ভিক্টোরীয় যুগের সবথেকে জনপ্রিয় এবং প্রতিভাবান কথাসাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্স (Charles Dickens)। উনিশ শতকের ইংল্যাণ্ডের একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ সাংবাদিক এবং প্রাবন্ধিকও ছিলেন তিনি। উপন্যাস লেখার পাশাপাশি সম্পাদনাও করেছেন ডিকেন্স। তাঁর লেখা ‘অলিভার টুইস্ট’, ‘অ্যা ক্রিস্টমাস ক্যারল’, ‘ডেভিড কপারফিল্ড’, ‘অ্যা টেল অফ টু সিটিস’, ‘গ্রেট এক্সপেক্টেশন’ ইত্যাদি সব কালজয়ী উপন্যাসগুলি আজও বিশ্বের বহু পাঠকের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। উনিশ শতকের ইংল্যাণ্ডের দারিদ্র্য, শ্রমজীবি মানুষের দুরবস্থার কথা তাঁর উপন্যাসে বারবারই ফুটে ওঠে। তাঁর সমস্ত উপন্যাসই সমাজের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির মানুষের কাছে সমাদৃত হয়েছে। তাই আজও তাঁর জনপ্রিয়তা এতটুকুও কমেনি। সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থাকায় তাঁর উপন্যাসে রূপ পায় একেবারে জীবন্ত বাস্তবের ছবি। নানা বয়দ, পেশা এবং সামাজিক অবস্থানের নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোরের চরিত্র সৃষ্টিতে ডিকেন্স ছিলেন তুলনারহিত। একেবারে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত জীবনের সাধারণ দৈনন্দিন হাসি-কান্নার মুহূর্তগুলি ডিকেন্সের লেখনীতে অসামান্য রূপ পেত। সাহিত্য সমালোচকদের মতে চার্লস ডিকেন্সের বেশিরভাগ রচনাই ছিল আত্মজৈবনিক।
১৮১২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ইংল্যাণ্ডের হ্যাম্পশায়ারের পোর্টসমাউথ শহরে চার্লস ডিকেন্সের জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম ছিল চার্লস জন হাফাম ডিকেন্স। তাঁর বাবার নাম জন ডিকেন্স এবং মায়ের নাম এলিজাবেথ ব্যারো। তাঁদের আট সন্তানের মধ্যে ডিকেন্স ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর বাবা জন পরিবারের অসচ্ছল অবস্থার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতেন, কিন্তু তাতেও ভাগ্য ফিরছিল না ডিকেন্সের পরিবারের। পরে জন ডিকেন্স নৌ বিভাগের পে-অফিসে একজন সামান্য কেরানির পদে চাকরির সুবাদে ১৮১৪ সালে লণ্ডনে চলে আসেন। এর কয়েক বছর পরে ১৮১৭ সালে পরিবার নিয়ে তিনি এসে ওঠেন চ্যাথাম শহরে। সেই সময় ডিকেন্সের বয়স ছিল মাত্র চার বছর। এগারো বছর বয়স পর্যন্ত তিনি চ্যাথামেই ছিলেন। এই শহরেই জীবনের সবথেকে সুখের সময়গুলি কাটিয়েছিলেন ডিকেন্স। ১৮২২ সালে আর্থিক অসঙ্গতির কারণে পুনরায় তাঁরা লণ্ডনে ফিরে যান। তাঁর বাবা জন ডিকেন্স বাবা হিসেবে অত্যন্ত স্নেহশীল ছিলেন ঠিকই, কিন্তু অর্থনৈতিক দায়িত্ববোধ তাঁর কম ছিল। শৈশবে তাঁর বাবা-মায়ের সৌজন্যে ও উৎসাহেই হেনরি ফিল্ডিং, অলিভার গোল্ডস্মিথ এবং তোবিয়াস স্মোলেট প্রমুখ বিখ্যাত অষ্টাদশ শতকের কথাসাহিত্যিকদের লেখাপত্র পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন ডিকেন্স। এমনকি আরব্য রজনীর ইংরেজি অনুবাদও তিনি সেই সময়েই পড়ে ফেলেন। পরবর্তীকালে ১৮৩৬ সালে সহকর্মী জর্জ হোগার্থের কন্যা ক্যাথেরিনের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।
তাঁর বাবার নৌবিভাগের চাকরির সুবাদে প্রথমে ডেম স্কুলে এবং পরে কিছুদিন উইলিয়াম গিলসের তত্ত্বাবধানে একটি ব্রিটিশ ডিসেন্টারে পড়াশোনা করেছিলেন চার্লস ডিকেন্স। কিন্তু লণ্ডনে থাকাকালীন পরিবারের অন্নসংস্থানের জন্য ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েন জন এবং তাঁদের পরিবারে দূর্ভাগ্য ঘনিয়ে আসে। ঋণ মেটাতে না পারায় ডিকেন্সের বাবা কারারুদ্ধ হন। দেনার দায়ে বাড়ির গৃহস্থালির সব জিনিস একে একে বিক্রি করে দিতে হল তাঁদের।
চরম আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়ে মাত্র বারো বছর বয়সেই ডিকেন্সকে জুতো পালিশের কালি তৈরির কারখানায় কাজে যোগ দিতে হয়। আজীবন এই বিধ্বস্ত শৈশবের ভার বয়ে বেরিয়েছেন ডিকেন্স। চূড়ান্ত অসম্মান আর আত্মগ্লানির এই সময়েই নতুন করে লণ্ডন শহরকে দেখতে শুরু করেন ডিকেন্স। সমালচকরা বলেন তাঁর এই ব্যক্তিজীবনের ক্লিন্ন অভিজ্ঞতাই তাঁর বহু উপন্যাসে রূপ পেয়েছে। তিন মাস পরে তাঁর বাবা কারাগার থেকে মুক্ত হলে কারখানার কাজ থেকে ডিকেন্সকে ছাড়িয়ে আনেন জন ডিকেন্স। মাত্র চার মাস সেই কারখানায় কাজ করেছিলেন ডিকেন্স।
এরপরে তিনি নতুন করে শিক্ষারম্ভ করার উদ্দেশ্যে ওয়েলিংটন হাউজ অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন। এখানে দুই বছর পড়াশোনা করে ১৮২৭ সালে একটি আইনি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কেরানির কাজ নিয়ে লণ্ডনে আসেন ডিকেন্স। ওয়েলিংটন হাউজে পড়ার সময় থেকেই আশেপাশের নানা ঘটনাকে ছোট ছোট প্রতিবেদনের আকারে লিখে পাঠাতেন ডিকেন্স ব্রিটিশ প্রেসে যাকে বলা হত ‘পেনি এ লাইন স্টাফ’। তাই এই সময় থেকেই একপ্রকার সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হয়ে যায় তাঁর। ১৮২৮ সালে ১৬ বছর বয়সে লণ্ডনের আইন আদালতে একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন ডিকেন্স। ব্যক্তিগত উদ্যোগে শর্টহ্যাণ্ড শিখে নিলেন তিনি, সাংবাদিকতার ইচ্ছে ক্রমেই দৃঢ় হয়ে উঠতে লাগল তাঁর। ইতিমধ্যে ১৮২৯ সালে জনৈক ব্যাঙ্ক কর্মচারীর কন্যা মারিয়া বিডনেলের প্রেমে পড়েন চার্লস ডিকেন্স, কিন্তু মারিয়ার বাবা ডিকেন্সের আর্থিক অসচ্ছলতার কথা শুনে এই সম্পর্কে মত দেননি। ফলে দীর্ঘ চার বছর মারিয়ার সঙ্গে ডিকেন্সের পরিণয় ভেঙে যায়। তরুণ ডিকেন্স আবার হতাশায় ডুবে যান। ১৮৩২ সালে সান্ধ্য পত্রিকা ‘দ্য ট্রু সান’-এ সংসদীয় সাংবাদিকতার কাজ পেলেন ডিকেন্স। তার পরের বছর তিনি যোগ দেন ‘দ্য মর্নিং ক্রনিকল’ নামে বিখ্যাত একটি ইংরেজি পত্রিকায়। সাংবাদিক জীবনে নানা সময় নানাবিধ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতেন তিনি, সেইসব অভিজ্ঞতার টুকরো কোলাজ দিয়ে ছোট ছোট নক্শাধর্মী লেখা লিখতে শুরু করেন ডিকেন্স যেগুলিকে বজ্ (Boz) বলা হত। যদিও এই সময় তিনি ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। ‘দ্য মান্থলি ম্যাগাজিন’ সহ কয়েকটি পত্রিকায় এই লেখাগুলি প্রকাশিত হয়েছিল। পরে ১৮৩৬-৩৭ সালে ‘স্কেচেস বাই বজ্’ নামে একটি বইতে দুই খণ্ডে তাঁর সমস্ত নক্শাধর্মী লেখা সংকলিত হয়। ক্রমেই অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে এই লেখাগুলি, ফলে আর্থিক সমস্যাও ধীরে ধীরে দূর হতে থাকে তাঁর, খ্যাতিও বাড়তে থাকে। ১৮৩৬ সালে এই ধরনের আরো কিছু ধারাবাহিক নক্শা লিখতে শুরু করেন ডিকেন্স যা ১৮৩৬ সালের এপ্রিল মাস থেকে ১৮৩৭ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত মোট কুড়িটি কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল। এর নাম দিয়েছিলেন ডিকেন্স ‘পিকউইক পেপারস’। এর পরেই পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে উপন্যাস লিখতে শুরু করেন ডিকেন্স।
তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস ছিল ‘দ্য পসথুমাস পেপারস অফ দ্য পিকউইক ক্লাব’, আসলে এটিই ‘পিকউইক পেপারস’ নামে প্রথমে প্রকাশিত হত, পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় নাম পরিবর্তিত হয়। যদিও প্রকৃত উপন্যাসের মত কাহিনির বাঁধুনি কিংবা গল্পের টান টান বুনন ছিল না এই লেখায়। মূলত চিত্রশিল্পী সেমোর-এর আঁকা স্কেচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই লেখাটি লিখেছিলেন ডিকেন্স। পরে সেমোরের মৃত্যু হলে শিল্পী ব্রাউন ছবি আঁকেন। এই উপন্যাসের ধারাবাহিক শেষ হওয়ার আগেই ১৮৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বেন্টলিস মিসেলেনি পত্রিকায় ডিকেন্স লিখতে শুরু করেন ‘অলিভার টুইস্ট’ উপন্যাসটি। এর আগে কোনো ইংরেজি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে কোনো বালককে দেখা যায়নি। সমালোচকরা বলে থাকেন এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অলিভারের মধ্যে আসলে ডিকেন্সের আত্মজৈবনিক স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা মিশে আছে। শুধুই ইংল্যাণ্ড নয়, মার্কিন পাঠকের কাছেও এই উপন্যাস অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৮৩৮ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ‘অলিভার টুইস্ট’। এরপর একে একে ‘নিকোলাস নিকল্বি’ (১৮৩৮), ‘দ্য ওল্ড কিউরিওসিটি শপ’ (১৮৪০), ‘বারানাবি রিজ’ (১৮৪১) ইত্যাদি অতি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় উপন্যাস লেখেন তিনি। ১৮৪২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান চার্লস ডিকেন্স এবং মার্কিন প্রদেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি লেখেন আমেরিকান নোটস (১৮৪২) এবং মার্টিন কুজ্লেউইট (১৮৪৪) নামের দুটি নতুন উপন্যাস। কিন্তু এই উপন্যাস দুটি মার্কিন পাঠকদের কাছে প্রশংসার বদলে নিন্দিত হয়েছিল। ১৮৪৪ সালে ইতালি যাওয়ার আগে প্রকাশ পায় ডিকেন্সের লেখা ‘দ্য ক্রিস্টমাস ক্যারল’ উপন্যাস এবং এরপরে সুইজারল্যাণ্ডে থাকাকালীন তিনি লেখেন ‘ডোম্বে অ্যাণ্ড সন’ (১৮৪৮)। চার্লস ডিকেন্সের লেখা অসামান্য কালজয়ী আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ প্রকাশিত হয় ১৮৪৯ সালে। ১৮৬৭ সালে দ্বিতীয়বার আমেরিকা ভ্রমণ করেন চার্লস ডিকেন্স। মূলত তাঁর লেখা পাঠের ইচ্ছে ছিল মার্কিন পাঠকদের সামনে। এর আগে ইংল্যাণ্ডেও এরকম পাঠ করেছিলেন ডিকেন্স প্রকাশ্য সভায় যা বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৮৬৫ সালে একটি রেল দূর্ঘটনায় গুরুতরভাবে আহত হন তিনি এবং লেখালেখি কমে আসে তাঁর। এরপরে ইংল্যাণ্ডে ফিরে আসেন তিনি এবং ১৮৭০ সালে ‘দ্য মিস্ট্রি অফ এডউইন ড্রুড’ নামে একটি নতুন ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলেন তিনি। যদিও এর মধ্যেই তাঁর মৃত্যু ঘটায় এই লেখা অসমাপ্তই থেকে যায়।
তাঁর লেখা অন্যান্য উপন্যাসগুলি হল ‘ব্লেক হাউজ’ (১৮৫৩), ‘হার্ড টাইমস’ (১৮৫৪), ‘লিটল ডরিট’ (১৮৫৭), ‘এ টেল অফ টু সিটিস’ (১৮৫৯), গ্রেট এক্সপেক্টেশন্স (১৮৬১) এবং ‘আওয়ার মিউচুয়াল ফ্রেণ্ড’ (১৮৬১) ইত্যাদি। এছাড়াও বহু ছোটগল্প এবং কয়েকটি নাটকও লিখেছিলেন তিনি।
চার্লস ডিকেন্সের প্রথম উপন্যাসের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে ইংল্যাণ্ডের ব্রিটিশ দশ পাউণ্ডের নোটে ডিকেন্সের ছবি ছেপে তা প্রকাশ করা হয়েছিল স্মারক হিসেবে।
১৮৭০ সালের ৯ জুন ৫৮ বছর বয়সে চার্লস ডিকেন্সের মৃত্যু হয়।
3 comments