বাংলা সাহিত্যের জগতে অন্যতম বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (Balai Chand Mukhopadhyay)। বলাইচাঁদ তাঁর আসল নাম হলেও তিনি ‘বনফুল’ নামেই সমধিক পরিচিত। তাঁর লেখা উপন্যাস অবলম্বনে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মৃণাল সেন নির্মাণ করেন ‘ভুবন সোম’ ছবিটি যেখানে উৎপল দত্তের অভিনয় দর্শকমনে আলোড়ন তুলেছিল। তাঁর উপন্যাস ‘অগ্নীশ্বর’-এর চলচ্চিত্ররূপে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন উত্তমকুমার। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। পেশায় ডাক্তার হলেও সাহিত্যচর্চা আর পাখি দেখাই তাঁর জীবনের অন্যতম দিক ছিল। ব্যক্তিজীবনের নানা অভিজ্ঞতা বলাইচাঁদ সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর লেখায়। এই অসামান্য কথাসাহিত্যিককে ভারত সরকার তাঁর সারাজীবনের সৃজনশীল প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কারে সম্মানিত করে। তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে ভারতীয় ডাকবিভাগ তাঁর সম্মানসূচক একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
১৮৯৯ সালের ১৯ জুলাই বিহারের পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী গ্রামে বলাইচাঁদ মুখ্যোপাধায়ের জন্ম হয়। তাঁর বাবা সত্যচরণ মুখ্যোপাধায় ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার ও সমাজসেবক। মূলত তাঁরই উদ্যোগে তাঁদের মণিহারী গ্রামে ‘মনিহারী প্রাথমিক বিদ্যালয়’ স্হাপিত হয়। সত্যচরণের আদি নিবাস হুগলী জেলার শিয়াখালায়, কিন্তু তিনি বিহারের পূর্ণিয়াতেই ডাক্তারি শুরু করেছিলেন। শিয়াখালায় তাঁদের আদি ভিটের আশেপাশে ছিল প্রচুর কাঁটাঝোপ। সেই কারণে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় এর পরিবার ‘কাঁটাবুনে মুখুজ্জ্যে’ নামেও পরিচিত ছিলেন। বলাইচাঁদের মায়ের নাম মৃণালিনী দেবী। সত্যচরণ ও মৃণালিনী দেবীর ছয় সন্তানের মধ্যে বলাইচাঁদ ছিলেন প্রথম সন্তান। বলাইচাঁদের সবচেয়ে ছোট ভাই ছিলেন বাংলা সিনেমার বিখ্যাত পরিচালক অরবিন্দ মুখ্যোপাধায়। ছোটবেলায় তাঁদের বাড়ির মুসলমান মজুর চামরুর স্ত্রী বলাইকে ‘জলিংবাবু’ বলে ডাকতেন আর শৈশবে বলাইচাঁদও তাঁকে ‘দুধ-মা’ বলে ডাকতেন। তাঁর কাছ থেকেই প্রকৃতির সান্নিধ্যে বলাইয়ের বড় হওয়া এবং প্রকৃতিতে চিনতে শেখা যা তাঁর কবিসত্তাকে বিকশিত করতে সাহায্য করেছিল। ভীষণ একগুঁয়ে ও রাশভারী বলাইচাঁদ ছিলেন অসম্ভব খাদ্যরসিক। পরবর্তীকালে ১৯২৭ সালে বলাইচাঁদ বেথুন কলেজের ছাত্রী ও সারদাদেবীর স্নেহধন্যা লীলাবতীর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁদের চার সন্তান জন্ম নেয়।
বাড়িতে তারাপদ পণ্ডিতের কাছে বলাইচাঁদ মুখ্যোপাধায়ের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। পরে তিনি মণিহারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপরে সপ্তম শ্রেণিতে সাহেবগজ্ঞের রেলওয়ে স্কুলে ভর্তি হয়ে এই স্কুল থেকে তিনি ১৯১৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থানে উত্তীর্ণ হন। এরপরে হাজারিবাগ সেন্ট কলম্বাস স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯২০ সালে দ্বিতীয় বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় এবং তারপর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন তিনি। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় আশুতোষ মুখ্যোপাধায়, শিশির ভাদুড়ির মতো ব্যক্তিত্বদের সংস্পর্শে আসেন বলাইচাঁদ যাঁদের প্রভাব তাঁর সাহিত্যজীবনেও পড়েছিল। কলকাতায় ছয় বছর পড়াশোনা করার পরে ১৯২৭ সালে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় বিহারের পাটনা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকেই তিনি এমবিবিএস পাশ করে ভাগলপুরে ডাক্তারি করতে শুরু করেন তিনি।
১৯২৭ সালে বলাইচাঁদ মুখ্যোপাধায় পাটনা মেডিকেল কলেজের হাউসস্টাফ হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু সেখানকার পরিবেশ পছন্দ না হওয়ায় চাকরিটি ছেড়ে দিয়ে তিনি একটি প্যাথোলজি ল্যাবরেটরির চাকরিতে যোগ দেন। ১৯২৮ সালে মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জ মেডিকেল কলেজের মেডিকেল অফিসার হয়ে কিছুদিন কাজ করার আবার তিনি ভাগলপুরের খালিফাবাগে নিজে একটি ল্যাবরেটরি স্হাপন করে স্বাধীনভাবে কাজ করতে থাকেন। দীর্ঘ চল্লিশ বছর ভাগলপুরের সেই ল্যাবে ডাক্তারি করেছেন বলাইচাঁদ। তাঁর চরিত্রের স্বাধীনতাচেতা মনোভাব এবং আত্মসম্মানবোধ যথাযথভাবে পরিস্ফুট হয়েছে তাঁর লেখা ‘অগ্নীশ্বর’ উপন্যাসের অগ্নীশ্বর চরিত্রটির মধ্যে। শুধু লেখা বা ডাক্তারি নয়, ছবি আঁকা, তারা দেখা ও পাখি চেনাও ছিল তাঁর অন্যতম শখ।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় এর সাহিত্যকর্ম বিপুল বিস্তৃত এবং পাঠকমহলে খুবই জনপ্রিয়। তিনি প্রায় এক হাজার কবিতা, পাঁচশো ছিয়াশিটি ছোটগল্প এবং বহু উপন্যাস ও নাটক লিখেছেন। কবিতার মধ্যে তাঁর লেখা একশো ন’টি ব্যঙ্গাত্মক কবিতা নিয়ে ‘বনফুলের ব্যঙ্গকবিতা’ প্রকাশিত হয়। স্কুল জীবনে হাতে লিখে তিনি ‘বিকাশ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। ১৯১৫ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন ‘মালঞ্চ’ পত্রিকায় বলাইচাঁদের লেখা প্রথম একটি কবিতা প্রকাশ পায়। সকলের উৎসাহ থাকলেও স্কুলের প্রধানশিক্ষক রামচন্দ্র ঝাঁয়ের প্রবল আপত্তি ছিল বলাইয়ের কবিতা লেখা নিয়ে। মূলত তাঁর চোখকে ফাঁকি দিতেই অগ্রজ সুধাংশুশেখর মজুমদারের পরামর্শে ‘বনফুল’ ছদ্মনামে লিখতে শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে বলাইচাঁদ মুখোপাধায়ের এই ছদ্মনামই বাংলা সাহিত্যজগতে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ওঠে। কিন্তু এত কিছু থাকতে কেবলমাত্র ‘বনফুল’ ছদ্মনাম নেওয়ার পিছনে তাঁর অরণ্যের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আকর্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন বলাইচাঁদ তাঁর জীবনীতে। ১৯১৯ সাল থেকে ‘ভারতী’ ও ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় বনফুলের লেখা নিয়মিত ছাপা হতে থাকে। ‘প্রবাসী’তে তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘চোখ গেল’ প্রকাশিত হয়। চারপাশের মানুষজন, নিত্যদিনের ঘটনা, অতি সাধারণ কথোপকথন এবং নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই বনফুল রচনা করেছেন একের পর এক কবিতা, গল্প বা উপন্যাস। তিনি আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন বাংলার কথাসাহিত্যিক। বনফুলের যখন বিবাহ স্হির হয় লীলাবতীর সঙ্গে, সেই সময় তিনি কিছু চিঠি লিখেছিলেন লীলাবতীকে যার কয়েকটি নিয়ে পরবর্তীকালে তিনি লেখেন ‘কষ্টিপাথর’ উপন্যাস।‘অগ্নীশ্বর’ উপন্যাসের বিয়ষবস্তু ছিল একজন ডাক্তারের জীবনকাহিনী যা তাঁর দীর্ঘ চিকিৎসক জীবনেরই একটি প্রভাব। নিজের মেয়ের জন্য পাত্র খোঁজার ঘটনাবলী নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘কন্যাসু’ উপন্যাসটি আবার তাঁর নিজের জীবনবোধের পরিচয় পাওয়া যায় ‘জঙ্গম’ উপন্যাসটিতে। শুধু পারিবারিক বা সামাজিক ঘটনাবলীই তাঁর সৃষ্টির বিষয়বস্তু ছিল না, সমসাময়িক দেশের রাজনৈতিক অস্হিরতাও তাঁর গল্পে স্হান পেয়েছে। সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক জীবন বা বিশ্বযুদ্ধ তাঁর কবিতা ‘অঙ্গারপর্ণী’তে স্হান পেয়েছে। বিখ্যাত আগস্ট আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তিনি লিখেছেন ‘অবাহনীয়’ ও ‘অগ্নি’ নামের দুটি কবিতা। তাঁর পাখি দেখা ও পাখি চিনতে শেখার যে শখ তা ফুটে উঠেছে বিখ্যাত ‘ডানা’ উপন্যাসটিতে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও বনফুলের ঘনিষ্ঠতা ছিল এক অন্য পর্যায়ের। তাঁরা একে অপরের পরামর্শ যেমন নিতেন, তেমনি একে অপরের লেখার প্রংশসাও করতেন। বনফুলের লেখা ‘মানুষের মন’ গল্পটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ যেমন খুশি হয়েছিলেন, ঠিক তেমনই বনফুলের লেখা নাটক ‘শ্রীমধুসূদন’ ও ‘তৃণখণ্ড’ উপন্যাসের কিছু অংশ পড়ে পছন্দ না হওয়ায় কিছু জায়গায় পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়ে বনফুলকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।কিন্তু স্বাধীনচেতা বনফুল নিজের মৌলিক সৃষ্টিতে রবীন্দ্র-প্রভাবমুক্ত স্বকীয়তা বজায় রাখতে চেয়েছিলেন এবং তা তিনি সফলভাবেই করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথই আবার বনফুলকে নিজের স্মৃতিস্বরূপ নিজের গায়ের জোব্বা উপহার দেন। শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, তাঁর সঙ্গে নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ি, অশোক কুমার, উৎপল দত্ত, উত্তমকুমার, সত্যজিৎ রায় সকলেরই সুসম্পর্ক ছিল। বনফুলের লেখা কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ হল ‘বনফুলের কবিতা’ (১৯৩৬), ‘চর্তুদশী’ (১৯৪০), ‘চরণকমলেষু’ (১৯৪৯), ‘নতুন বাঁকে’ (১৯৫৯) প্রমুখ। বনফুলের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির মধ্যে রয়েছে ‘তৃণখণ্ড’, ‘জঙ্গম’, ‘অগ্নি’, ‘স্হাবর’, ‘অগ্নীশ্বর’, ‘হাটেবাজারে’, ‘ভুবন সোম’, ‘বৈতরণীর তীরে’, ‘নিরাঞ্জনা’, ‘মানসপুর’, ‘পীতাম্বরের পূনর্জন্ম’, ‘গোপালদেবের স্বপ্ন’, ‘জলতরঙ্গ’, ‘তীর্থের কাক’, ‘পক্ষীমিথুন’, ‘স্বপ্নসম্ভব’, ‘রূপকথা এবং তারপর’, ‘পিতামহ’, ‘প্রথম গরল’ ‘দুই পথিক’, ‘রাত্রি’, ‘আকাশবাসী’, ‘কষ্টিপাথর’, ‘সাত সমুদ্র তেরো নদী’, ‘প্রচ্ছন্ন মহিমা’ ও ‘হরিশ্চন্দ্র’ ইত্যাদি। তাঁর ছোটগল্পগুলি ছিল অভিনবত্বে ভরা। বনফুলের লেখা পাঁচশোরও বেশি ছোটগল্প সংকলিত হয়েছে ‘বনফুলের গল্প’, ‘বিন্দুবিসর্গ’, ‘অদৃশ্যলোকে’, ‘তন্বী’, ‘অনুগামিনী’, ‘দূরবীন’, ‘মণিহারী’, ‘বনফুলের নতুন গল্প’, ‘বহুবর্ণ’ ইত্যাদি গ্রন্থে। ‘শ্রীমধুসূদন’ ও ‘বিদ্যাসাগর’ নামে দুটি অতি বিখ্যাত ও বহুলচর্চিত নাটক লিখেছেন বনফুল ওরফে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। ‘পটভূমি’ বইটি বনফুলের আত্মজীবনী। এগুলি ছাড়াও তিনি লিখেছেন বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ।
বনফুলের বেশ কয়টি উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৬৯ সালে মৃণাল সেনের পরিচালনায় উৎপল দত্ত অভিনীত ‘ভুবন সোম’, ১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মহানায়ক উত্তমকুমারের অভিনীত ‘অগ্নীশ্বর’, ১৯৬৭ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম বিখ্যাত অভিনেতা অশোককুমার অভিনীত ছবি ‘হাটে বাজারে’, ১৯৫৬ সালে সুচিত্রা সেন ও উত্তমকুমারের অভিনীত ছবি ‘একটি রাত’, ১৯৮০ সালে ‘পাকা দেখা’ এবং ১৯৭৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘অর্জুন পণ্ডিত’ উল্লেখযোগ্য। ‘অজুর্ন পণ্ডিত’ ছায়াছবির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি বনফুলের লেখা নাটক ‘শ্রীমধুসূদন’ মঞ্চস্হ করবেন বলে ঠিক করলেও শেষ পর্যন্ত করে উঠতে পারেননি।
বনফুল তাঁর নিজস্ব সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৫১ সালে তিনি ‘শরৎস্মৃতি পুরস্কার’ লাভ করেন, ১৯৬২ সালে ‘রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার’ এবং ১৯৬৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ‘জগত্তারিণী পদক’ লাভ করেন। এছাড়াও ১৯৭৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ‘ডি লিট’ উপাধিতে ভূষিত হন। ভারত সরকার বনফুলকে ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কারে ভূষিত করে। ভারতীয় ডাক বিভাগ ১৯৯৯ সালে বনফুলের জন্মশতবার্ষিকীতে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে তাঁকে সম্মান জানায়।
১৯৭৯ সালের ৯ ফ্রেব্রুয়ারি কলকাতায় বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুলের মৃত্যু হয়।
3 comments