পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা শহরের অদূরেই শিলাবতী নদীর ধারে গনগনি তে নদীর পাড় ক্ষয়ে রুখা-শুখা লাল মাটিতে গড়ে উঠেছে একটা ছোটোখাটো ‘ক্যানিয়ন’। শান্ত শিলাবতী নদীর অল্প জলের ধারে এমন আশ্চর্য প্রাকৃতিক ভূ-গঠন পর্যটকদের আকর্ষণ করে বারবার। ভূপ্রাকৃতিক সাদৃশ্যের কারণে গনগনি ‘বাংলার গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন’ নামেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আমেরিকার অ্যারিজোনা অঞ্চলে কলোরাডো নদীর ধারে ঠিক যেরকম নদীখাত তৈরি হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের গনগনিতেও সেই আমেজ খুঁজে পান বহু মানুষ। সেই একই গঠন, একই রঙ, একই বিন্যাস। জীবনানন্দের কবিতার মতো এই রূপসী বাংলার মাঝেই যেন পৃথিবীর অপর পারের রূপ চুপ করে থেমে আছে। একদিনের ছোট্ট ট্রিপে ঘুরে আসাই যায় অদ্ভুত সব লোককথা, ইতিহাস আর পুরাণে মিশে থাকা গনগনি ।

পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা শহরের অনতিদূরে অবস্থিত গনগনি। শিলাবতী নদী বয়ে গেছে এর পাশ দিয়ে আর তার ধারেই গড়ে উঠেছে বিশাল গিরিখাতের আকর্ষণীয় ভূগঠন। একে ‘বাংলার গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন’ বলা হয়ে থাকে। কলকাতা থেকে ১৭৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই গনগনি।
গনগনির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক পৌরাণিক আখ্যান এবং এক ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি। মহাভারতের কাহিনী অনুসারে পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের কথা জানা যায়। গনগনিতে শিলাবতী নদীর অপর পারের ভিখনগরেই নাকি অজ্ঞাতবাসের সময় পাণ্ডবেরা এসেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। যদিও তা লোককথা বা জনশ্রুতির অন্তর্গত। লোকমুখে শোনা যায় যে, নদীর পাড়ে একদিন যুধিষ্ঠির এক ব্রাহ্মণকে কাঁদতে দেখে তাঁকে কাঁদার কারণ জিজ্ঞাসা করায় সেই ব্রাহ্মণ নদীর ওপারে থাকা বক রাক্ষসের কথা যুধিষ্ঠিরকে জানায়। ব্রাহ্মণ বলেন সেই বক রাক্ষস নাকি প্রতিদিন একজন করে গ্রামবাসীকে খেয়ে নিজের ক্ষুধা মেটায়। সেদিন ছিল সেই ব্রাহ্মণের পালা। এই কথা শুনে যুধিষ্ঠির অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন এবং ভীমকে সঙ্গে নিয়ে বক রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। প্রবল যুদ্ধের শেষে ভীম বক রাক্ষসকে পরাজিত করেন। এখানকার মানুষ মনে করেন যে এই যুদ্ধের ফলেই নাকি তৈরি হয়েছে এই ক্যানিয়নের। লোকের বিশ্বাস ভীম ও বক রাক্ষসের প্রবল যুদ্ধের ফলে পৃথিবীর মাটি ওলট-পালট হয়ে যায়, ভেঙেচুরে বিকৃত হয়ে যায় আর তার ফলেই নাকি তৈরি হয়েছে এই গনগনির ক্যানিয়ন। আবার ঐতিহাসিক দিক থেকে জানা যায় চুয়াড় ও লায়েক বিদ্রোহের অন্যতম নেতা অচল সিংহ গনগনির গভীর শালের জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর দলবলও একইসঙ্গে ঘাঁটি গেড়েছিল এই গনগনির জঙ্গলে। অচল সিংহ শিখে নিয়েছিলেন গেরিলা যুদ্ধকৌশল এবং এই গেরিলা আক্রমণের দ্বারা ইংরেজ সেনাবাহিনীদের পর্যুদস্ত করে তুলেছিলেন তিনি। কামান দিয়ে গোলা-বারুদ ছুঁড়ে সমগ্র শালবন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন ইংরেজরা কিন্তু তাও নাকি অচল সিংহ চোরাগোপ্তা আক্রমণ করতে ছাড়েননি। বগড়ির শেষ রাজা ছত্র সিংহ নিজে তাঁকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। জানা যায় যে, গনগনির মাঠেই নাকি ইংরেজরা অচল সিংহ ও তাঁর দলবলকে ফাঁসি দিয়েছিল।
গড়বেতার শিলাবতী নদীর ধারে লাল মাটির এ যেন এক অন্য রূপ বাংলার। পাথুরে উঁচু-নীচু পথ, টিলা সব ধীরে ধীরে এসে মিশেছে নদীর পাড়ে। শীতকালে এই নদীর উপর চড়া পড়ে যায়, আর তাতে এসে আশ্রয় নেয় বহু পরিযায়ী পাখি। এই চড়াতেই হয় চাষবাস। তবে বর্ষায় ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে শিলাবতী। গরমকালে বা শীতকালে যে নদীর বুকে পায়ে হেঁটে পেরিয়ে যাওয়া যায়, বর্ষায় তার উত্তাল রূপ দেখলে প্রাণে কাঁপন লাগে। ল্যাটেরাইট মাটি নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে ক্ষয় পেয়ে এক আশ্চর্য সুন্দর ভূমিরূপ গড়ে তুলেছে এখানে। সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্ত উভয় সময়েই প্রকৃতির অপার ঐশ্বর্যে গনগনি স্বর্গীয় সৌন্দর্যে ভরে ওঠে। চারিদিকে খালি নানা রঙের বাহার। মাথার উপরে নীল আকাশ, নীচে হলদে-লাল শিলাবতীর জল কিংবা ক্যানিয়নের লালচে-বাদামি রঙ, দুপাশে সবুজ গাছপালা, ঝোপ সব মিলিয়ে অসাধারণ চিত্ররূপময় প্রকৃতি এসে ধরা দেয় চোখে। বাংলার মধ্যেই এ যেন এক ছোট্ট আমেরিকা। হ্যাঁ আমেরিকা, কলোরাডো নদীর উপর যেখানে গড়ে উঠেছিল বিশ্বখ্যাত গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন; গড়বেতার গনগনি যেন সেই গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়নেরই বঙ্গীয় সংস্করণ।

হাওড়া থেকে প্যাসেঞ্জার বা এক্সপ্রস ট্রেনে খুব সহজে পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা স্টেশনে পৌঁছানো যায়। প্যাসেঞ্জার ট্রেনে গেলে মোটামুটি ঘন্টা তিনেক সময় লাগে আর এক্সপ্রেস ট্রেন ধরলে আড়াই ঘণ্টার মধ্যেই গড়বেতা পৌঁছানো যায়। এছাড়া শালিমার এবং সাঁতরাগাছি থেকেও গড়বেতায় আসার সরাসরি ট্রেন রয়েছে। রেলপথে খড়গপুর হয়ে বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার পথেই গড়বেতায় যাওয়া যায়। তবে ট্রেনের ক্ষেত্রে গড়বেতার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ভোরের ট্রেন ধরা সবথেকে ভালো। তাতে রাতের মধ্যে আবার ট্রেন ধরে ফিরে আসা যায়। হাওড়া, ধর্মতলা কিংবা বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে বাসে করেও গনগনিতে পৌঁছানো যায়। সবশেষে গাড়ি করে আসতে গেলে ৬ নং জাতীয় সড়ক ধরে হাওড়া থেকে প্রথমে পাঁশকুড়া, তারপর ঘাটাল, চন্দ্রকোনা ও রোড চন্দ্রকোনা হয়ে গড়বেতা পৌঁছানো যায়। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী নিম্নলিখিত ট্রেনে করে গড়বেতা আসা যায় –
- রানি শিরোমণি ফাস্ট প্যাসেঞ্জার (৫৮০১৫) ট্রেনে হাওড়া স্টেশন থেকে বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটে উঠলে গড়বেতায় পৌঁছানো যায় ৯টা ২১ মিনিটে।
- শালিমার থেকে আরণ্যক এক্সপ্রেসে (১২৮৮৫) সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে যাত্রা শুরু করে সকাল ১০টা ৪৯ মিনিটে গড়বেতায় পৌঁছানো যায়।
- সবশেষে সাঁতরাগাছি থেকে রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস (১২৮৮৩) ধরলে ভোর ৬টা ২৫ মিনিটে যাত্রা শুরু করে সকাল ৯টা ১৩ মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যায় গড়বেতা স্টেশনে।
অনেকগুলি ছোটো-বড়ো হোটেল রয়েছে গনগনির আশেপাশে, রয়েছে ধর্মশালাও। আবার মেদিনীপুর, চন্দ্রকোনা বা গড়বেতার অন্যত্র হোটেলে থেকেও এই গনগনিতে ঘুরে যেতে পারেন। হোটেলের ভাড়া বা ইত্যাদি আগে থেকেই ঠিক করে নেওয়া ভালো। স্থানীয় মানুষদের কাছে গনগনি মূলত পিকনিক স্পট হিসেবে বেশি পরিচিত। তাছাড়াও এখানে বেশিরভাগ মানুষই একদিনের ট্যুরে ঘুরতে আসেন, তাই হোটেলের চাহিদা বেশি নেই। চাইলে আপনিও একদিনেই ঘুরে নিতে পারেন গনগনি ও আশেপাশের এলাকা।
গনগনির বিখ্যাত গিরিখাতের সৌন্দর্য মন ভরে দেখে নিতে হবে আগে। শিলাবতী নদীর জলে অল্প পা ডুবিয়ে অনুভব করা যায় প্রকৃতির টান। চারিদিকে বিস্তীর্ণ লালমাটির প্রান্তরে, গিরিখাতের নানা অংশে ঘোরার পাশাপাশি হাতে ক্যামেরা থাকলে পরপর ছবিও তুলে নেওয়া যায়। উঁচু টিলার থেকে নীচে নামার জন্য এখানে সিঁড়ি রয়েছে। লাল মাটির ঢেউ খেলানো মাটির মাঝে মাঝে দেখা যায় শাল-পিয়ালের জঙ্গল, কাজুবাদাম গাছের সারি আর কয়েকটা ছাউনি। এই ছাউনিগুলি মূলত পর্যটকদের বিশ্রাম নেওয়ার জন্যই বানানো হয়েছে। আর সাইটসিইং-এর মধ্যে পড়বে নিকটবর্তী কংসাবতী নদী, গোপগড়ের ইকো পার্ক, সর্বমঙ্গলা কালী মন্দির, রাধানাথ সিংহ স্মৃতি মন্দির, রাজা দুর্জন সিংহের রাধাবল্লভ মন্দির ইত্যাদি। ষোড়শ শতকে বাগদি রাজা এছাড়া আরাবাড়ি জঙ্গলে হাতিদের জল খাওয়ার জায়গাটাও ঘুরে আসা যায়, সঙ্গে জঙ্গলের অন্যান্য জীব-জন্তুদেরও দেখা পাওয়া যেতে পারে।
বর্ষাকাল বাদে বছরের যে কোনো সময়েই এখানে আসা যায়। তবে শীতকালে এলে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুব ভালো উপভোগ করা যায়। গরমে লালমাটির কারণে দাবদাহ অনেক বেশি হতে পারে যা ঘোরার পক্ষে খুবই ক্লান্তিকর।
ট্রিপ টিপস
- কীভাবে যাবেন – হাওড়া, শালিমার বা সাঁতরাগাছি থেকে ট্রেনে করে গড়বেতা স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া যায়। গড়বেতার কাছেই গনগনি। বাসে করেও হাওড়া, ধর্মতলা, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া থেকেও গনগনি আসা যায়। গাড়ি করে আসতে হলে ৬ নং জাতীয় সড়ক ধরে পাঁশকুড়া, ঘাটাল, চন্দ্রকোনা, রোড চন্দ্রকোনা পেরিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায়।
- কোথায় থাকবেন – গনগনির আশেপাশেই বহু হোটেল, ধর্মশালা ইত্যাদি রয়েছে। মেদিনীপুরের অন্যত্র বা চন্দ্রকোনাতে থেকেও গনগনি ঘুরে নেওয়া যায়।
- কী দেখবেন – গনগনির বিশাল গিরিখাত, লালমাটির বালুময় ঢেউ খেলানো প্রান্তর এখানকার বিশেষ দ্রষ্টব্য। এছাড়া আশেপাশের সাইটসিইং-এর মধ্যে পড়বে কংসাবতী নদী, গোপগড়ের ইকো পার্ক, সর্বমঙ্গলা কালী মন্দির, রাধানাথ সিংহ স্মৃতি মন্দির, রাজা দুর্জন সিংহের রাধাবল্লভ মন্দির।
- কখন যাবেন – বছরের যে কোনো সময়েই আসা যায় এখানে। তবে স্থানীয় মানুষদের কাছে এটি পিকনিক স্পট হিসেবে জনপ্রিয় হওয়ায় পিকনিক করতে ও গনগনির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে গেলে শীতকালে আসাই শ্রেয়।
- সতর্কতা –
- বর্ষাকালে এখানে না আসাই ভালো। গরমকালেও দাবদাহের কারণে ঘোরাটা ক্লান্তিকর হতে পারে।
- নদীতে যেহেতু বাঁধানো পাড় নেই, তাই জলে পা ডোবানোর সময় সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।