
গাড়ি চালানোর সময় সিগন্যাল না মেনে আচমকা যদি কোনও লোকে রাস্তা পাড় হয়, খুব বিরক্ত লাগে, মুখ থেকে বেরিয়ে আসে বিরক্তিসূচক শব্দ, মানুষভেদে গালাগালিও। কিন্তু দুপাশে সবুজ বনের মাঝে পিচ বাঁধানো রাস্তা দিয়ে যখন গাড়ি ছুটে চলে আর সিগন্যাল না মেনে একইভাবে হাতি বা হরিণের দল পাড় হয়, তখন কিন্তু ঐ একই মানুষটার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে অন্য এক বিশেষণ, “বাঃ”। সে গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে যায় এই নৈসর্গিক দৃশ্য দেখার জন্য। তবে সব সময় যে হরিণ বা হাতি দেখা যাবে তা নয়, যেটা সবসময় দেখা যাবে সেটা এই প্রকৃতির শোভা, বনের শোভা। বাঁকুড়ার জয়পুর জঙ্গল যেখানে দুদিন থাকলেই সেই অভিজ্ঞতা সহজে ভোলার নয়। সব মিলিয়ে এটাই বলা যায় সপ্তাহের শেষে একদিনের বা বড়জোর দুদিনের জন্য সমুদ্র দেখতে হলে যেমন মন্দারমনি বা তাজপুর আদর্শ জায়গা, তেমনই জঙ্গলের জন্য আদর্শ জায়গা এই জয়পুর জঙ্গল।

জয়পুর জঙ্গল পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলায় অবস্থিত ঘন জঙ্গল, যেখানে প্রধানত শাল, সেগুন, পলাশ, কুসুম, মহুয়া, নিম এইসব গাছ দ্বারা পূর্ণ। সুন্দরবনের মত এই জঙ্গল এতটা বিখ্যাত না হলেও ফেলনা কিন্তু মোটেও না। এই জঙ্গলের কিছু কিছু জায়গা এতটাই গভীর যে সূর্যের আলো মাটি অবধি আসতে অনেক বেগ পেতে হয়। আর শুধু সবুজের ঘনত্বই না, এখানে বেশ কিছু বন্যপ্রাণীর বাস। বন্যপ্রাণীর কথাই যখন এল, তখন প্রথমেই যার নাম উল্লেখ করা যায় তারা হল চিতল হরিণ। সারা ভারতেই এই চিতল হরিণের বাসস্থান। আর জয়পুর জঙ্গলে তো প্রায়শই চিতল হরিণের দেখা মেলে। হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তা পাড় হতে হতে হয়ত দেখতে পাবেন এদের, যখন এরাও রাস্তা পাড় হচ্ছে। এছাড়াও হাতি, বন্য শেয়াল বা নেকড়েও আছে জঙ্গলে। কপালে থাকলে হাতির দর্শনও হয়ে যায় মাঝে মাঝে। আর আছে ভোরবেলায় বিভিন্ন পাখির কোলাহল। রাতে হোটেলে বা রিসোর্টে বসে যখন জঙ্গল থেকে ঝি ঝি পোকার ডাক ছাড়াও আরও জানা অজানা কিছু আওয়াজ শুনতে পাবেন, তখন মনের মধ্যে যে রোমাঞ্চ আসবে, সেটির অনুভূতি পেতে একবার যেতেই হবে জয়পুর জঙ্গল।
কলকাতা থেকে জয়পুরের দুরত্ব প্রায় ২০০ কিমি -এর মত। ট্রেনে করে আসলে কাছাকাছি স্টেশন বিষ্ণুপুর। সেখান থেকে গাড়ি করে জয়পুর জঙ্গলে আসা যায়। বিষ্ণুপুর থেকে জয়পুর জঙ্গলের দুরত্ব ১২ কিমি। সুবিধার জন্য হাওড়া এবং তার পার্শ্ববর্তী স্টেশন থেকে বিষ্ণুপুরের ট্রেনের সময়সূচী এখানে দেওয়া হল।
ট্রেন নাম্বার | ট্রেনের নাম | কোথা থেকে ছাড়বে | কখন ছাড়বে | বিষ্ণুপুর কখন পৌঁছবে | কোন দিন চলে |
---|---|---|---|---|---|
১২৮৮৩ | রূপসী বাংলা | সাঁতরাগাছি | সকাল ৬টা ২৫ মিনিট | সকাল ৯টা ৩৫ মিনিট | সবদিন |
১২৮৮৫ | আরণ্যক এক্সপ্রেস | শালিমার | সকাল ৭টা ৪৫ মিনিট | সকাল ১১টা ১১ মিনিট | সোম থেকে শনি |
১৮৬২৭ | হাওড়া রাঁচি ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস | হাওড়া | দুপুর ১২টা ৫০ মিনিট | বিকেল ৪টে ১৭ মিনিট | রবি, সোম, মঙ্গল |
১২৮২৭ | হাওড়া পুরুলিয়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস | হাওড়া | বিকেল ৪টে ৫০ মিনিট | রাত ৮টা ৩ মিনিট | সবদিন |
৫৮০১১ | হাওড়া চক্রধরপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার | হাওড়া | রাত ১১টা ৫ মিনিট | ভোর ৩টে ২৯ মিনিট | সবদিন |
৫৮০১৩ | হাওড়া বোকারো স্টিল সিটি ফাস্ট প্যাসেঞ্জার | হাওড়া | রাত ১১টা ৫ মিনিট | ভোর ৩টে ২৯ মিনিট | সবদিন |

আর বাসে করে আসতে চাইলে কলকাতা থেকে বিষ্ণুপুরগামী কোন বাসে চেপে বিষ্ণুপুর ,তারপর সেখান থেকে গাড়ি করে জয়পুর জঙ্গল। কলকাতার ধর্মতলা থেকে বিষ্ণুপুরের জন্য বাস পাওয়া যায়। আর গাড়ি নিয়ে আসতে চাইলে সময় লাগে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার মত। এই তথ্য ২০১৯ সালে শেষ আপডেট করা হয়েছে।
জয়পুর জঙ্গলে থাকার বেশ কিছু হোটেল বা রিসোর্ট আছে। তবে এখানে কোন রিসোর্ট বা হোটেল বুক করবার আগে অবশ্যই তার অবস্থান এবং ঘরের অবস্থা দেখে নেবেন। এখানে এই পরিবেশ উপভোগ করার জন্য এটা কিন্তু খুব জরুরী। এখানে ফ্যামিলি বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে অনেকেই সপ্তাহের শেষে ঘুরতে আসেন। অনেকে আবার বিষ্ণুপুর অবধি এসে সেখানেই থেকে যান। তারপর হোটেলের থেকে গাড়ির ব্যবস্থা করে জয়পুর জঙ্গল ঘুরে আসেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে যখন তখন বেরিয়ে সামনেই হরিণ দেখতে পাওয়া বা জঙ্গলের শোভা উপভোগ করা হয়ে ওঠে না। তবে বিষ্ণুপুরে থেকে একদিনের ভ্রমণের জন্য যদি জয়পুর জঙ্গল আসেন, তাহলে সেটা অন্য কথা।
জয়পুর জঙ্গলে থাকলে আশেপাশে ঘোরার জায়গা বলতে অবশ্যই এই জঙ্গল। ভোরবেলা বা বিকালবেলা জঙ্গলের যে অপূর্ব এক শোভা আর তার সাথে বিভিন্ন পাখির কলরবে প্রাণ জুড়িয়ে যাবে। সপ্তাহের শেষে একদিন যদি হাতে সময় থাকে আর জঙ্গলের শোভা উপভোগ করতে চান, তাহলে একদম ঠিক জায়গা এটা। দুদিন আরাম করে থাকার জন্য এই জায়গাটি উপযুক্ত। এখানে জঙ্গলের মধ্যে একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে, সেখানে উঠে অপেক্ষা করতে পারেন কিন্তু কোন জন্তু যে দেখা যাবেই এরকম নয়। আবার হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের একটু ভেতরে যেতেই পারেন। কিন্তু সঙ্গে স্থানীয় কাউকে নিয়ে নিয়ে বেরনো ভালো। একা একদমই ভেতরে যাওয়া উচিত নয়। যে কোন মুহূর্তেই পথ হারিয়ে যেতে পারে। সাইটসিইং হিসাবে প্রথমেই নাম আসবে বিষ্ণুপুর। গাড়ি নিয়ে বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার শোভা দেখে আসতে পারেন। জয়পুর জঙ্গল থেকে মুকুটমণিপুরও যাওয়া যায়। তবে এখান থেকে মুকুটমণিপুর প্রায় ৯৫ কিমি।

সারা বছর ধরেই এটি খোলা থাকে। তবে গ্রীষ্মকালে না যাওয়াই ভালো। সে সময় বাঁকুড়া বেশ গরম থাকে। বর্ষার সময় জঙ্গল হয়ে ওঠে সবুজ। তবে বর্ষাতে গেলে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। বিশেষ করে হোটেল ঘরে সাপ বা ব্যাং ঢুকে পড়া খুব একটা অস্বাভাবিক নয়।
জয়পুর জঙ্গলে কেনাকাটার বিশেষ কিছু নেই। তবে কেনাকাটার জন্য আপনি চলে আসতে পারেন বিষ্ণুপুরে। সেখানে কেনাকাটার প্রচুর জিনিস পাবেন।
জঙ্গলে এখানে একা একা ঘুরতে বেরবেন না। এই জঙ্গল গভীর এবং এখানে পথ হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তবে জঙ্গলের সবুজ আপনাকে প্রচণ্ড আকর্ষণ করলে আপনি কোন স্থানীয় কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন। সন্ধ্যে হওয়ার আগে অবশ্যই ফিরে আসুন হোটেলে। জঙ্গলে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত জুতো সঙ্গে নেবেন।
ট্রিপ টিপস
- কিভাবে যাবেনঃ কলকাতা থেকে জয়পুরের দুরত্ব প্রায় ২০০ কিমি -এর মত। নিজের গাড়ি বা ভাড়া গাড়ি করে আসতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার মত। ট্রেনে করে আসলে কাছাকাছি স্টেশন বিষ্ণুপুর। সেখান থেকে গাড়ি করে জয়পুর জঙ্গলে আসা যায়। বিষ্ণুপুর স্টেশন থেকে জয়পুর জঙ্গলের দুরত্ব ১২ কিমি । আর বাসে করে আসতে চাইলে কলকাতা থেকে বিষ্ণুপুরগামী কোন বাসে চেপে বিষ্ণুপুর ,তারপর সেখান থেকে গাড়ি করে জয়পুর জঙ্গল।
- কোথায় থাকবেনঃ জয়পুর জঙ্গলে থাকার বেশ কিছু হোটেল বা রিসোর্ট আছে। তবে কোন রিসোর্ট বা হোটেল বুক করবার আগে অবশ্যই তার অবস্থান এবং ঘরের অবস্থা দেখে নেবেন। এখানে এই পরিবেশ উপভোগ করার জন্য এটা কিন্তু খুব জরুরী।
- কি দেখবেনঃ জয়পুর জঙ্গলে থাকলে আশেপাশে ঘোরার জায়গা বলতে অবশ্যই এই জঙ্গল। জঙ্গল ঘুরে দেখুন ভোরবেলা বা বিকালবেলা। আর সাইটসিইং হিসাবে প্রথমেই নাম আসবে বিষ্ণুপুর। গাড়ি নিয়ে বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার শোভা দেখে আসতে পারেন। জয়পুর জঙ্গল থেকে মুকুটমণিপুরও যাওয়া যায়। তবে এখান থেকে মুকুটমণিপুর প্রায় ৯৫ কিমি।
- কখন যাবেনঃ বছরের যে কোনো সময়। তবে গ্রীষ্মকালে না যাওয়াই ভালো।
- সতর্কতা-
- জঙ্গলের মধ্যে স্থানীয় কাউকে না নিয়ে একা একা ঘুরতে বেরবেন না।
- বর্ষাকালে ঘুরতে এলে সাপ বা পোকামাকড় থেকে সাবধান থাকতে হবে। জঙ্গলে উপযুক্ত জুতো পায়ে না দিয়ে যাবেন না।