আব্দুস সাত্তার

আব্দুস সাত্তার

বাংলাদেশের রাজনীতি যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামী ইতিহাস অতিক্রম করে এবং রাজনৈতিক জটিলতার আবর্তের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেছে, সেই রাজনৈতিক ইতিহাসের এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার (Abdus Sattar)। আইন অধ্যয়ন করে অবিভক্ত ভারতবর্ষের কলকাতায় আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও দেশভাগের পর বাংলাদেশে চলে এসে তৎকালীন রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী এ. কে ফজলুল হকের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের বহু প্রসাশনিক উচ্চপদের দায়িত্ব তিনি সামলেছিলেন দক্ষ হাতে। পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য ছাড়াও পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন সাত্তার। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে যেমন জড়িত ছিলেন তিনি, তেমনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি। জিয়াউর রহমান তাঁকে বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের হত্যার পর অসুস্থ অবস্থাতেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তিনিই একমাত্র সহ-সভাপতি ছিলেন যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে উন্নীত হন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের জাতীয়বাদী দলের সভাপতি নির্বাচিত হন সাত্তার। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠনের মতো কাজের জন্য তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় আজও।

১৯০৬ সালের ১ মার্চ ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত বীরভূম জেলার দারকা গ্রামে আব্দুস সাত্তারের জন্ম হয়। তাঁর বাবা সফিউর রহমান (Safiur Rahaman) ছিলেন একজন কৃষিজীবী মানুষ।

প্রাথমিক স্তরের পড়াশোনার জন্য সাত্তার স্থানীয় গুটুনিয়া স্কুলে ভর্তি হন। সেখানকার পাঠ সমাপ্ত করে তিনি লাভপুরের যাদবলাল হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন উচ্চস্তরের শিক্ষালাভের জন্য। এরপর আরও উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতা শহরে। সেখানে এন্টালি অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন অধ্যয়নের জন্য এবং সেই প্রতিষ্ঠান থেকেই সাত্তার স্কুল ফাইনালে উত্তীর্ণ হন সফলভাবে। কিন্তু কেবলমাত্র স্কুলস্তরের শিক্ষাতেই সন্তুষ্ট থাকবার মানুষ ছিলেন না সাত্তার। কলকাতা মহানগরীতে তখন ভারতবর্ষের অন্যতম বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির অবস্থান। স্কুল শেষ করার পরে প্রথমে তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং পরবর্তীকালে সেখান থেকে বেরিয়ে ঐতিহ্যশালী প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন স্নাতক স্তরের পড়াশোনার জন্য। স্নাতকে তাঁর বিষয় ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। এই বিষয় নির্বাচন থেকেই বুঝতে পারা যাবে রাজনীতি বিষয়ে তাঁর আগ্রহ কতখানি প্রবল ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরে ১৯২৮ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি পরবর্তী পড়াশোনার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন আইনকে। রাজনীতির সঙ্গে আইনের সম্পর্ক যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা বলাই বাহুল্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আইন নিয়ে পড়াশোনা করে ১৯২৯ সালে বি.এল ডিগ্রি অর্জন করেন আব্দুস সাত্তার।
আইন পাশ করবার পরে প্রথমে কলকাতা জজ কোর্টের বারে এবং পরবর্তীকালে ১৯৪১ সালে কলকাতা হাইকোর্টের বারে যোগ দিয়েছিলেন আব্দুস সাত্তার। বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী এ. কে ফজলুল হকের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। ফজলুল হকের সঙ্গে কৃষক প্রজা পার্টির কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে যোগদান করেন তিনি। এসময় কলকাতার বিভিন্ন পৌরসভার দায়িত্ব পালন করেন সাত্তার। পৌর আইন বিশেষজ্ঞ ফজলুল হকের চেম্বারে জুনিয়র হিসেবেই কলকাতা হাইকোর্টের বারে যোগদান করেছিলেন তিনি। এছাড়াও ১৯৩৯ সালে কলকাতা সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ১৯৪০-৪২ সালে কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাইবুন্যালের সদস্য এবং ১৯৪৫ সালে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সাত্তার।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৫০ সালে ভারত বিভাগের পর আব্দুস সাত্তার পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা শহরে চলে আসেন এবং ঢাকা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৩ সালে তিনি ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যোগদান করেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন আব্দুস সাত্তার। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইব্রাহিম ইসমাইল চন্দ্রিগারের মন্ত্রীসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী  হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। ১৯৫৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন এবং ১৯৬৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ঠিক তার পরের বছর ১৯৭০ সালে সংঘটিত ঐতিহাসিক পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন আব্দুস সাত্তার। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল সরকার গঠনের জন্য।

সেই সময়টা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। জুলফিকার আলি ভুট্টোর সঙ্গে মুজিবর রহমান ক্ষমতা ভাগাভাগির ব্যবস্থা গ্রহণ করে আপোস করতে অস্বীকার করলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৯৭১ সালের মে মাসে সাত্তারকে পশ্চিম পাকিস্তানের ইসলামাবাদে ডেকে পাঠায় পাকিস্তান সরকার। পাকিস্তান সরকারের হয়ে কাজ করতে, সেবা করতে অস্বীকার করায় সাত্তারকে গৃহবন্দী করে রাখা হয় ইসলামাবাদে। তাঁকে সমস্ত সরকারি পদ থেকেও অপসারণ করা হয়। ১৯৭৩ সালে আফগানিস্তানে আটকে পড়া বাঙালি কর্মকর্তাদের প্রত্যাবাসনের (Repatriation) অংশ হয়ে বাংলাদেশে ফিরে গিয়েছিলেন সাত্তার। মুজিবর রহমান তাঁকে আওয়ামী লীগের নবগঠিত সরকারে যোগদান করার প্রস্তাব দিলে তিনি তা সম্মানের সঙ্গেই প্রত্যাখান করেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে সদ্য স্বাধীন দেশকে কোনো উপায়ে সেবা দেওয়ার জন্য, তিনি বাংলাদেশ জীবন বীমা কর্পোরেশন, সাংবাদিক মজুরি বোর্ড এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ল’ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে সম্মত হন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সামরিক অভ্যুত্থানের পর সাত্তারকে রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের বিশেষ উপদেষ্টা এবং তৎকালীন আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে নতুন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান সাত্তারকে বাংলাদেশের সহ-সভাপতি নিযুক্ত করেন তিনি। এরপর ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের বিজয়ের পর, তাঁরই অনুরোধে সাত্তার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গড়ে তোলার আহ্বান জানান এবং সেবছরই সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে দেশের অন্যতম বৃহত্তর রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠে বিএনপি।

জিয়াউর ও সহ সভাপতি সাত্তারের অধীনে বাংলাদেশের প্রভূত অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে। দুর্নীতি মোকাবিলারও চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। সাত্তারের তত্ত্বাবধানে বিএনপি একটি কার্যকর রাজনৈতিক যন্ত্রে পরিণত হয়। ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, নারী ও কৃষকদের মধ্যে এই দলের শাখা ও সহযোগী সংগঠনগুলি ছড়িয়ে পড়ে। সাত্তারের নেতৃত্বে এই কার্যকরী দলীয় সংগঠন জিয়াউরকে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে  বিজয় এনে দিয়েছিল।

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর কর্তৃক প্ররোচিত একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হলে আব্দুস সাত্তার বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জিয়াউরের মৃত্যুর ১৮০ দিনের মধ্যে সংবিধান মেনে এক নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছিল। সেসময় দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়। ২১ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনের তারিখটি ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হয় কারণ বিরোধী দলগুলি প্রচারের জন্য আরও সময় দাবি করেছিল। জিয়াউর হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ১২ জন সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলে দেশজুড়ে সহিংস প্রতিবাদ দেখা দেয়। বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে আব্দুস সাত্তার ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হন। নির্বাচনে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কামাল হোসেন। তখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের একমাত্র বেসামরিক রাষ্ট্রপতি ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী কীভাবে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে তা অন্বেষণ করতে সাত্তার একটি জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করেন। ১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সভাপতি নির্বাচিত হন।

এরপর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে সক্ষম হন। এরশাদ সাত্তারের সরকারের বিরুদ্ধে অযোগ্যতার অভিযোগ আনেন এবং সামরিক শাসনকালের ইতিহাস স্মরণ করে দাবি করেন দেশকে বাঁচানোর দক্ষতা কেবল সেনাবাহিনীরই রয়েছে। এই সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অপসারিত হয়েছিলেন। ২৪ মার্চ সকালে, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রধান এবং সামরিক সচিব বঙ্গভবনে প্রবেশ করেন এবং সাত্তারকে ক্ষমতা ত্যাগের বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন।

১৯৮৫ সালের ৫ অক্টোবর ৭৯ বছর বয়সে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে হৃদযন্ত্র ও বৃক্কের সমস্যাজনিত কারণে আব্দুস সাত্তারের মৃত্যু হয়।

One comment

আপনার মতামত জানান