হিমোফিলিয়া বি

হিমোফিলিয়া বি

হিমোফিলিয়া (Haemophilia)একটি বিরল বংশগত রোগের প্রতিক্রিয়া যার প্রভাবে কোন ব্যক্তির আঘাতপ্রাপ্ত স্থান (ক্ষত, কাটা স্থান) থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়না বা রক্ত তঞ্চিত হয় না। প্রত্যেক বছর ১৭ এপ্রিল বিশ্বজুড়ে বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস পালিত হয় জনমানসে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। প্রধানত দুই প্রকারের হিমোফিলিয়া দেখা যায়। যথা, হিমোফিলিয়া এ (Haemophilia -A) ও হিমোফিলিয়া বি (Haemophilia B)। এর মধ্যে আজকের আলোচ্য বিষয় হল হিমোফিলিয়া বি ।

হিমোফিলিয়া বি রোগটি হিমোফিলিয়া এ-এর তুলনায় বিরল। ১৯৫২ সালে স্টিফেন ক্রিসমাস (Stephen Christmas) নামে এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে তাঁর নামানুসারে এই রোগকে ‘ক্রিসমাস রোগ’ (Christmas disease)ও বলা হয়ে থাকে। রক্ততঞ্চনের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক রকম উপাদানের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের নাম ‘ফ্যাক্টর IX’। এই ফ্যাক্টর-IX এর অভাবের কারণে হিমোফিলিয়া বি রোগটি দেখা যায়।

এই রোগের মোটামুটি তিনটি প্রকার লক্ষ্য করা যায়। যথা,

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

হালকা (mild) হিমোফিলিয়া বি:- এক্ষেত্রে রক্তে ফ্যাক্টর IX-এর পরিমাণ ৬% থেকে ৪৯% পর্যন্ত থাকে। এই প্রকার হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের যখন কোনো গুরুতর অস্ত্রোপচার বা আঘাতের কারণে অতিরিক্ত রক্তপাত হয় এবং তখনই বোঝা যায় রোগাক্রান্ত হওয়ার কথা। প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত এটি না ও বোঝা যেতে পারে।

মাঝারি (moderate) হিমোফিলিয়া বি :- এ ক্ষেত্রে রক্তে ফ্যাক্টর IX-এর পরিমাণ থাকে ১% থেকে ৫% পর্যন্ত। 

গুরুতর (severe) হিমোফিলিয়া বি :- এ ক্ষেত্রে রক্তে ফ্যাক্টর IX-এর পরিমাণ ১%-এরও নিচে নেমে যায়। ফলে ছোটখাটো আঘাতেই প্রচুর রক্তপাত হয়।

অস্থিসন্ধি এবং পেশির অভ্যন্তরে প্রায়শই কোনো কারণ ছাড়াই রক্তপাত বা ‘স্বতঃস্ফূর্ত রক্তপাত’ ঘটতে থাকে। যে লক্ষণগুলি প্রকাশ পেলে হিমোফিলিয়া রোগের অস্তিত্বের কথা বোঝা যায়, তার মধ্যে আছে —

•           দীর্ঘ রক্তক্ষরণ, যেমন কোনো গুরুতর অস্ত্রোপচার, দুর্ঘটনা, দাঁত তোলা ইত্যাদির পরে। মহিলাদের ক্ষেত্রে মাসিক রজঃচক্র ও সন্তান প্রসবের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত।

•           দীর্ঘসময় ধরে ক্ষত না সারা, নাক দিয়ে রক্ত পড়া।

•           মূত্রনালীতে অভ্যন্তরীণ রক্তপাতের কারণে মুত্রের মধ্যে রক্ত।

•           অস্থিসন্ধি ও পেশির অভ্যন্তরে রক্তপাত, ফলে সেই সমস্ত স্থান ফুলে যাওয়া ও যন্ত্রণা।

হিমোফিলিয়া একটি জেনেটিক বা বংশগত রোগ। এই রোগ বাবা বা মায়ের থেকে সন্তানে সঞ্চারিত হয়। মানবদেহে X ও Y নামক দুটি সেক্স ক্রোমোজোম থাকে। স্ত্রীদেহে থাকে দুটি X ক্রোমোজোম এবং পুরুষদের দেহে থাকে একটি X ও একটি Y ক্রোমোজোম। এর মধ্যে ফ্যাক্টর IX সৃষ্টিকারী জিন থাকে X ক্রোমোজোমের উপর। এই জিনের মিউটেশন ঘটলে শরীরে ফ্যাক্টর IX-এর অভাব দেখা যায়। ফলে সৃষ্ট হয় হিমোফিলিয়া বি। নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসারে হিমোফিলিয়া রোগটি বাবা-মায়ের মাধ্যমে সন্তানদের মধ্যে সঞ্চারিত হয় –

স্বাভাবিক মহিলা ও রোগাক্রান্ত পুরুষের মিলন:– এক্ষেত্রে মহিলার দুটি X ক্রোমোজোমই স্বাভাবিক হয় এবং পুরুষের ক্ষেত্রে X ক্রোমোজোমটি রোগাক্রান্ত হয় ও Y ক্রোমোজোমটি সুস্থ হয়। ফলে প্রতিটি গর্ভাবস্থার জন্য দুটি সম্ভাবনা তৈরি হয় —

i.          বাবার কাছ থেকে রোগাক্রান্ত X ক্রোমোজোম ও মায়ের কাছ থেকে স্বাভাবিক X ক্রোমোজোম পেয়ে সকল কন্যাসন্তান বাহক হয় — যার সম্ভাবনা ৫০%।

ii.          বাবার কাছ থেকে স্বাভাবিক Y ক্রোমোজোম ও মায়ের কাছ থেকে স্বাভাবিক X ক্রোমোজোম পেয়ে সকল পুত্রসন্তান স্বাভাবিক হয় — যার সম্ভাবনা ৫০%।

বিশদ বিবরণের জন্য চিত্র ১ দেখুন।

হিমোফিলিয়া বি - প্রথম চিত্র

বাহক মহিলা ও স্বাভাবিক পুরুষের মিলন:- এক্ষেত্রে মহিলার একটি X ক্রোমোজোম স্বাভাবিক হয় এবং অপর X ক্রোমোজোম রোগাক্রান্ত হয়। পুরুষের X ও Y দুটি ক্রোমোজোমই স্বাভাবিক হয়। ফলে প্রতিটি গর্ভাবস্থার জন্য চারটি সম্ভাবনা তৈরি হয়—

i.          বাবা ও মা উভয়ের কাছ থেকে সুস্থ X ক্রোমোজোম পেয়ে কন্যাসন্তান স্বাভাবিক হয় — যার সম্ভাবনা ২৫%।

ii.          মায়ের কাছ থেকে রোগাক্রান্ত X ক্রোমোজোম ও বাবার কাছ থেকে স্বাভাবিক X ক্রোমোজোম পেয়ে কন্যাসন্তান রোগটির বাহক হয় — যার সম্ভাবনা ২৫%।

iii.         মায়ের কাছ থেকে স্বাভাবিক X ক্রোমোজোম ও বাবার কাছ থেকে স্বাভাবিক Y ক্রোমোজোম পেয়ে পুত্রসন্তান স্বাভাবিক হয় — যার সম্ভাবনা ২৫%।

iv.         মায়ের কাছ থেকে রোগাক্রান্ত X ক্রোমোজোম ও বাবার কাছ থেকে স্বাভাবিক Y ক্রোমোজোম পেয়ে পুত্রসন্তান রোগাক্রান্ত হয় — যার সম্ভাবনা ২৫%।

বিশদ বিবরণের জন্য চিত্র ২ দেখুন।

বাহক মহিলা ও রোগাক্রান্ত পুরুষের মিলন:- এক্ষেত্রে মহিলার একটি X ক্রোমোজোম স্বাভাবিক হয় ও অপর X ক্রোমোজোম রোগাক্রান্ত হয়। পুরুষের X ক্রোমোজোম রোগাক্রান্ত হয় ও Y ক্রোমোজোমটি সুস্থ হয়। ফলে প্রতিটি গর্ভাবস্থার জন্য চারটি সম্ভাবনা তৈরি হয় —

i.          বাবার কাছ থেকে রোগাক্রান্ত X ক্রোমোজোম ও মায়ের কাছ থেকে স্বাভাবিক X ক্রোমোজোম পেয়ে কন্যাসন্তান বাহক হয় — যার সম্ভাবনা ২৫%।

ii.          বাবা ও মা উভয়ের কাছ থেকেই রোগাক্রান্ত X ক্রোমোজোম পেয়ে কন্যাসন্তান রোগাক্রান্ত হয় — যার সম্ভাবনা ২৫%।

iii.         বাবার কাছ থেকে স্বাভাবিক Y ক্রোমোজোম ও মায়ের কাছ থেকে রোগাক্রান্ত X ক্রোমোজোম পেয়ে পুত্রসন্তান রোগাক্রান্ত হয় — যার সম্ভাবনা ২৫%।

iv.         বাবার কাছ থেকে স্বাভাবিক Y ক্রোমোজোম ও মায়ের কাছ থেকে স্বাভাবিক X ক্রোমোজোম পেয়ে পুত্রসন্তান রোগমুক্ত হয় — যার সম্ভাবনা ২৫%। 

বিশদ বিবরণের জন্য চিত্র ৩ দেখুন।

রোগাক্রান্ত মহিলা ও স্বাভাবিক পুরুষের মিলন:- এক্ষেত্রে মহিলার দুটি X ক্রোমোজোমই রোগাক্রান্ত হয় এবং পুরুষের X ও Y দুটি ক্রোমোজোমই স্বাভাবিক হয়। ফলে প্রতিটি গর্ভাবস্থার জন্য দুটি সম্ভাবনা দেখা যায়— 

i.          বাবার কাছ থেকে স্বাভাবিক X ক্রোমোজোম ও মায়ের কাছ থেকে রোগাক্রান্ত X ক্রোমোজোম পেয়ে সকল কন্যাসন্তান বাহক হয় — যার সম্ভাবনা ৫০%।

ii.          বাবার কাছ থেকে স্বাভাবিক Y ক্রোমোজোম ও মায়ের কাছ থেকে রোগাক্রান্ত X ক্রোমোজোম পেয়ে সকল পুত্রসন্তান রোগাক্রান্ত হয় — যার সম্ভাবনা ৫০%।

বিশদ বিবরণের জন্য চিত্র ৪ দেখুন।

রোগাক্রান্ত মহিলা ও রোগাক্রান্ত পুরুষের মিলন:- এক্ষেত্রে মহিলার দুটি X ক্রোমোজোমই রোগাক্রান্ত হয়। পুরুষের X ক্রোমোজোম রোগাক্রান্ত হয় এবং Y ক্রোমোজোম স্বাভাবিক থাকে। ফলে সকল গর্ভাবস্থার জন্য দুটি সম্ভাবনা তৈরি হয়—

i.          বাবার কাছ থেকে রোগাক্রান্ত X ক্রোমোজোম ও মায়ের কাছ থেকেও রোগাক্রান্ত X ক্রোমোজোম পেয়ে সকল কন্যাসন্তান রোগাক্রান্ত হয় — যার সম্ভাবনা ৫০%।

ii.          বাবার কাছ থেকে সুস্থ Y ক্রোমোজোম ও মায়ের কাছ থেকে  রোগাক্রান্ত X ক্রোমোজোম পেয়ে সকল পুত্রসন্তান রোগাক্রান্ত হয় — যার সম্ভাবনা ৫০%। 

বিশদ বিবরণের জন্য চিত্র ৫ দেখুন।

হিমোফিলিয়া বি রোগটি নির্ণয় করার জন্য চিকিৎসকেরা বিভিন্ন পরীক্ষার সাহায্য নিয়ে থাকেন। যেমন:-

§         রক্তে উপস্থিত ক্লটিং ফ্যাক্টরের পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য ফ্যাক্টর IX-এর পরীক্ষা।

§         রক্ত জমাট বাঁধতে কত সময় লাগে তা জানার জন্য থ্রম্বোপ্লাস্টিন পরীক্ষা।

§         রক্ত তঞ্চনের সময় জানার জন্য আরেকটি প্রোথ্রম্বিন পরীক্ষা।

§         রক্তের জমাট বাঁধার ক্ষমতা নির্ণয়ের জন্য ফাইব্রিনোজেন পরীক্ষা।

এই রোগের কোনো প্রতিকার নেই, কিন্তু এর বিভিন্ন লক্ষণগুলি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভিন্ন চিকিৎসা আছে। এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিয়মিত চিকিৎসা অপরিহার্য্য। চিকিৎসা করার কয়েকটি পদ্ধতি হল —

•           ফ্যাক্টর IX ইঞ্জেকশন:-  রক্তক্ষরণ রোধ বা বন্ধ করার জন্য হিমোফিলিয়া রোগকে ফ্যাক্টর IX ইনজেকশন দিয়ে চিকিৎসা করা যেতে পারে। IX ফ্যাক্টর দান করা মানুষের রক্ত থেকে উদ্ভূত হয় বা এটিকে পরীক্ষাগারে তৈরি করা যেতে পারে। কৃত্রিম ফ্যাক্টর IX কে রিকম্বিন্যান্ট ফ্যাক্টর IX বলা হয় এবং এটি নিরাপদ। রক্ত থেকে প্রাপ্ত ফ্যাক্টর IX- তে হেপাটাইটিস বা এইচআইভির মতো বিপজ্জনক রোগজীবাণু থাকতে পারে। কিন্তু বর্তমানে, উন্নত রক্ত-স্ক্রীনিং পদ্ধতির কারণে ফ্যাক্টর IX চিকিৎসা থেকে এইচআইভি এবং হেপাটাইটিস সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকি আগের তুলনায় কম।

•           ক্ষত চিকিৎসা:- হালকা হিমোফিলিয়া বি -এর সংক্রমণ ঘটলে ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য চিকিৎসকেরা ‘ডেসমোপ্রেসিন অ্যাসিটেট’ (desmopressin acetate) নামে একটি ওষুধ ব্যবহার করার কথা বলেন। বড় ক্ষত এবং অভ্যন্তরীণ রক্তপাতের জন্যও চিকিৎসা প্রয়োজন হয়।

•           প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা:- গুরুতর  হিমোফিলিয়া রোগের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত এবং দীর্ঘস্থায়ী রক্তপাত বন্ধ করতে বা কমাতে প্রতিরোধমূলক রক্ত সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা হয়, যা ‘প্রফিল্যাক্সিস’ (prophylaxis) নামে পরিচিত। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। 

চিকিৎসার মাধ্যমে হিমোফিলিয়া বি রোগে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। এই রোগটির কখনো নিরাময় হয় না, তাই এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে চলা প্রয়োজন যেখানে আঘাত লাগা বা রক্তপাত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কোনো অস্ত্রোপচার বা আঘাত লাগার পরে রক্ত তঞ্চিত করার জন্য থেরাপিও প্রয়োগ করা যেতে পারে। নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা না থাকায় এই রোগকে এড়িয়ে চলার একমাত্র উপায় হল সচেতনতা। বিবাহের পূর্বে থ্যালাসেমিয়া বা এইচআইভির মতো হিমোফিলিয়া রোগেরও ‘বাহক পরীক্ষা’ বা carrier test করানো উচিত, এবং দুজন বাহকের মধ্যে বিবাহ এড়িয়ে চলা উচিত। এইভাবেই ধীরে ধীরে এই ভয়াল রোগের প্রকোপ থেকে পৃথিবী মুক্ত হবে।

তথ্যসূত্র


  1. ‘উচ্চতর জীববিদ্যা', দ্বাদশ শ্রেণি, সাঁতরা প্রকাশনী, তৃতীয় মুদ্রণ, ২০১৭, বংশগতি ও বিভেদ, পৃষ্ঠা ২৪০-২৪২

আপনার মতামত জানান