পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার পাপহরা নদীর তীরে বক্রেশ্বর মন্দির অবস্থিত। এটি একান্ন সতীপীঠের একটি পীঠ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে দেবী সতীর দুই ভ্রুর মধ্যবর্তী স্থান এখানে পতিত হয়েছিল। আবার মতান্তরে বলা হয়ে থাকে এখানে দেবীর তৃতীয় নয়ন পড়েছিল। বক্রেশ্বরের অধিষ্ঠিত দেবী হলেন মহিষাসুরমর্দিনী। আর এখানের ভৈরব হলেন বাবা বক্রেশ্বর বা বক্রনাথ।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। বলা হয় দেবী সতীর দুই ভ্রুর মধ্যবর্তী স্থান এখানে পতিত হয়েছিল। আবার মতান্তরে বলা হয়ে থাকে এখানে দেবীর তৃতীয় নয়ন পড়েছিল।
বক্রেশ্বর জায়গাটির সাথে অষ্টাবক্র মুনির জন্ম কাহিনী জড়িয়ে আছে। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী এই জায়গাটি আগে জঙ্গলে পূর্ণ ছিল এবং এখানে হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার ছাড়া কারুর বসবাস ছিল না। তখন এই জায়গাটির নাম ছিল “ডিহি’। অষ্টাবক্র মুনির মায়ের নাম সুজাতা দেবী ও বাবার নাম কহোর মুনি, যিনি বেদজ্ঞানে খুব পারদর্শী ছিলেন। অষ্টাবক্র যখন মায়ের গর্ভে ছিলেন তখন তার বাবা তার মাকে রোজ বেদপাঠ করে শোনাতেন। গর্ভে থাকাকালীন রোজ বেদপাঠ শুনে তিনি জন্মের আগেই বেদ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছিলেন। এইরকমই একদিন কহোর মুনি তার স্ত্রী কে বেদ পাঠ করে শোনাচ্ছিলেন,তখন তার গর্ভস্থ সন্তান বলে উঠে “বাবা আমি আপনার থেকে প্রতিদিন বেদপাঠ শুনে এই শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করেছি,আজ আপনি অন্যমনস্ক হয়ে ভুল বেদপাঠ করছেন,আমি বুঝতে পেরে আপনাকে জানাচ্ছি।”এই কথা শুনে মুনি খুব অপমান বোধ করেন এবং তার গর্ভস্থ সন্তানকে অভিশাপ দেন তার অষ্টাঙ্গ বিকৃত হোক। এর পর সেই সন্তান শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন ও তার নাম হয় অষ্টাবক্র।
এই ভাবে দিন কাটতে থাকে। সেই সময় জনক নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি তার রাজ সভায় শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের আহ্বান জানিয়ে ছিলেন ও ঘোষণা করেছিলেন যে তাকে শাস্ত্র বিষয়ে নানা জ্ঞান শুনিয়ে খুশি করতে পারবে তার আর অভাব থাকবে না। এই ঘোষণা শুনে কহোরমুনি অভাবের তারণা থেকে মুক্তি পেতে সেই রাজসভায় উপস্থিত হন। পরে রাজার সভাপণ্ডিতের কাছে পরাজিত হয়ে তারই সেবায় কহোরমুনিকে নিযুক্ত করা হয়। তিনি সেই রাজসভায় বন্দি হয়ে যান। কালের নিয়মে সময় এগিয়ে যায় আর কোহরমুনির ছেলে বড় হতে থাকে। অষ্টাবক্র মাত্র বারো বছর বয়সেই সর্বশাস্ত্র বিষয়ে পণ্ডিত হয়ে ওঠেন। বড় হয়ে মা সুজাতার কাছে বাবার বন্দীদশার কথা শুনে অষ্টাবক্র সেই রাজার দরবারে উপস্থিত হয়। কিন্তু রাজসভায় প্রবেশে বাধা পেলে বালক অষ্টাবক্র পন্ডিতের সাথে তর্কযুদ্ধে তাদের আহবান জানায় এবং সভায় উপস্থিত সবাইকে তর্কে পরাজিত করে তার পিতা কোহরমুনিকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে আনেন।
সন্তানের এই সাফল্যে মুনি খুব খুশি হন এবং আশীর্বাদ করেন “সমঙ্গ “নদীর জলে স্নান করে তার অঙ্গবিকৃতি দূর হবে। “সমঙ্গ” অর্থাৎ সমান গতিতে বয়ে চলে যে নদী। এইরকম জলাধারের খোঁজ করতে করতে অষ্টাবক্র “ডিহি “নামক গ্রামে এসে হাজির হন। এইখানে ঘুরতে ঘুরতে পূর্বদিকে জঙ্গলের মধ্যে তিনি আটটি কুণ্ডের সন্ধান পান। তিনি লক্ষ করেন তার মধ্যে সাতটি কুণ্ডের জল গরম এবং একটি কুণ্ডের জল ঠান্ডা। তিনি এই কুণ্ডের জল যেখানে এসে মিশছে, সেখানের জলে স্নান করেন। ফলে তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দূর হয়।
আবার অন্য একটি জনশ্রুতি অনুযায়ী এই জঙ্গল থেকেই তিনি একটি শিবলিঙ্গের সন্ধান পান ও এই লিঙ্গের সামনে গভীর সাধনায় মগ্ন হন। এইভাবে অনেক বছর তিনি শিবের কঠিন সাধনা করেছিলেন,তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাকে শারীরিক বিকৃতি থেকে মুক্তি লাভের বর দিয়েছিলেন। পরে অষ্টাবক্রের নামানুসারে সেই শিবলিঙ্গের নামকরণ হয় বক্রনাথ, এবং ডিহি গ্রাম বক্রেশ্বর নামে পরিচিতি পায়।
বাবা বক্রেশ্বরকে কেন্দ্র করে এখানে আরো পাঁচটি শিবলিঙ্গ রয়েছে। সেগুলি হলো- কুবেরেশ্বর, সিদ্ধেশ্বর, জোতিলিঙ্গেশ্বর, কালারুদ্রশ্বর ও জম্ভশ্বর। আর এই সব মন্দিরের পাশে পাশেই রয়েছে এই উষ্ণ জলকুন্ডগুলি। সেগুলি হল:- ভৈরবকুন্ড, ক্ষারকুন্ড, অগ্নিকুন্ড, জীবৎসকুন্ড, সৌভাগ্যকুন্ড, সূর্যকুন্ড, ব্রহ্মাকুন্ড এবং শ্বেতকুন্ড। এই কুন্ডগুলির পিছনেও একটি করে পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে।
দেবী মহিষমর্দিনীর মূর্তিটি পিতলের ও মূর্তির রূপটি দশভূজা দুর্গার। যারা ওখানে সেবায় আছে তাদের থেকে জানা যায় এই পিতলের দশভূজার মূর্তির নিচে একটি গর্তের ভিতরে মায়ের দেহাংশটি রাখা আছে। ইতিহাসবিদদের মতে এই পীঠে আগে অন্য দেবীমূর্তি ছিল। সুলতান সেনাপতি কালাপাহাড়ের আক্রমণের কারনেই মা দুর্গার আঠারো হাত মূর্তিটিকে পুকুরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। অনেক পরে বর্তমান মন্দির থেকে দূরে “ধরমগড়” নামক জায়গায় আচার্যদের দুর্গামন্দির সংলগ্ন পুকুর থেকে একটি পাথরের আঠারোহাত মূর্তি উদ্ধার হয়েছিল। আচার্য পরিবারের সদস্যরা বক্রেশ্বরের সেবাইতও বটে। তাদের মতে শক্তি পীঠের আসল মূর্তি এটাই। হরেকৃষ্ণ মুখেপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, বাংলা ১৩২২ সালে মূর্তিটি উদ্ধার হয়েছে। দীর্ঘ দিন মটির নীচে থাকায় মূর্তিটি কিছুটা ক্ষয়প্রাপ্ত ঠিকই তবে সেটা অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। মূর্তির নীচে ও উপরে চালচিত্রাকারে কৌমরী, ইন্দ্রাণী, বৈষ্ণবী, বারাহী-সহ নয়টি শক্তিমূর্তি রয়েছে।
তথ্যসূত্র
- একান্ন পীঠ, হিমাংশু চট্টোপাধ্যায়, দীপ প্রকাশন, পৃষ্ঠা ১০৪, শ্মশানতীর্থ বক্রেশ্বর
- https://bn.wikipedia.org/wiki/বক্রেশ্বর
- https://www.anandabazar.com/district/purulia-birbhum-bankura/বক্রেশ্বর
- https://www.templepurohit.com/hindu-temple/bakreswar-temple-west-bengal/
- https://www.thedivineindia.com/51-shakti-peeths/
2 comments