ফ্রেডরিক নিৎসে

ফ্রেডরিক নিৎসে

ফ্রেডরিক নিৎসে (Friedrich Nietzsche) একজন বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক এবং সাংস্কৃতিক সমালোচক যাঁর দর্শনের প্রভাব পড়েছে আমাদের আধুনিক জীবন-যাপনেও। একজন ধ্রুপদী দার্শনিক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্রুপদী দর্শনের সর্বকনিষ্ঠ অধ্যাপক ছিলেন নিৎসে। তাঁর দর্শনের বিশেষ বিশেষ উপাদানের ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে রয়েছে সত্যের বৈপ্লবিক সমালোচনা, ধর্ম ও খ্রিস্টিয় নৈতিকতার সমালোচনা, প্রভু ও ক্রীতদাসের নৈতিকতা, জীবনের আধ্যাত্মিক সত্যতা ইত্যাদি। ঈশ্বর যে মৃত তা তিনি গভীর প্রজ্ঞার সঙ্গে ব্যক্ত করেন এবং তাঁর দর্শনের উপরই ভিত্তি করে ‘নিহিলিজম’-এর সূত্রপাত ঘটেছে। মূলত শোপেনহাওয়ারের দর্শন সংক্রান্ত বইপত্র পড়েই দার্শনিক চিন্তা ও চর্চার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন নিৎসে। অবিশ্বাস ও নৈরাশ্যবাদের চূড়ান্ত পর্যায়ে দাঁড়িয়ে তিনিই প্রথম নিহিলিজমের কথা বলেন যা একপ্রকার ধ্বংসবাদের নামান্তর। নিহিলিস্টদের কাছে পৃথিবীর সব কিছুই অর্থহীন, উদ্দেশ্যহীন। তাঁর দর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল ‘উইল টু পাওয়ার’ তত্ত্ব। ৮০-র দশকের শেষে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। তাঁর সর্বাধিক আলোচিত বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘হিউম্যান, অল টু হিউম্যান’, ‘বিয়ণ্ড গুড অ্যাণ্ড ইভিল’, ‘দ্য গে সায়েন্স’, ‘দ্য অ্যান্টিক্রাইস্ট’ ইত্যাদি।

১৮৪৪ সালের ১৫ অক্টোবর জার্মানির লাইপজিগের রোয়েকন গ্রামে ফ্রেডরিক নিৎসের জন্ম হয়। তাঁর বাবা কার্ল লুডউইগ নিৎসে একজন ধর্মযাজক ছিলেন এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল ফ্রানজিসকা নিৎসে। নিৎসে ছাড়াও তাঁদের আরো দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তান ছিল। নিৎসের জন্মের দিন প্রাশিয়ার তৎকালীন সম্রাট ফ্রেডরিক উইলিয়ামের জন্মদিন ছিল যার কারণে তাঁর নাম রাখা হয় ফ্রেডরিক। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই ১৮৪৯ সালে তাঁর বাবা মারা যান, এরপর থেকে ন্যুয়েমবার্গে দাদুর কাছেই বড়ো হতে থাকেন তিনি। সেখানেই তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়েছিল।

বন ও লাইপজিগের বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন, ভাষাতত্ত্ব আর ধ্রুপদী সংস্কৃতির চর্চা করতেন নিৎসে। পরবর্তীকালে তাঁর মেধার প্রাখর্য দেখে বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ২৪ বছর বয়সে ধ্রুপদী দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। সময়টা তখন ১৮৬৯ সাল। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বকনিষ্ঠ অধ্যাপক ছিলেন তিনি। তাঁর শিক্ষক ফ্রেডরিক উইলহেলম রিটস্কল তাঁর ব্যাপারে একটি চিঠি লিখে সুপারিশ করে দিয়েছিলেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বেশিরভাগ সময় ভাষাতত্ত্বের উপর কাজ করা সত্ত্বেও শোপেনহাওয়ার এবং ফ্রেডরিক অ্যালবার্ট ল্যাং-এর দর্শনের দ্বারা গভীরভাবে প্রাণিত হয়ে দর্শনচর্চা শুরু করেন তিনি। বাসেলে অধ্যাপনা শুরু করার আগে নিৎসে ভেবেছিলেন কান্টের সময় থেকে টেলিওলজি বিষয়ে দ্বিতীয় একটি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করবেন। লিপজিগের ছাত্র থাকাকালীন নিৎসের সঙ্গে দেখা হয় রিচার্ড ওয়াগনারের। ১৮৭০ সাল পর্যন্ত তাঁদের বন্ধুত্ব অটুট ছিল। নিৎসের প্রথম বই ‘দ্য বার্থ অফ ট্র্যাজেডি আউট অফ দ্য স্পিরিট অফ মিউজিক’ যা প্রকাশ পায় ১৮৭২ সালে। এই বইটিই তাঁর অ্যাপোলোনীয় ও ডায়োনিসীয় দর্শনচিন্তার প্রকাশ যেখানে গ্রিক রূপকথার দুই দেবতাকে নতুন করে আবিষ্কার করেন নিৎসে। সভ্যতার সমকালীন সংকট থেকে সম্ভাব্য উদ্ধারকর্তা হিসেবে তিনি গ্রিক ট্রাজেডির দুই দেবতাকে কল্পনা করেছেন। ধ্বংসের ভিতর দিয়েই সৃষ্টির ভাবনা রচনা করেছেন তিনি। নিৎসের এই দর্শন প্রভাবিত করেছিল পরবর্তীকালের স্ট্রিণ্ডবার্গ, রিলকে, টমাস মান, আঁদ্রে জিদ প্রমুখদের লেখায়। বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট দশ বছর অধ্যাপনা করেছিলেন ফ্রেডরিক নিৎসে। কিন্তু এই সময় তিনি এতটাই রুগ্ন হয়ে পড়েন যে তাঁকে বাধ্য হয়ে অধ্যাপনার কাজ ছাড়তে হয়। দীর্ঘ দশ বছর ধরে চিকিৎসার জন্য এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরেছেন তিনি, কিন্তু তাতেও পুরোপুরি সুস্থ হননি। একদিকে আর্থিক সংস্থান নেই, স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে, বন্ধুও নেই। এমন অবস্থায় জগৎ ও জীবন থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিবিক্ত করে নেন নিৎসে। তাঁর প্রথম বইটির পরে জার্মান বৌদ্ধিক সংস্কৃতি চর্চার জগতে একের পর এক প্রবন্ধ লিখতে থাকেন নিৎসে যার মধ্যে ডেভিড স্ট্রসের উপর তিনি লেখেন ‘ইউজ অফ হিস্ট্রি ফর লাইফ’ এবং শোপেনহাওয়ার ও ওয়াগনারের দর্শনের উপরেও তিনি বই লেখেন। ভগ্ন শরীরে বাড়িতে বসে থেকে প্রচলিত নৈতিকতা বিষয়ে প্রকৃতিবাদী সমালোচনা করতে শুরু করেন তিনি। তাঁর এক বন্ধু পল রি-এর সহায়তা ও অনুপ্রেরণায় তিনি লেখেন ‘অরিজিন অফ মর‍্য্যাল সেন্সেশানস’ যা প্রকাশ পায় ১৮৭৬ সালে এবং ১৮৭৮ সালে তাঁর লেখা আরেকটি বই প্রকাশ পায় ‘হিউম্যান, অল টু হিউম্যান’ নামে। ১৮৭৮ সালে এই বইটি ওয়াগনারকে পাঠালে তাঁর সঙ্গে নিৎসের সম্পর্কে ছেদ পড়ে। ১৮৮১ সালে ‘ডে-ব্রেক’ বইতে নৈতিকতা ও অন্তর্নিহিত মনোবিজ্ঞানের উপরে সমালোচনা লেখেন নিৎসে। তারপরে ১৮৮২ সালে প্রকাশিত তাঁর লেখা ‘দ্য গে সায়েন্স’ বইটিও সর্বাধিক জনপ্রিয় হয়। ১৮৮৭ সালে প্রকাশ পায় ‘অন দ্য জিনিওলজি অফ মর‍্যালিটি’, ১৮৮৮ সালে ‘টোয়াইলাইট অফ দ্য আইডলস’ এবং ১৮৮৮ সালে ‘দ্য ওয়াগনার কেস’ নামে তিনটি বই লেখেন তিনি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ফ্রেডরিক নিৎসেপরবর্তীকালে স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য শীতকালে ভূমধ্যসাগরের কাছে এবং গ্রীষ্মকালে সুইজারল্যাণ্ডের সিল মারিয়াতে থাকার কথা সিদ্ধান্ত নেন। মানসিক জটিলতার পাশাপাশি দৃষ্টিশক্তির সমস্যা, মাথার পিছনে টিউমারও ধরা পড়ে তাঁর। ১৮৮৯ সালে তুরিনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অজ্ঞান হয়ে পড়েও গিয়েছিলেন তিনি। নিজে থেকে বই প্রকাশ করা আর তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাঁর বোন এলিজাবেথ এই কাজে তাঁকে সহায়তা করেন। নিৎসের ‘অ্যান্টি ক্রাইস্ট’ ও ‘এসে হোমো’ বই দুটি এলিজাবেথের সম্পাদনাতেই প্রকাশ পায়। নিৎসের মৃত্যুর আট বছর পরে প্রকাশ পায় ‘এসে হোমো’ বইটি। নিৎসে মনে করেন নিয়ত পরিবর্তনশীল জগতে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। নৈতিকতার চিরন্তন মাপকাঠি বলে কিছু হয় না। আজ যা সত্য বলে প্রতিপন্ন, কাল তা মিথ্যা হতে পারে। নিৎসের দর্শনের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য হল নিহিলিজম সংক্রান্ত চিন্তা-চেতনা। একে ধ্বংসবাদও বলা হয়। মানুষের প্রবল নিঃসঙ্গতায় প্রচলিত নীতি-নৈতিকতা থেকে দূর সরে সত্যের প্রতি বিমুখ হয়ে পড়ে। হতাশা এসে গ্রাস করে মানুষকে যার ফলে তাঁর কাছে সবকিছু অর্থহীন হয়ে পড়ে। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর উদ্দেশ্যহীনতায় ভরা জীবনেই এই নিহিলিজমের জন্ম হয়। নিহিলিস্টরা আসলে জগৎ ও জীবনের কোনো ঘটনার পিছনে প্রকৃত কোনো কারণ আছে বলে বিশ্বাস করে না, তাঁদের কাছে সবই কল্পিত। এই ধ্বংসবাদ আবার দুই রকম – নিষ্ক্রিয় ও সক্রিয়। নিষ্ক্রিয় নৈরাশ্য মানুষকে মানসিকভাবে দূর্বল করে দেয় এবং সেই সময়েই তিনি তাঁর আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। নিৎসেই বলেছিলেন যে ঈশ্বর মৃত। ফলে সক্রিয় নিহিলিস্টরা প্রচলিত ধ্যান-ধারণার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তাঁর মতে নৈতিকতা হল সম্পূর্ণ আপেক্ষিক একটি বিষয়। এই বিষয়ে কারখানার শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্কের বিষয়ে ‘স্লেভ মরালিটি’ ও ‘মাস্টার মরালিটি’ বিষয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। মালিকের চোখে শ্রমিকের আলস্য বা শ্রমিকের অতিরিক্ত ছুটি নেওয়া খারাপ, কিন্তু অন্যদিকে মালিকের অতিরিক্ত নিয়মতান্ত্রিকতা, কড়া মনোভাব শ্রমিকের কাছে খারাপ বলে মনে হতে পারে। ফলে নিৎসে দেখালেন যে মালিক ও শ্রমিক দুই পক্ষেরই নিজস্ব নৈতিকতা রয়েছে। তাঁর মতে মানব সমাজে ‘বিবেক’, ‘অপরাধ’ ইত্যাদি শব্দের তাৎপর্য ভ্রান্ত এবং এই শব্দগুলি মানবীয় প্রবৃত্তিকে দমন করে রাখে। নিৎসের লেখা ‘দাজ স্পোক জরথুস্ট্র’(Thus Spoke Zorathustra) বইতে এক অভিনব সুপারম্যান তত্ত্বের কথা বলেন তিনি। তাঁর মতে এই সুপারম্যান আসলে একজন সক্রিয় নিহিলিস্ট যিনি প্রচলিত সব ধ্যান ধারণা ভেঙে ফেলতে চান। মূলগতভাবে নিৎসে জার্মান শব্দ ‘উবারমেনশ’(Ubermench) ব্যবহার করে যার আক্ষরিক ইংরেজি অর্থ ওভারম্যান। কিন্তু ওভারম্যানের পরিবর্তে সুপারম্যান শব্দটিই সুপ্রযুক্ত হয়।

তাঁর মতে ধর্ম ও বিজ্ঞান দুইই প্রবাহমানতার বিপক্ষে। শাসক এই ধর্মকে কাজে লাগিয়ে দূর্বল ও শাসিত মানুষের মধ্যে দাস্যভাব জাগিয়ে রাখে। ১৮৫৫ সালে নিৎসে তাঁর বোন এলিজাবেথকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন যে মানুষের পথ হল বিভক্ত।

১৯০০ সালের ২৫ আগস্ট মাত্র ৫৫ বছর বয়সেই ফ্রেডরিক নিৎসের মৃত্যু হয়।    

আপনার মতামত জানান