জাহানারা ইমাম

জাহানারা ইমাম

বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত লেখিকা এবং সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী জাহানারা ইমাম (Jahanara Imam)। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন তিনি। সমগ্র বাংলাদেশবাসীর কাছে তিনি ‘শহীদ জননী’ নামেই সমধিক পরিচিত। একাত্তরের গণসংগ্রামে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রুমী শহীদ হয় আর তাঁর পরই রুমীর বন্ধুরা রুমীর মা জাহানারা ইমামকে সকল মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন এবং সেই থেকেই শহীদ জননী হিসেবে তাঁর পরিচয় গড়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর উদ্যোগেই স্থাপিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’। জাহানারা ইমাম মনে করতেন সাহসই হল সবথেকে বড় হাতিয়ার। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ এবং নারীর অধিকার বিষয়ে আমৃত্যু লড়াই করে গিয়েছেন জাহানারা ইমাম।

১৯২৯ সালের ৩ মে অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে এক রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারে জাহানারা ইমামের জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম জাহানারা বেগম এবং শৈশবে তাঁকে পরিবারে জুডু বলে ডাকা হত। সাত ভাই-বোনের মধ্যে জাহানারাই ছিলেন সবার বড়। জাহানারা ইমামের বাবা সৈয়দ আবদুল আলী পেশায় ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল সৈয়দা হামিদা বেগম। তাঁর বাবার বদলির চাকরির সুবাদে জাহানারা বাংলার বহু জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছেন এবং সেখানে থেকেছেন। সেতাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁ, কখনও বা খেপুপাড়ায় বাল্য ও কৈশোরের অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়েছে তাঁর। দশ থেকে বারো বছর বয়স পর্যন্ত কুড়িগ্রামে সময় কাটিয়েছেন জাহানারা। তাঁদের পরিবারে পর্দাপ্রথা কঠোরভাবে মানা হত, ফলে বারো বছর বয়স হওয়া মাত্র বাড়ির বাইরে যাওয়া অনেকটাই নিষিদ্ধ হয়ে যায় তাঁর। বাড়িতে প্রচুর বই, পত্র-পত্রিকা পাঠের মাধ্যমে অবসর কাটত তাঁর। ১৯৪৮ সালের ৯ আগস্ট সিভিল ইঞ্জিনিয়ার শারীফ ইমামের সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন জাহানারা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রুমী পাকিস্তানি সেনাদের হাতে শহীদ হয় এবং পরে তাঁর স্বামী শারীফও পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত হয়ে প্রচণ্ড আহত হন এবং কিছুদিনের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁরও মৃত্যু হয়।   

বাবার কাছে বাড়িতেই শিক্ষাজীবন শুরু হয় জাহানারা ইমামের। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর এক গৃহশিক্ষকের হাত ধরে বাংলা সাহিত্য এবং বিশ্ব সাহিত্যের বিপুল সম্ভারের সঙ্গে পরিচিত হন তিনি। জাহানারার ইচ্ছে ছিল শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করার, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের সংবাদ পেয়ে তাঁর স্বপ্ন ভেঙে যায়। ১৯৪২ সালে রংপুর থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপরে রংপুরের কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হন জাহানারা। সেই সময় ঐ কলেজে তাঁকে নিয়ে মাত্র তিন জন মুসলিম নারী শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৯৪৫ সালে কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন তিনি। ঐ বছরই লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে ভর্তি হন জাহানারা এবং সেখান থেকে ১৯৪৭ সালে বি.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপরে ১৯৬০ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে বি.এড ডিগ্রি অর্জন করেন জাহানারা ইমাম। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর স্তরের প্রথম পার্টের পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন জাহানারা। এরপরে ১৯৬৪ সালে ফুলব্রাইট বৃত্তি পেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন তিনি উচ্চতর পড়াশোনা করার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের সানডিয়েগো স্টেট কলেজ থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন জাহানারা ইমাম। এর পরের বছর স্নাতকোত্তর স্তরের দ্বিতীয় পার্টের পরীক্ষাও পাশ করেন তিনি।

১৯৪৮ সালে ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন জাহানারা ইমাম। এরপরে ১৯৫২ সালে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার পদেও নিযুক্ত হন তিনি। বাংলাদেশের ঢাকার মধ্যে এই স্কুলকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্কুল হিসেবে গড়ে তোলার পিছনে তাঁর অবদান কম নয়। ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি এখানেই শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৬০ সালে ইমাম তাঁর দুই ছেলে রুমী ও জামীর লালন-পালনের প্রতি মনোনিবেশ করার জন্য প্রধান শিক্ষিকার চাকরিটি ছেড়ে দেন। ১৯৬০ সালেই এডুকেশনাল বোর্ডের প্রতিনিধি হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের পেশোয়ারে সিলেবাস সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন জাহানারা। বুলবুল অ্যাকাডেমি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবেও কিছুদিন কর্মরত ছিলেন জাহানারা। এরপরে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে প্রভাষক হিসেবে যুক্ত থেকেছেন জাহানারা। ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমীর কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৮২-তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে স্বল্পসময়ের জন্য আংশিক সময়ের শিক্ষিকা হিসেবে যুক্ত ছিলেন জাহানারা ইমাম। ঢাকা বেতারেও বেশ কিছুদিন উপস্থাপিকা হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।

শিশু সাহিত্যিক হিসেবেই সাহিত্য জগতে আত্মপ্রকাশ ঘটে জাহানারা ইমামের। ১৯৮৬ সালে প্রকাশ পায় তাঁর সবথেকে চর্চিত ও জনপ্রিয় বই ‘একাত্তরের দিনগুলি’। এই বইতে তাঁর পুত্র রুমী এবং তাঁর স্বামী শরীফের সম্পর্কে অনেক স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন তিনি এই বইতে। তাই জাহানারা ইমামের এই বইটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক জীবন্ত দলিল হিসেবে আজও সমানভাবে স্বীকৃত। ‘খোয়াতীন’ নামের একটি নারী-কেন্দ্রিক মাসিক পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন জাহানারা ইমাম। ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে বহু বছর পর্যন্ত এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময়পর্বে ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় ভ্রমণ করেন তিনি। সাহিত্য জীবনের প্রাথমিক পর্বে লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারের লেখা ‘লিটল হাউস’ বইটি অনুবাদ করেছিলেন জাহানারা ইমাম। গল্প-উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী, অনুবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অনায়াস যাতায়াত ছিল।

মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন জাহানারা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য যারপরনাই চেষ্টা করেছেন তিনি। ঢাকায় গেরিলা আক্রমণকারীদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করা, চিকিৎসার জন্য ডাক্তার ও ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করা এমনকি অর্থ সংস্থানেরও চেষ্টা করেছেন তিনি। তাছাড়া ছোট ছোট প্যাকেটবন্দি করে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সরবরাহ করতেন জাহানারা ইমাম। তাঁর বাড়িতেই বহু গেরিলা যোদ্ধা আশ্রয় নিতেন। ফলে সব সময়ের জন্য মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলা বাহিনীর সদস্যদের জন্য খাবারের রসদ প্রস্তুত রাখতেন তিনি। ১৯৮০ সালের দিকে সক্রিয়ভাবে রাজনীতির মঞ্চে পা রাখেন জাহানারা ইমাম। বাংলাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ধ্বংস করতে সচেষ্ট হন তিনি। তাঁর উদ্যোগে ও নেতৃত্বেই ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’। ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলায় আন্দোলন বিস্তারের জন্য তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। আন্দোলনকারীদের মধ্যে যারা শিক্ষার্থী তাঁদের প্রভূত সহায়তা করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের শাসক হিসেবে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বহু বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ‘জামাত-ই-ইসলামী’র উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিলেন তিনি। এই গোষ্ঠীর মদতেই আল-বদর, আল-শাম, রাজাকার বাহিনী সাধারণ মানুষের উপর নির্বিচারে নির্যাতন চালিয়েছে। জামাত-ই-ইসলামীর নির্বাসিত প্রধান গুলাম আজমকে ঐ বছরই বাংলাদেশে ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে জামাত-ই-ইসলামীর আমীর পদে অভিষিক্ত হন তিনি। এই সময়েই জাহানারা ইমাম তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’র মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় যে সকল ব্যক্তি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশি আপামর জনগণের উপর অত্যাচার চালিয়েছে, নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে বিচারসভা বসানোর দাবি জানান। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ এই কমিটির উদ্যোগে ঢাকায় গণ-আদালত বসে এবং সেখানে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। তৎকালীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী পার্টির গঠিত সরকারের কাছে এই যুদ্ধাপরাধীদের প্রকৃত সাজা দেওয়ার আবেদন করেন জাহানারা ইমাম, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে ১৯৯৬ সালে এই আবেদন খারিজ করে দেয় মহম্মদ হাবিবুর রহমানের সরকার।  

১৯৮২ সালের শেষ দিকে দুরারোগ্য ওরাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হন জাহানারা ইমাম। চিকিৎসা চলছিল, কিন্তু ১৯৯২ সালের দিকে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। ১৯৯৪ সালে উন্নত মানের চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ডেট্রয়েটে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেন জাহানারা ইমাম। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থাতেও হাসপাতালের বিছানা থেকে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে নানাবিধ পরামর্শ দিতেন জাহানারা।

১৯৯৪ সালের ২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের ডেট্রয়েটে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালীনই জাহানারা ইমামের মৃত্যু হয়।      

2 comments

আপনার মতামত জানান