জগদীশ গুপ্ত

জগদীশ গুপ্ত

বাংলা সাহিত্যের ব্যতিক্রমী ধারার একজন কথাশিল্পী জগদীশ গুপ্ত (Jagadish Gupta)। রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালেই মানবজীবনের আলোকিত, সমাজ-স্বীকৃত, কৃত্রিম আদর্শবোধের চেহারার বাইরে তিনি তাঁর সাহিত্যে তুলে এনেছিলেন মানুষের অন্ধকারময় কদর্যরূপ। রবীন্দ্রসাহিত্যের আদর্শের পরিপন্থী হলেও জগদীশ গুপ্তের ‘লঘু-গুরু’ উপন্যাসের সমালোচনা প্রকাশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কর্মজীবনে টাইপিস্ট, কালি-ব্যবসায়ী এবং পত্রিকা-প্রকাশক এইরূপ নানাবিধ ক্ষেত্রে অর্থোপার্জনের চেষ্টা করেছিলেন তিনি। চরিত্রগতভাবে একরোখা আত্মাভিমানী বাঙালি কথাসাহিত্যিক জগদীশ গুপ্তের বহু লেখা আজও অপ্রকাশিত।

১৮৮৬ সালের ৫ জুলাই নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার গড়াই নদী-তীরবর্তী আমলাপাড়া গ্রামে (অধুনা বাংলাদেশ) এক সম্ভ্রান্ত বৈদ্য পরিবারে জগদীশ গুপ্তের জন্ম হয়। তাঁর বাবা কৈলাস চন্দ্র সেনগুপ্ত ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী এবং তাঁর মায়ের নাম সৌদামিনী দেবী। জন্মসূত্রে জগদীশ গুপ্তের নাম ছিল জগদীশ চন্দ্র সেনগুপ্ত, পরবর্তী সময়ে তিনি সেনগুপ্ত পদবি ব্যবহার করে ‘গুপ্ত’ পদবি ব্যবহার শুরু করেন। তাঁদের আদি ভিটে ছিল ফরিদপুরের গোয়ালন্দ মহকুমার অন্তর্গত বালিয়াকান্দি থানার মেঘচুম্বীতে (মতান্তরে মেঘচামী)। জগদীশ গুপ্তের পিতামহ আনন্দ চন্দ্র সেনগুপ্ত ছিলেন মেঘচুম্বী গ্রামের জোতদার। আরো চার ভাই এবং এক বোন থাকলেও জন্মের অল্পদিনের মধ্যেই এক ভাই যতীশ ছাড়া অন্য সকলের মৃত্যু হয়। জগদীশ গুপ্তের স্ত্রীয়ের চারুবালা গুপ্ত।

জগদীশ গুপ্তের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় রামলাল সাহার গ্রামীণ পাঠশালায়। এর পরে তিনি কলকাতায় সিটি কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৯০৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করেন এবং রিপন কলেজে (অধুনা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) ভর্তি হন। ছোট থেকেই তিনি সাহিত্যানুরাগী পাঠক ছিলেন। ছোটবেলায় তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে স্কুলপাঠ্য বইয়ের আড়ালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস পড়তেন। বলা হয় তাঁর এই লুকিয়ে ‘নভেল’ পড়ার অভ্যাসের জন্যই নাকি স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হয়ে বাধ্য হয়ে কলকাতার বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়েছিল জগদীশ গুপ্তকে। টাইফয়েড জ্বরে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার কারণে তাঁর আর কলেজের পড়া সম্পূর্ণ করা হয়নি। ছাত্রাবস্থায় থেকেই তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। ভাওয়াল কবি গোবিন্দচন্দ্র দাসের অনুপ্রেরণায় তিনি যে সমস্ত কবিতা লিখেছিলেন সেসময়, তা স্থানীয় জনমানসে খুব একটা ভালো প্রভাব ফেলেনি। কলেজের পাট চুকিয়ে শর্টহ্যাণ্ড টাইপিং শেখেন তিনি যা পরে তাঁর অন্নসংস্থান জুগিয়েছিল।

১৯০৮ সালে সিউড়ি জেলার জজ কোর্টে টাইপিস্ট হিসেবে জগদীশ গুপ্তের কর্মজীবন শুরু হয়। যদিও সেখান থেকে তাঁর নিয়মিত আয় হত না, মূলত কাজের পরিমাণের ওপর রোজগার নির্ভর করত। ১৯১২ সালে ওড়িশার সম্বলপুরে একটি এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার অফিসে টাইপিস্ট হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। ১৯১৮ সালে তিনি পাটনার হাইকোর্টে টাইপিস্ট হিসেবে কাজ করতে শুরু করলেও ১৯২৪ সালে তিনি সেই কাজে ইস্তফা দেন। এরপর তিনি ঠিক করেন আর তিনি টাইপিস্ট হিসেবে কাজ করবেন না। এরপর বেশ কিছুদিন ব্যবসার কাজে মন দেন জগদীশ গুপ্ত। পত্রিকা প্রকাশ, ছোটোখাটো ‘জেগো’স কালি’-র ব্যবসা কোনোটাতেই সাফল্য পাননি তিনি। টাইপিস্টের চাকরি থেকে পাওয়া আর্থিক পুঁজি কালির ব্যবসায় ঢেলেছিলেন, কিন্তু ব্যবসায়িক বুদ্ধির অভাবে ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়ল। তাই বাধ্য হয়ে সংসার চালাবার তাগিদে ১৯২৭ সালে বোলপুরের চৌকি আদালতে টাইপিস্ট হিসেবে কাজে যোগ দিতে হয় তাঁকে। সেখানে তিনি কোর্টের মক্কেলদের দরকারি কাগজপত্র টাইপ করে দিতেন।

১৯৪৪ সালে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে জগদীশ গুপ্ত বোলপুর ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং লেক মার্কেট অঞ্চলে ক্ষিতীশ গুপ্তের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। পরে যাদবপুরের রামগড় কলোনিতে একটি চলনসই বাড়ি বানিয়ে সেখানেই থাকতে শুরু করেন তিনি। পেশাগত পরিচয়ের বাইরে সাহিত্যিক পরিচয়েই জগদীশ গুপ্ত বেশি পরিচিত। প্রথমে তিনি নিয়মিত কবিতা লিখতেন এবং তাঁর কবিতা ‘উত্তরা’, ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’ এবং ‘সোনার বাংলা’-র মতো বিভিন্ন জনপ্রিয় সাহিত্যপত্রে প্রকাশিত হত। সারাজীবনে অজস্র কবিতা লিখলেও জগদীশ গুপ্তের জীবদ্দশায় তার কয়েকটিমাত্র প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর সমসাময়িক যাঁরা কবিতা লিখতেন তাঁরা মূলত রাবীন্দ্রিক ধারার বিরুদ্ধে গিয়ে কবিতার নতুন ভাষা তৈরি করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু জগদীশ গুপ্ত সে পথে হাঁটেননি। তাঁর লেখার ধরন ছিল সবার থেকে স্বতন্ত্র। ১৯৩২ সালে তাঁর লেখা প্রথম কবিতা সংকলন ‘অক্ষর’ প্রকাশিত হয়। ‘কাশ্যপ ও সুরভী’ তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। পরবর্তীকালে তাঁর বিভিন্ন কবিতা ‘হিন্দু’ এবং ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাঁর শেষ প্রকাশিত কবিতা ‘বিষাক্ত বন্দর’ প্রকাশিত হয় ‘যুগান্তর শারদীয় সংখ্যা’য়। কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি গদ্য লেখাতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ১৯২৫ সালে ‘বিজলী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পেইং গেস্ট’ রচনাটি তাঁর লেখা প্রথম ছোটোগল্প বলে স্বীকৃতি পেলেও তথ্যটি সঠিক নয়। জগদীশ গুপ্তের লেখা প্রথম গল্প ‘জহর’ আর প্রথম প্রকাশিত মৌলিক ছোটগল্প হল ‘তিনটি চুমু’ যা ১৯২৫ সালেই ‘বিজলী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২৮ সালে বন্ধু ব্রজবল্লভ বসুর আগ্রহে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘বিনোদিনী’ যার মাধ্যমে তিনি পাঠকমহলে শ্রদ্ধা এবং সম্মান আদায় করে নিতে সক্ষম হন। এরপর সেই বছরই তাঁর অনেকগুলি গল্প ‘কালিকলম’ এবং ‘কল্লোল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাঁর অনেক লেখাই এখন আর পাওয়া যায় না। জগদীশ গুপ্তের লেখা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপন্যাস হল ‘মহিষী’, ‘রোমন্থন’, ‘রতি ও বিরতি’, ‘সুতিনী’, ‘নন্দ আর কৃষ্ণা’, ‘দুলালের দোলা’, ‘অসাধু সিদ্ধার্থ’ ইত্যাদি।

সারা জীবন ধরে তিনি প্রায় ১২৫টি গল্প রচনা করেন। ১৯২৭ সাল থেকে ১৯৪৪ সালের মধ্যেই তাঁর বেশিরভাগ গল্পগ্রন্থ রচিত হয়েছে। তাঁর রচিত গল্পগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘চন্দ্র-সূর্য যতদিন’, ‘আশা ও আমি’, ‘হার’, ‘আমি ও দেবরাজের স্ত্রী’ ইত্যাদি। তাঁর অন্যতম গল্পগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘মেঘাবৃত’, ‘অশনি’, ‘রূপের বাহিরে’, ‘শশাঙ্ক কবিরাজের স্ত্রী’, ‘শ্রীমতি’। রবীন্দ্রনাথ ‘পরিচয়’ পত্রিকায় জগদীশ গুপ্তের লেখা ‘লঘু গুরু’ উপন্যাসটি সম্পর্কে একটি দীর্ঘ সমালোচনা লেখেন যা তাঁর সাহিত্যজীবনে অপরের রচনা সম্পর্কে লিখিত দীর্ঘতম সমালোচনা। কিন্তু সেই লেখায় নৈপুণ্যের প্রশংসা সত্ত্বেও কঠোর ভাষায় সমালোচনা করায় জগদীশ গুপ্ত ব্যথিত হয়েছিলেন। অন্যদিকে জগদীশ গুপ্তের প্রথম গল্পের বই ‘বিনোদিনী’ পড়ে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট মুগ্ধ হয়েছিলেন। শেষজীবনে জগদীশ গুপ্ত শরৎচন্দ্রের উপন্যাস নিয়ে একটি সমালোচনামূলক বই লিখেছিলেন ‘শেষের পরিচয়’ নামে।

সাহিত্যজীবনের একেবারে প্রথমদিকে ‘গুপ্তের গল্প’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের চেষ্টা করেছিলেন তিনি কিন্তু সেটাও ব্যর্থ হয়। এ প্রসঙ্গে আরো একটি আশ্চর্য তথ্য দেওয়া যেতে পারে, নিঃসন্তান জগদীশ গুপ্ত সুকুমারী নামের একটি মেয়েকে পালিতা কন্যা হিসেবে বড় করেছিলেন এবং সুকুমারীকে কেন্দ্র করে তাঁর লেখা অনেকগুলি কবিতা পাওয়া যায়। জগদীশ গুপ্তের ‘ক্রমে ওঠো উচ্চে’ নামক কবিতা সংকলনে ‘সুকুর খেলা’, ‘সুকুর মিথ্যে কথা’, ‘সুকুর খেদ’, ‘সুকুর আপত্তি’ ইত্যাদি কবিতাগুলি সুকুমারীকে নিয়েই লিখেছিলেন তিনি। জগদীশ গুপ্ত কল্লোল-যুগের সমকালীন লেখক হলেও এবং ‘কল্লোল’ পত্রিকায় লেখালেখি করলেও তিনি কোনোদিনও সেই পত্রিকার দপ্তরে যাননি। সাহিত্য -আড্ডা বা সভাসমিতির প্রতি তাঁর কোন দিনও আকর্ষণ ছিল না। তাঁর স্বভাবে এবং কথাবার্তায় রুচিশীল পরিমিতিবোধ এবং আভিজাত্যের ছাপ ছিল। এছাড়াও তাঁর পড়াশোনার ব্যপ্তি ছিল সুদূর বিস্তৃত। শেক্সপীয়ারের লেখা থেকে শুরু করে মলিয়েঁর-এর নাটক, মোপাসাঁর গল্প ও নানান বিদেশি সাহিত্য বিষয়ে তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিল। তাঁর গল্প বা উপন্যাসের মানুষ যেমন হলে ভালো হত বা হওয়া উচিত ছিল তা না বলে, মানুষ যেমন তেমনভাবেই গল্পে ফুটিয়ে তুলতেন জগদীশ গুপ্ত। মানুষের মধ্যেকার কুৎসিত বীভৎসতা আর কদর্য সম্পর্কের খতিয়ান, মানব মনের অন্ধকার দিকের ছবিই বারবার ফুটে উঠতো তাঁর লেখায়। সাহিত্য রচনা ছাড়াও গান বাজনার প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল এমনকি হারমোনিয়াম বাঁশি এসরাজ ও বেহালাও বাজাতে পারতেন তিনি।

বঞ্চনা যেন ছিল তাঁর নিত্য সঙ্গী। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ১৫০ টাকার সাহিত্য বৃত্তি তাঁর জীবনের একমাত্র স্বীকৃতি, তাও পরে কমে গিয়ে ৭৫ টাকা হয়ে যায়।

১৯৫৭ সালের ১৫ এপ্রিল মাথায় চোট লেগে নিজের বাড়িতেই জগদীশ গুপ্তের মৃত্যু হয়।

2 comments

আপনার মতামত জানান