটা বাহিনীর কমাণ্ডার হিসেবে পাঞ্জাবের খেমকরণে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের সম্মুখীন হন তিনি। এই যুদ্ধে সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘হিলাল-ই-জুরাত’ উপাধিতে ভূষিত করে। এই পুরস্কারটি পাকিস্তানের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ সামরিক পুরস্কার হিসেবে স্বীকৃত। পূর্ববঙ্গ রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটেলিয়ানের কমাণ্ডার হিসেবে তিনটি ‘সিতারা-ই-জুরাত’ পদক, ৮টি ‘তামঘা-ই-জুরাত’ পদক অর্জন করেন। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমির প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন জিয়াউর এবং পরে কোয়েটার ‘কমাণ্ড অ্যাণ্ড স্টাফ কলেজ’-এও প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন তিনি। ‘কমাণ্ড অ্যাণ্ড ট্যাক্টিকাল ওয়ারফেয়ার’ নামে একটি কোর্স করেছিলেন জিয়াউর। ‘৮ম ও ৯ম বেঙ্গলস’ নামে দুটি বাঙালিদের ব্যাটেলিয়ান গড়ে তোলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরে দ্বিতীয় পূর্ববঙ্গ রেজিমেন্টের সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড পদে উন্নীত হন তিনি। এই সময়েই উন্নতমানের মিলিটারি প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য পশ্চিম জার্মানির উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন তিনি। পরের বছরই পাকিস্তানে ফিরে এসে সেনাবাহিনীর মেজর পদে উন্নীত হন জিয়াউর রহমান। ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে চট্টগ্রামে অবস্থানরত চতুর্থ পূর্ববঙ্গ রেজিমেন্টের সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড হিসেবে বদলি হয় তাঁর। ১৯৭০ সালেই একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে পূর্ব পাকিস্তান বিধ্বস্ত হয়ে যায়, কিন্তু সেই সময় শেখ মুজিবর রহমানের আওয়ামী লীগ এবং জুলফিকার আলি ভুট্টোর পিপিপি দলের মধ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষের বাতাবরণ তৈরি হয়। ঐ বছরই পাকিস্তান সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, শেখ মুজিবর রহমান নতুন সরকার গঠনে উদ্যোগী হন। কিন্তু জুলফিকার আলি ভুট্টোর চাপে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান আইনসভা স্থগিত রাখেন। এই পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুজিবর রহমানকে গ্রেপ্তার করে মধ্যরাতেই নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। এই ঘটনায় জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সরকারের বিরোধিতা করেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর পরবর্তী কমাণ্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট জানজুয়াকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের পুলিশ। শেখ মুজিবের গ্রেপ্তারের আগে চট্টগ্রামের কয়েকজন আওয়ামী লীগ সমর্থক জিয়াউরকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করতে অনুরোধ করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে বেতার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন।

১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন জিয়াউর রহমান। পরের বছর পুনরায় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন তিনি। সেই সময় বাংলাদেশ নিরক্ষরতা, দারিদ্র্য, দীর্ঘস্থায়ী বেকারত্বের সমস্যায় দীর্ণ ছিল। আর্থিক স্বাধীনতার কথা বলে তিনি একটি ১৯ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করেন যা গ্রামীণ উন্নয়ন, মুক্ত বাজার অর্থনীতি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং বিকেন্দ্রীকরণের উপর জোর দেয়। বাংলাদেশে ধান ও পাট গবেষণাকেন্দ্র চালু করেছিলেন তিনি। বেসরকারি খাতের উন্নয়ন, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং খামারের একত্রীকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নতি করতে চেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। প্রথম দিকে বাংলাদেশ ভারতের উপর অনেকাংশে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল ছিল, সেই নির্ভরতা কাটিয়ে উঠে নতুন এক পররাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী জিয়াউর রহমান সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের পরিবর্তে চীন, আমেরিকা আর সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিকে সংঘবদ্ধ করার তাগিদে ১৯৮৫ সালে নির্মিত ‘সার্ক’ (SAARC)-এর পিছনে তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী ব্যক্তি শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী এবং জাতীয় সংসদের নেতা হিসেবে নির্বাচিত করা হয় তাঁর শাসনকালে যা জিয়াউর রহমানের একটি অন্যতম বিতর্কিত পদক্ষেপ। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি (BNP) সেকালের বাংলাদেশে অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মর্যাদা পায়। তাঁর ক্ষমতায় আসার পরেই বাংলাদেশে বহুদলীয় রাজনীতির সূত্রপাত হয়।

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমানকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়।             

9 comments

আপনার মতামত জানান