ভারতীয় আন্তর্জাতিক ফুটবলের প্রবাদপ্রতিম ডিফেন্ডার ছিলেন শৈলেন মান্না (Sailen Manna)। তাঁর আসল নাম ছিল শৈলেন্দ্রনাথ মান্না। অলিম্পিক এবং এশিয়ান গেমসে নেতৃত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ভারতকে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করে শৈলেন মান্না এক নতুন ইতিহাস রচনা করেন। কুড়ি বছরের ফুটবলজীবনে ডিফেন্ডার হিসেবে খেললেও তিনি কোনোদিন হলুদ বা লাল কার্ড দেখেননি। অত্যন্ত বিনয়ী, মার্জিত স্বভাবের মানুষ ছিলেন তিনি। দলের অন্যদের খাওয়া না হলে নিজে খেতেন না। নিজের প্রিয় দল মোহনবাগানে খেলার জন্য কোনো দিন একটি টাকাও পারিশ্রমিক নেননি। তিনি এশিয়ার একমাত্র খেলোয়াড় যিনি ১৯৫৩ সালে ইংল্যান্ড ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত বিশ্বের ১০ জন সেরা অধিনায়কের তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন। খেলোয়াড় হোক বা প্রশিক্ষক বা ক্লাবের কর্মকর্তা, সমস্ত রকম ভূমিকাতেই ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে শৈলেন মান্নার অবদান অনস্বীকার্য।
১৯২৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার ব্যাঁটরায় শৈলেন মান্নার জন্ম হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে তিনি স্নাতক হন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি ফুটবল খেলা শুরু করেন। ১৬ বছর বয়সে শৈলেন মান্না হাওড়া ইউনিয়ন ক্লাবে যোগ দেন। ১৯৪১ সালে ইন্টার-ইউনিভার্সিটি প্রতিযোগিতায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলেন। ১৯৪২ সালে হাওড়া ইউনিয়ন ক্লাব ছেড়ে তিনি মোহনবগান অ্যাথলেটিক ক্লাবে খেলা শুরু করেন। ১৯৬০ সালে অবসর নেওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ আঠারো বছর তিনি এই ক্লাবের হয়েই খেলেছেন।
মোহনবাগানের হয়ে সুদীর্ঘ ১৯ বছর খেলার মধ্যে ১৯৫০ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছর তাঁকে মোহনবাগান ক্লাবের অধিনায়কের ভূমিকায় দেখা যায়। কিন্তু, কখনই তিনি এই ক্লাবের হয়ে খেলার জন্য কোনোরকম পারিশ্রমিক নেননি। তিনি জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে চাকরি করতেন। সেখান থেকে পাওয়া মাইনেতেই সন্তুষ্ট ছিলেন তিনি। তাঁর অধিনায়কত্বেই মোহনবাগান ৫ বার ডুরান্ড কাপ এবং ৬ বার আই এফ এ শিল্ড জেতে। এমনকি তিনি পশ্চিমবঙ্গ ফুটবল দলেও অধিনায়কত্ব করেন।
শুধু জাতীয় স্তরেই নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও শৈলেন মান্না নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেন, এবং ভারতীয় ফুটবলকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকে তিনি ভারতীয় জাতীয় ফুটবলের প্রতিনিধিত্ব করেন। ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে এটি ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক সফর। এই টুর্নামেন্টে শৈলেন মান্না ফ্রান্সের বিরুদ্ধে একটি ম্যাচে পেনাল্টি মিস করেন। ফ্রান্সের কাছে ২-১ গোলে হারলেও ভারতীয় ফুটবল টিমের একাগ্রতা সবার নজর কাড়ে। খালি পায়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হাল না ছেড়ে লড়াই করে যাওয়ার মানসিকতার জন্য গোটা ফুটবল সমাজ ভারতীয় ফুটবল দলের প্রশংসা করে।এমনকি, রাজকুমারী মার্গারেটও তাঁদের ভূয়ষী প্রশংসা করেন। বাকিংহাম প্যালেসে তিনি সরাসরি শৈলেন মান্নাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে খালি পায়ে খেলেও তিনি কীভাবে এত ভাল রক্ষণ করতে পারেন? উত্তরে মৃদুভাষী শৈলেন উত্তর দিয়েছিলেন যে, খেলার আসল শক্তিটা থাকে মাথায়। স্বাধীনতার পরে একটি ফুটবল-শিক্ষিত জাতি হিসেবে ভারতের পুনরুত্থান ঘটাতে শৈলেন মান্নার প্রচুর অবদান রয়েছে। তাঁর অধিনায়কত্বেই ১৯৫১ সালে ভারত এশিয়ান গেমসে সোনা পায়। এমনকি, ১৯৫২ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত টানা চার বছর কোয়াড্রাঙ্গুলার টুর্নামেন্টেও জেতে। ১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি অলিম্পিকেও তিনি ভারতের অধিনায়ক ছিলেন এবং ১৯৫৪ সালের এশিয়ান গেমসে ভারতীয় দলের একজন সদস্য ছিলেন।
প্রবলপরাক্রমী এই ডিফেন্ডার খেলাধূলার বিষয়ে কিছুটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন। খেলা চলাকালীন পকেটে মা কালীর ছবি রাখতেন। ফুটবল জীবনে তাঁর মাত্র দুটি আফশোস রয়ে গিয়েছে। এক হল, লন্ডন অলিম্পিকে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রথম পেনাল্টিটি মিস করা এবং আবার মিস করতে পারেন এই ভেবে দ্বিতীয়বার পেনাল্টি গোল করার সুযোপ না নেওয়া। দ্বিতীয়টি হল, তাঁর অধিনায়কত্বে ভারতীয় ফুটবল দলের ১৯৫০ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপে না যাওয়া।
১৯৬০ সালে খেলা ছেড়ে দেওয়ার পরে ১৯৬১ সালেই তিনি মোহনবাগান ক্লাবের প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। ক্রমশ তিনি মোহনবাগান দলের প্রশাসনিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। প্রথমে তাঁকে ক্লাবের ফুটবল সম্পাদক করা হয়, পরে তিনি সহসম্পাদকের পদে উন্নীত হন।
১৯৭১ সালে গোষ্ঠ পালের পরে দ্বিতীয় ফুটবলার হিসেবে তিনি ভারত সরকারের তরফ থেকে পদ্মশ্রী পান। ২০০০ সালে সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন শৈলেন মান্নাকে ‘ফুটবলার অফ দ্য মিলেনিয়াম’ সম্মানে ভূষিত করে। ২০০১ সাল তিনি মোহনবাগান রত্ন পান।
শৈলেন মান্নার স্ত্রীয়ের নাম ছিল আভা এবং কন্যার নাম নীলাঞ্জনা মান্না। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পরে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ২০১২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ৮৭ বছর বয়সে শৈলেন মান্নার মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুতে ভারতীয় ফুটবলজগতের আকাশ থেকে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক চিরতরে হারিয়ে যায়।
One comment