দুর্গাপুজোর প্রসঙ্গে অকালবোধনের নাম শুনেছেন অনেকেই। রামচন্দ্রের শরৎকালে দুর্গাপূজার সঙ্গে জড়িত সেই পৌরাণিক অকালবোধনের কাহিনী। বসন্তকালের পরিবর্তে শরৎকালে পূজা হয়েছিল বলে তাকে অকালবোধন বলা হয় অর্থাৎ কিনা যা উপযুক্ত সময়ে হয় না। সেইরকমই অকাল বিশ্বকর্মা! সকলেই জানি ভাদ্রসংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকর্মাপুজো । সেই স্বর্গের কারিগর বিশ্বকর্মার বাহন হল হাতি। কিন্তু পৌষ মাসের শুক্লপক্ষের নির্দিষ্ট দিনে ঘোড়ার পিঠে চেপে পূজিত হন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। অবাক হচ্ছেন? কিন্তু বহু বছর ধরে এভাবেই অকাল বিশ্বকর্মারপুজোয় মেতে ওঠেন হুগলির ধনিয়াখালি, চণ্ডীতলার বেগমপুর অঞ্চলের তাঁতি সম্প্রদায়ের মানুষেরা। আবার অনেক জায়গায় সরস্বতীর পুজোর দিনে বসন্তপঞ্চমীতেও বিশ্বকর্মা পূজিত হন মহাসমারোহে। এইসব অকাল বিশ্বকর্মা পূজা ব্যতিক্রম হলেও এর নিজস্ব কিছু ইতিহাস রয়েছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেইসব গোপন ইতিহাস।
সাধারণভাবে এই বিশ্বকর্মাপুজোই একমাত্র উৎসব যা প্রতি বছর একেবারে নির্দিষ্ট দিনেই হয়ে থাকে। প্রায় প্রতি বছরই ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা পূজিত হন। কিন্তু এই দিনের বাইরেও পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গায় পৃথকভাবে বিশ্বকর্মার পুজো করা হয়। সেইগুলিই অকাল বিশ্বকর্মা। হুগলির ধনিয়াখালি, চণ্ডীতলার বেগমপুরে অকাল বিশ্বকর্মা পূজিত হন পৌষ মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে। ভাদ্র সংক্রান্তির বদলে একেবারে পৌষ মাসে বিশ্বকর্মা পূজিত হন এখানে, তাও সর্বত্র নয়। এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এখানকার তাঁতি সম্প্রদায়ের মানুষ। বহুদিন ধরে এখানকার তাঁতিদের ঘরে ঘরে মাকুর খট্খট্ শব্দে তাঁত বোনা হয়ে চলে। পৌষ মাসের প্রায় চারদিন ধরে অকাল বিশ্বকর্মা পুজোয় তাঁত বন্ধ থাকে এই এলাকার তন্তুবায়দের ঘরে। বেগমপুরের তিনটি গ্রাম বেগমপুর, ছোটো তাজপুর এবং খড়সরাইতে হাতে চালানো তাঁত এখনও বিখ্যাত। আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে এখানে পৌষমাসে বিশ্বকর্মা পুজো শুরু হয়। মহালয়ার আগে বিশ্বকর্মা পুজো আগে এখানেও হতো কিন্তু দুর্গাপুজার কারণে কাপড় তৈরির চাপ থাকায় সেই পুজোয় সমারোহ থাকতো না বেশি। তাই এই বিশেষ সময়ে বিশ্বকর্মা পুজোর প্রচলন হয়। এই বিশ্বকর্মার বাহন ঘোড়া। এর কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন, তাঁতের মাকুর শব্দের সঙ্গে ঘোড়ার খুরের মিল থাকায় বিশ্বকর্মার বাহন হাতি থেকে বদলে গিয়ে ঘোড়ার রূপ নিয়েছে। তাঁতের শোলার উপর ঘোড়া রেখে এখানে পুজো হয় যা প্রায় একশো বছরের পুরনো রীতি। প্রাচীনকালে মূর্তিকে পুজো করা হতো না, ৫০-৬০ বছর আগে এখানে মূর্তিপূজার প্রচলন করা হয় বলে জানা যায়। তাঁতিদের বিশ্বাস তাঁত শিল্পের এই অবনমনের সময়ে বিশ্বকর্মার আরাধনার মধ্য দিয়ে তাঁরা আবার সুদিন দেখতে পাবেন। একদিকে বেড়েছে সুতোর দাম, বাজারে তাঁতের বিকল্পও চলে এসেছে, আবার যন্ত্রচালিত তাঁতের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় সঙ্কটের মুখে এই বেগমপুরের তাঁতিরা, তাই বছরের এই একটি দিনে অকাল বিশ্বকর্মার পুজোতেই আনন্দ খুঁজে পান তন্তুবায়রা। এই পুজোর পর থেকে তন্তুবায়রা পরবর্তী বছরের দুর্গাপুজোর জন্য তাঁতের কাপড় তৈরি শুরু করেন।
একইভাবে পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডি, ঝালদা প্রভৃতি অঞ্চলে দেখা যায় সরস্বতী পুজোর দিনে বিশ্বকর্মা পুজো হয়ে থাকে। এলাকার মৃৎশিল্পীরা মুলত এই পুজো করে থাকেন। ভাদ্রমাসের মূল বিশ্বকর্মা পুজোর সময় বেশিরভাগ শিল্পীই মূর্তি তৈরির জন্য বাইরে থাকেন কাজের সূত্রে। ফলে এই সময়েই তাঁরা নিজেদের উদ্যোগে বিশ্বকর্মা পুজো করে থাকেন। শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে শ্বেতবসনা দেবী সরস্বতীর সঙ্গেই দেবশিল্পীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দুই ধরনের পুজোই হয়ে থাকে পৌষ মাসে। একটি শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে, আর একটি পঞ্চমী তিথিতে। পশ্চিমবঙ্গের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে মৃৎশিল্পী এবং তাঁতশিল্পীদের এই ঐতিহ্যবাহী অকাল বিশ্বকর্মা পুজো সত্যই বিস্ময়কর!