আনন্দীবাই গোপাল রাও জোশি

আনন্দীবাই গোপালরাও জোশি এবং কাদম্বিনী বসু গাঙ্গুলী ছিলেন ভারতের প্রথম ভারতীয় মহিলা চিকিৎসক যাঁরা পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে প্র্যাকটিস করার যোগ্যতা অর্জন করেন। বোম্বে প্রেসিডেন্সি থেকে তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যায় স্নাতক হওয়ার লক্ষ্যে আমেরিকা গমন করেছিলেন।

১৮৬৫ সালের ৩১ মার্চ ব্রিটিশ ভারতের মহারাষ্ট্রের অন্তর্গত থানে জেলার কল্যাণ গ্রামে এক রক্ষণশীল মারাঠা ব্রাহ্মণ পরিবারে আনন্দীবাই গোপাল রাও জোশি ‘র জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম ছিল গণপতরাও অম্রুতেশ্বর জোশি। ছোটোবেলায় আনন্দীবাই’র নাম ছিল যমুনা। বিয়ের পর তাঁর নাম হয় আনন্দীবাই। ১৮৭৪ সালে মাত্র ন’বছর বয়সে বিপত্নীক গোপালরাও বিনায়ক জোশি’র সাথে তাঁর বিয়ে হয়। বয়সের দিক থেকে গোপালরাও আনন্দীর চেয়ে প্রায় কুড়ি বছরের বড় ছিলেন। তিনি নিজে ছিলেন ডাক বিভাগের কেরানী। তবে সেই যুগে দাঁড়িয়ে গোপালরাও বেশ উদারমনস্ক এবং সময়ের তুলনায় আধুনিক চিন্তাভাবনায় এগিয়ে থাকা মানুষ ছিলেন। তিনি নারী শিক্ষাকে সমর্থন করতেন। 

কোলাপুরে কিছুদিনের জন্য আনন্দীবাই স্বামীর সহযোগিতায় পড়াশোনা করেন। এ কথা শোনা যায় আনন্দীবাই পড়াশোনা ফেলে রান্নাঘরে গেলে গোপালরাও তাঁকে মারধর করতেন। তৎকালীন সমাজের সম্পূর্ণ বিপরিতে গিয়ে স্ত্রীকে শিক্ষিত করার এই প্রয়াস পরিবারের লোকজন ও প্রতিবেশীরা ভাল চোখে নিল না। প্রবল সমালোচনায় বিদ্ধ গোপাল ঠিক করলেন এলাকা ছেড়েই চলে যাবেন। চোদ্দ বছর বয়সে আনন্দী পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু চিকিৎসায় ত্রুটির কারণে মাত্র দশদিনের মাথায় সেই সন্তানের মৃত্যু হয়। প্রথম সন্তানের এই আকস্মিক মৃত্যু আনন্দীকে নাড়িয়ে দেয় ভেতর ভেতর। এরপরেই আনন্দী চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করবেন বলে মনস্থির করেন। গোপালরাও কলকাতায় বদলি হয়ে আসার পর আমেরিকান মিশনারি রেভারেন্ড ওয়াইল্ডারকে চিঠি লেখেন স্ত্রীর পড়াশোনা ও আর্থিক সাহায্যের কথা জানিয়ে।সাথে এও জানিয়ে রাখেন তিনিও স্ত্রীর সাথে আমেরিকা যেতে চান। চিঠিটি ‘প্রিন্সটন’স মিশনারি রিভিউ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে নিউ জার্সির থিয়োডিসিয়া কার্পেন্টার নামে এক মহিলার তা চোখে পড়ে এবং তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

কলকাতায় থাকাকালীন আনন্দীবাইয়ের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। এর মধ্যে গোপালরাও ১৮৮৩ সালে শ্রীরামপুরে বদলি হয়ে গেলে ও আনন্দীবাইকে একাই আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ আনন্দীবাঈয়ের বিদেশ যাত্রার বিরোধিতা করে। বাধ্য হয়ে আনন্দী শ্রীরামপুরে একটি সভায় ভারতে হিন্দু মহিলা চিকিৎসকের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। ‘কেশরী’ পত্রিকার সম্পাদক তখন বাল গঙ্গাধর তিলক। তিনি আনন্দী’র ডাক্তারি পড়তে যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানতে পেরে চিঠি লিখেছিলেন, ”আমি জানি, নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে কেমন করে আপনি বিদেশে গিয়েছেন এবং অধ্যবসায়ের সঙ্গে জ্ঞানার্জন করছেন। আমাদের দেশে আধুনিক যুগে আপনি এক মহান নারী। জানতে পারলাম, আপনার এখন অর্থের প্রয়োজন। আমি এক পত্রিকার সম্পাদক। আয় বেশি নয়। তবু আপনাকে ১০০ টাকা পাঠাতে চাই।” অবশেষে আমেরিকা পোঁছানোর পর মিসেস কার্পেন্টার আনন্দীবাইকে ভর্তি করে দেন পেনসিলভেনিয়া মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলেন। অসুস্থ শরীর উপেক্ষা করেই রাত-দিন পড়াশোনা চালিয়ে যান তিনি। তিনি তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে তথ্য সূত্র হিসেবে আয়ুর্বেদ ও আমেরিকান চিকিৎসা শাস্ত্র থেকে বিভিন্ন তথ্য ব্যবহার করেছিলেন। অবশেষে ১৮৮৬ সালে আনন্দীবাই গোপাল রাও জোশি ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার হলেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘Obstetrics among the Aryan Hindoos’। আনন্দীবাইকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়াও।

দেশে ফিরে আনন্দী কোলাপুরের কিং অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড হাসপাতালে যোগ দেবার আমন্ত্রণ পান। এর কিছুদিনের মধ্যেই আনন্দী অসুস্থ হয়ে পড়েন ও ঐ হাসপাতালেই ভর্তি হন। কিন্তু কালাপানি পেরিয়ে এসেছেন বলে তাঁর সহকর্মী চিকিৎসকরা আনন্দী’র চিকিৎসা করতে রাজি হননি। ১৮৮৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কোলাপুরের কিং অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড হাসপাতালে প্রায় বিনা চিকিৎসায় আনন্দীবাই গোপাল রাও জোশি ‘র মৃত্যু হয়।

১৮৮৮ সালে ক্যারোলিন হেলি ডান আনন্দীবাই গোপাল রাও জোশি ‘র জীবনী লেখেন। মৃত্যুর পর 
আনন্দীবাইয়ের অস্থিভষ্ম থিওডোরা কার্পেন্টারের কাছে পাঠানো হয়। তিনি ওই চিতাভষ্ম নিজের পরিবারের সমাধির সঙ্গে রেখে দেন।

3 comments

আপনার মতামত জানান