দ্বাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত একজন সংস্কৃত কবি জয়দেব (Jayadeva)। তাঁর রচিত ‘গীতগোবিন্দম্’ কাব্য থেকেই পরবর্তীকালে বৈষ্ণব পদাবলীর সূচনা হয় বলে অনেকেরই ধারণা। তাঁকে ওড়িশি সঙ্গীতের জনকও বলা হয়ে থাকে। তাঁর রচিত ‘গীতগোবিন্দম্’-এর দুটি স্তোত্র শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘গুরু গ্রন্থ সাহিব’-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভায় ‘বসন্তরাগ’ গেয়ে পত্রহীন অশ্বত্থ গাছকে নতুন পাতায় ভরে দিয়ে এবং বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ব্যুঢ়ন মিশ্রকে প্রতিযোগিতায় পরাজিত করে তৎকালীন বাংলার শাসক রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবির পদ অলঙ্কৃত করেন তিনি। তাঁর জন্মভূমি বীরভূমের কেঁন্দুলিতে তাঁর নামে প্রতি বছর পৌষসংক্রান্তিতে ‘জয়দেবের মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়।
দ্বাদশ শতাব্দীতে বৈদ্য ব্রাহ্মণ জয়দেবের জন্ম হয় বলে অনুমান করা হয়। তাঁর পুরো নাম জয়দেব গোস্বামী। তাঁর জন্মস্থান নিয়ে বির্তক রয়েছে। কারো মতে, তিনি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় কেন্দুবিল্ব গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, জয়দেবের জন্ম হয় পাশ্ববর্তী রাজ্য উড়িষ্যায় পুরীর প্রাচী নদীর ধারে কেন্দুবিল্ব গ্রামে। আবার অনেকের মতে, মিথিলা তথা অধুনা বিহারের ঝাঁঝরপুরের নিকটস্থ কেঁদুলি গ্রামে জয়দেবের জন্ম হয়েছে। জয়দেবের বাবার নাম ভোজদেব ও মায়ের নাম বামদেবী বলে তিনি তাঁর কাব্য ‘গীতগোবিন্দম্’-এ উল্লেখ করেছেন। সাধারণ ব্রাহ্মণ হিসেবে শ্রীকৃষ্ণসহ শিবের পূজারি ছিলেন তিনি। পুরীর মন্দিরের শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, সংস্কৃত ভাষা ও সঙ্গীতে জয়দেবের অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। লিঙ্গরাজ মন্দির, সিংহচল মন্দির ও মধুকেশ্বর মন্দিরের শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, তাঁর ছোটবেলা কেন্দুলিতেই কেটেছে।
এরপরে তিনি উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য ওড়িশার কোনারকের কুর্মাপাটক নামে একটি গ্রামে সংস্কৃত বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। এখানেই তিনি নৃত্য, গীতের প্রশিক্ষণ নেন এবং এই চারুকলাদিতে পটু হয়ে ওঠেন। জয়দেব দয়ানিধি নামে এক কাশীর সন্ন্যাসীর কাছে দীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাস নেওয়ার জন্য নীলাচলের উদ্দেশ্যে (অধুনা পুরী) যাত্রা করেন। কিন্তু যাত্রার মাঝপথে বাধা পেয়ে ফিরে আসেন এবং পদ্মাবতীকে বিবাহ করে সংসারী হন। জয়দেবের স্ত্রী পদ্মাবতীও ছিলেন সঙ্গীত ও নৃত্যে পারদর্শী। জয়দেবের জীবনে পদ্মাবতীর অসীম গুরুত্ব ছিল। কারো মতে, পদ্মাবতী ছিলেন জয়দেবের ছাত্রী। মূলত তাকেই নিজের সাধনসঙ্গী করে কবি জয়দেব শ্রীকৃষ্ণের সাধনা করতেন। ‘পদ্মাবতী সুখসমাজ’ নামে তাঁদের গীতিনাট্যের একটি দল ছিল। তাঁদের এই দলে জয়দেব কৃষ্ণের উক্তি ও গানগুলিকে গাইতেন এবং পদ্মাবতী রাধার উক্তিগুলিকে নৃত্যের মাধ্যমে পরিবেশন করতেন।
লিঙ্গরাজ মন্দির, সিংহচল মন্দির ও মধুকেশ্বর মন্দিরের শিলালিপি থেকে কবি জয়দেবের কর্মজীবন সর্ম্পকেও অল্পবিস্তর জানা যায়। তিনি কুর্মাপাটক গ্রামের বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন এবং এই বিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতির সদস্য ছিলেন বলেও অনুমান করা হয়। জয়দেবের সঙ্গীত প্রতিভা ছিল অসাধারণ। তিনি রাজা লক্ষণ সেনের সভায় বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ব্যুঢ়ন মিশ্রকে সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় পরাজিত করেন। ‘সেকশুভোদয়া’ গ্রন্থানুসারে বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ব্যুঢ়ন মিশ্র ওড়িশা বিজয় সেরে রাজা লক্ষণ সেনের রাজসভায় ‘পটমঞ্জরী’ রাগ গেয়ে অশ্বত্থগাছের সমস্ত পাতা ঝরিয়ে দিয়েছিলেন। রাজা তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে জয়পত্র দিতে যাবেন, সেই মুহূর্তে জয়দেব ও পদ্মাবতী রাজসমীপে হাজির হয়ে ব্যুঢ়ন মিশ্রকে প্রতিযোগিতায় আহ্বান জানান। পদ্মাবতী গান্ধার রাগ পরিবেশন করেন। তাঁর অপূর্ব গায়কী সভাপারিষদদের মুগ্ধ করলেও ব্যুঢ়ন মিশ্র একজন নারীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবেন না বলে ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণার পর জয়দেব সেই সভায় ‘বসন্তরাগ’ পরিবেশন করেন। তাঁর গলায় বসন্তরাগের আলাপে রাজাসহ সভাপারিষদগণ মুগ্ধ হন। গান শেষে দেখা যায় পত্রহীন অশ্বত্থ গাছ অসংখ্য কচি পাতায় ভরে গেছে। এমন আশ্চর্য ঘটনায় বিমোহিত হয়ে এবং তাঁর সঙ্গীতপ্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বাংলার সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেন তাঁকে সভাকবির পদে অধিষ্ঠিত করেন।
তিনি ছিলেন লক্ষ্মণ সেনের সভার পঞ্চরত্নের একজন।
জয়দেব তাঁর সারাজীবন উৎসর্গ করেছিলেন কৃষ্ণপ্রেমে। তাঁর সাধনার ধারা ছিল নিষ্কাম পরকীয়া সাধনা। তাঁর সাধনা প্রতিফলিত হয় তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থ ‘গীতগোবিন্দম্’-এ। ১১৫৯ সালে রচিত জয়দেবের এই ভক্তিমূলক কাব্যগ্রন্থের মূল বিষয় শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকার প্রেম। ‘গীতগোবিন্দম্’ কাব্যগ্রন্থটি গীতিকাব্য হলেও এর মধ্যে নাটকীয়তা বিদ্যমান। মূলত রাধা ও তাঁর সখীদের উক্তি ও কৃষ্ণের উক্তিগুলি নিয়েই এই কাব্যের পদগুলি রচনা করেছেন জয়দেব । এই কাব্যের বিষয়বস্তু বসন্তকালে রাধা রাস ত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণের সন্ধান করছেন। শ্রীকৃষ্ণের সন্ধানে এসে রাধা তাকে অন্য ব্রজবালার সঙ্গে আবিষ্কার করেন এবং অভিমানে নির্জনে লুকিয়ে পড়েন। শ্রীকৃষ্ণ নিজের ভুল বুঝে রাধার মানভজ্ঞনের জন্য তাঁর সন্ধান করতে থাকেন। রাধার মানভঞ্জনের জন্য শ্রীকৃষ্ণ রাধার দুটি রাঙা পা ধরে কাঁদতে থাকেন। প্রেমমূলক কাব্য হলেও এটি ভক্তিরস সমৃদ্ধ একটি গীতিকাব্য। রাধা-কৃষ্ণের বিরহ, প্রেম ও মিলনকে জয়দেব মোট বারোটি সর্গে বিভক্ত করে এই কাব্যে পরিবেশন করেছেন। এই বারোটি সর্গের প্রতিটির আলাদা অর্থবহ নাম আছে। নামগুলি হল যথাক্রমে ‘সাতোদ দামোদর’, ‘অক্লেশ কেশব’, ‘মুগ্ধ মধুসূদন’, ‘স্নিগ্ধ মধুসূদন’, সাকাঙ্খ পুণ্ডরীকাক্ষ’, ‘ধৃষ্ট বৈকুন্ঠ’, ‘নাগর নারায়ণ’, ‘বিলক্ষ লক্ষ্মীপতিঃ’, ‘মুগ্ধ মুকুন্দ’, ‘মুগ্ধ মাধব’, সানন্দ গোবিন্দ’ ও ‘সুপ্রীত পীতাম্বর’। প্রাচীন সংস্কৃত ভাষা এবং পরবর্তী যুগের অপভ্রংশ ভাষার সমন্বয় দেখা যায় এই কাব্যগ্রন্থে। ‘গীতগোবিন্দম্’-এর বারোটি সর্গে ২৪টি গান বিভিন্ন রাগ রাগিণী ও তালের প্রয়োগে অত্যন্ত শ্রুতিমধুর। প্রথম দিকে জয়দেব এই গানগুলিকে অপভ্রংশ ভাষায় রচনা করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে এই গানগুলি জনপ্রিয়তা লাভ করলে তিনি স্বয়ং সংস্কৃত ভাষায় সেগুলি অনুবাদ করেন। এর ফলে গানগুলিতে ছন্দের গতি বৃদ্ধি পেয়ে তা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। জয়দেব সংস্কৃত ভাষায় এই কাব্যটি রচনা করলেও এই কাব্যের ছন্দ ও ভাষাশৈলী ছিল সহজ সরল। কাব্যের শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকার প্রেমের মধ্য দিয়েই তিনি আসলে ভক্তের সঙ্গে দেবতার প্রেমের স্বরূপকে ফুটিয়ে তুলেছেন। শোনা যায়, এই কাব্যের ‘দেহিপদপল্লবমুদারং’ অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ রাধার পায়ে মাথা রেখেছেন এই শ্লোকটি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ নাকি জয়দেবের অবর্তমানে তাঁর পুঁথিতে লিখে রেখে গিয়েছিলেন।
জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম্’-এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। বাংলার সঙ্গীত ও কাব্যে ‘গীতগোবিন্দম্’-এর প্রভাব দেখা যায় প্রবলভাবে। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছে এই গ্রন্থের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। জয়দেবের পরবর্তী কবি যেমন বড়ু চণ্ডীদাসের রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ ও ‘সদুক্তি কর্ণামৃত’ গ্রন্থে জয়দেবের রচিত ‘গীতগোবিন্দম্’-এর শ্লোকের অণুকরণ লক্ষ্য করা যায়। দীর্ঘদিন ধরে পুরীর মন্দিরে ‘গীতগোবিন্দম্’-এর শ্লোক পাঠ করা হত। ভক্তি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ শ্রী চৈতন্যদেব এই কাব্যটি নিয়মিত পাঠ করতেন বলে শোনা যায়। বাংলা ছাড়াও ওড়িয়া সংস্কৃতিতে জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম্’-এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। জয়দেবকে ওড়িশি সঙ্গীতের একজন বিশেষজ্ঞ
বলে মনে করা হয়। প্রাচীন ওড়িয়া ভাষায় লেখা জয়দেবের কয়েকটি কবিতা ওড়িশার সংস্কৃতি দপ্তরের দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ‘গীতগোবিন্দম্’-এর দুটি শ্লোক শিখদের ধর্মগ্রন্থ ‘গ্রন্থসাহিব’-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দাক্ষ্যিণাত্যের সংস্কৃতিতেও কবি জয়দেবের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ১৯৩৮ সালে এবং ১৯৬১ সালে তেলেগু ভাষায় জয়দেবকে নিয়ে ‘ভক্ত জয়দেব’ নামে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। ১৯৪১ সালে বাংলায় ‘কবি জয়দেব’ নামেও অপর একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায় যাতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন অভিনেতা হীরেন বোস। ১৭৯২ সালে স্যার উইলিয়াম জোন্স ‘গীতগোবিন্দম্’-এর ইংরেজি অনুবাদ করেন। পরে জার্মান, ফরাসিসহ বিভিন্ন ভাষায় এই কাব্যগ্রন্থ অনূদিত হয়েছে। এছাড়াও বাংলা, হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া, মারাঠি ইত্যাদি ভারতীয় ভাষাতেও ‘গীতগোবিন্দম্’-এর বহু অনুবাদ হয়েছে। জয়দেবের জন্মস্থান কেঁন্দুলিতে প্রতিবছর পৌষ সংক্রান্তিতে মেলা হয়। ১৮৮২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে জয়দেবের কেন্দুলি মেলার কথা উল্লেখ করেছেন। কথিত আছে, পৌষ সংক্রান্তিতে কবি জয়দেব প্রতি বছরই গঙ্গা স্নানে যেতেন। একবার অসুবিধার জন্য যেতে পারেননি। মা গঙ্গা জয়দেবকে স্বপ্নবাণী দেন যে তিনি অজয়ের জলে স্রোত বেয়ে কদমখণ্ডীর ঘাটে তাঁকে দেখা দেবেন। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী পৌষ সংক্রান্তির দিন ভোরবেলা কবি জয়দেব কদমখণ্ডীর ঘাটে মা গঙ্গার কঙ্কণপরা হাতের দর্শন পান। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিতে জয়দেবের মেলা বসে। আবার অনেকের মতে, পৌষ সংক্রান্তিতে কবি জয়দেবের মৃত্যু হয়েছিল। তাঁর মৃত্যু তিথি উপলক্ষ্যে জয়দেবের মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
অনুমান করা হয় যে দ্বাদশ শতাব্দীরই কোনও এক পৌষ সংক্রান্তিতে তিথিতে জয়দেবের মৃত্যু হয়।