ব্রিটিশ শাসিত ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা (Kanpur Bolshevik Conspiracy Case) এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯২২ সালের পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলার পরে ব্রিটিশ সরকার ভেবেছিল ভারতে স্বাধীনতাকামী কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সমূলে উৎপাটিত করা গেছে। কিন্তু তখনো কমিউনিস্ট ভাবধারা অবলুপ্ত হয়নি বরং পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলার পরে সমগ্র ভারত জুড়ে কমিউনিজম প্রচারিত হতে শুরু করে। কলকাতা, বম্বে, মাদ্রাজ, কানপুর, লাহোর এই সব মেট্রোপলিটন শহরগুলিতেই কমিউনিস্টরা জোটবদ্ধ হতে থাকে আর এই কমিউনিস্ট আন্দোলনের সম্ভাব্য পরিণতি চিন্তা করে ব্রিটিশ সরকার তৎকালীন প্রথম সারির কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেপ্তার করে শুরু করেন কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা।
১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ সরকার মোট আটজন অভিযুক্ত কমিউনিস্ট নেতার বিরুদ্ধে শুরু করে এই কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা। এই মামলায় প্রথম ভাগে তেরো জন অভিযুক্ত হয়েছিলেন, যারা হলেন – মানবেন্দ্রনাথ রায়, মুজফ্ফর আহমেদ, শওকত ওসমানি, গুলাম হোসেন, এস এ ডাঙ্গে, সিঙ্গারাভেল্লু, আর এল শর্মা, নলিনী গুপ্ত, শামুদ্দিন হাসান, এম আর এস ভেলায়েন্দুন, ডাক্তার মণিলাল, সম্পূর্ণানন্দ এবং সত্যভক্ত। যদিও পরে এই তেরো জনের মধ্যে থেকে কেবলমাত্র আট জনের বিরুদ্ধেই মামলা শুরু হয়। একেবারে চূড়ান্ত পর্বে অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়, মুজফ্ফর আহমেদ, এস এ ডাঙ্গে, নলিনী গুপ্তা, গুলাম হোসেন, সিঙ্গারাভেল্লু, শওকত ওসমানি, আর এল শর্মা। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া রাষ্ট্রদ্রোহিতার এই মামলার বিচারের ভার পড়েছিল ব্রিটিশ বিচারপতি এইচ ই হোমসের উপর যিনি এর আগে চৌরিচৌরার ঘটনায় ১৭২ জন সাধারণ মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করে কারাবন্দি করেছিলেন।
পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলার পরে বড়ো বড়ো মেট্রোপলিটন শহরগুলিতে কমিউনিস্ট ভাবধারা আরো দ্রুত প্রচারিত হতে থাকে। কলকাতা, বম্বে, মাদ্রাজ, কানপুর, লাহোর সর্বত্র কমিউনিস্টরা একজোট হতে শুরু করে। কমিউনিস্ট ভাবধারায় দীক্ষিত হতে শুরু করছিলেন বহু মানুষ। ইতিমধ্যে গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ হলে জাতীয় কংগ্রেসের চরমপন্থী শাখার সদস্যরা প্রায় সকলেই আরো সক্রিয় পদ্ধতিতে বিপ্লবের পথে কমিউনিজমের পথে আসতে চাইলেন। ফলে ক্রমশ কমিউনিস্ট আন্দোলন সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছিল। আর এই পরিস্থিতি বুঝতে পেরে এবং এর সম্ভাব্য পরিণতির কথা মাথায় রেখে ভারতের তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল লণ্ডনের স্বরাষ্ট্রসচিবকে ১৯২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি চিঠি লিখে জানান যে, ভারতে পুনরায় একটি বৃহত্তর গণ আন্দোলনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, অসহযোগ আন্দোলনকারীরা এবং কিছু বহিরাগত ‘সন্ত্রাসবাদী’ একযোগে কমিউনিস্টদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন ব্রিটিশরাজের পতন ঘটাতে। আর এই প্রেক্ষিতেই সম্ভাবনাময় কমিউনিস্ট আন্দোলনকে কুঁড়িতেই বিনষ্ট করতে এই ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করার পরিকল্পনা করে ব্রিটিশ সরকার। ১৯২৩ সালের ৮ মে তারিখে শওকত ওসমানিকে এবং ১৯ মে তারিখে গুলাম হোসেনকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিশ। রাজ্য কারাবন্দী আইন, ১৮১৮-এর তিন নম্বর ধারায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং ক্রমান্বয়ে পেশোয়ার, লাহোর এবং ঢাকা জেলে তাঁদের পাঠানো হয় বন্দি হিসেবে। মুজফ্ফর আহমেদকে গ্রেপ্তারের পরে তিনি পুলিশের কাছে জবানবন্দিতে বলেন যে নলিনী গুপ্তের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। এই নলিনী গুপ্ত মানবেন্দ্রনাথ রায় এবং কমিন্টার্নের সঙ্গে বম্বে, মাদ্রাজ প্রভৃতি এলাকার ভারতীয় কমিউনিস্ট দলের সংগঠকদের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করতেন। ২০ ডিসেম্বর নলিনী গুপ্তকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ এবং তিনি পরপর অনেকগুলি বয়ান দেন পুলিশকে যার ফলে ডিসেম্বর থেকে ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে আরো কয়েকজন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয় ব্রিটিশ পুলিশ। নলিনী গুপ্তের দেওয়া তথ্য এই মামলায় প্রভূত সাহায্য করেছিল ব্রিটিশদের। এই সমস্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রথমে তেরো জন অভিযুক্তের একটি তালিকা নির্মাণ করে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যাদের মধ্যে পরে ভারতীয় পেনাল কোডের ১২১-এ ধারা অনুযায়ী মোট আট জনকে অভিযুক্ত করা হয়। মার্চ মাসে গ্রেপ্তার হন এস এ ডাঙ্গে এবং সিঙ্গারাভেল্লু। সব মিলিয়ে মানবেন্দ্রনাথ রায়, মুজফ্ফর আহমেদ, এস এ ডাঙ্গে, নলিনী গুপ্তা, গুলাম হোসেন, সিঙ্গারাভেল্লু, শওকত ওসমানি এবং আর এল শর্মার বিরুদ্ধে ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হয় কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা। প্রথমে নির্ধারিত আট জনের মধ্যে থেকে গুলাম হোসেনকে আদালতে পেশ করা হয়নি বিচারের জন্য কারণ তিনি একটি স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দিয়ে পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলায় মহম্মদ শফিকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে সম্মত হন। অন্যদিকে মানবেন্দ্রনাথ রায় সে সময় জার্মানিতে এবং আর এল শর্মা পণ্ডিচেরিতে থাকায় তাঁদেরকে সেশন আদালতে পেশ করা যায়নি। বিচারাধীন বন্দির তালিকায় তাঁদের নাম ছিল না। শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে সিঙ্গারাভেল্লু জামিন পেয়ে যান। ফলে সবশেষে এই মামলায় বিচারাধীন অভিযুক্তের তালিকায় থাকেন শওকত ওসমানি, মুজফ্ফর আহমেদ, এস এ ডাঙ্গে এবং নলিনী গুপ্ত। কানপুর ষড়যন্ত্র মামলার বিচারের ভার ছিল কুখ্যাত বিচারপতি এইচ ই হোমসের উপর। অভিযুক্তরা চেয়েছিলেন কোনো বড়ো শহরে তাঁদের এই মামলাকে স্থানান্তরিত করা হোক, কিন্তু হোমস সে আবেদন খারিজ করে দেন।
১৯২৪ সালে মোট চার সপ্তাহব্যাপী চলেছিল এই মামলা। মামলার শেষে অভিযুক্ত চারজনের বিরুদ্ধে চার বছরের সশ্রম কারাবাসের সাজা ঘোষণা করা হয়।অভিযুক্তদের সাজা কমিয়ে দেওয়ার জন্যে এবারে দেশে ও দেশের বাইরে জনমত গড়ে উঠতে থাকে। ভারতে ইতিমধ্যে গড়ে ওঠে ‘ইণ্ডিয়ান কমিউনিস্ট ডিফেন্স কমিটি’ যারা অর্থ সংগ্রহ করে অভিযুক্তদের হয়ে লড়ার জন্য একজন আইনজীবীকে নিযুক্ত করে। অন্যদিকে লণ্ডনে চার্লস অ্যাশলের নেতৃত্বে ডিফেন্স কমিটি গড়ে ওঠে। আবার ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি অভিযুক্তদের হয়ে লড়ার জন্য ৫০০ ফ্রাঙ্ক মুদ্রা দান করে। কিন্তু কারাবাসের সময়কাল কমানোর জন্য যে আপিল উচ্চ আদালতে করা হয় তা খারিজ করে দেওয়া হয়। এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করা হয় কানপুর থেকে প্রকাশিত সেকালের ‘বর্তমান’ পত্রিকায়। বেনারস থেকে প্রকাশিত ‘আজ’ পত্রিকায় বলা হয় সেশন বিচারপতি বিচারের নামে প্রহসন চালাচ্ছেন। এমনকি নরমপন্থী জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস নেতা মদনমোহন মালব্য এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে উচ্চ আদালতের প্রকাশ্য সমালোচনা করেন। এর প্রতিবাদে সংগঠিত কানপুরের এক কারখানার শ্রমিকদের বন্ধ-এর উপর পুলিশ গুলি চালায়। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও কানপুর মামলাকে কেন্দ্র করে কোনো বৃহত্তর জনমত বা গণ আন্দোলন গড়ে উঠতে পারেনি।
মামলা চলাকালীন সবথেকে ন্যক্কারজনক ঘটনা ছিল কমিউনিস্টদের নিজেদের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতার দৃষ্টান্ত। পুলিশের হেফাজতে থাকাকালীন এস এ ডাঙ্গে এবং নলিনী গুপ্ত ব্রিটিশ সরকারকে একাধিক চিঠি লিখেছিলেন। নলিনী গুপ্ত শেষে পুলিশের চর তথা এজেন্ট হয়ে গিয়েছিলেন এবং ডাঙ্গের ক্রিয়াকলাপ সত্যই বিতর্কিত হয়ে উঠেছিল। ১৯৬৪ সালের ৭ মার্চ তারিখে কমিউনিস্ট-বিরোধী পত্রিকা ‘কারেন্ট’-এ ছাপা হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারকে লেখা ডাঙ্গের অপ্রকাশিত চিঠিগুলি। আর এই চিঠি প্রকাশ্যে আসতেই কমিউনিস্টদের মধ্যে দল বিভাজন হয়ে যায় এবং এই সময়েই মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে সিপিআই এবং সিপিআইএম(এল) নামে দুটি পৃথক সংগঠনের জন্ম হয়। দুটি দল থেকেই সদস্যরা দিল্লির জাতীয় সংগ্রহশালায় সেই চিঠিগুলি নিজের চোখে পরীক্ষা করতে যান। কিন্তু ডাঙ্গের বক্তব্য ছিল এগুলি সবই সাজানো এবং অ্যাংলো-আমেরিকান ঔপনিবেশিকদের চক্রান্তের দৃষ্টান্ত অথবা এটি চিনের কমিউনিস্ট পার্টির ষড়যন্ত্র। ডাঙ্গের বক্তব্যের পিছনে যুক্তি ছিল এই যে সবসময় স্বাক্ষরের সময়ে তিনি শ্রীপদ অর্থাৎ ইংরেজি বর্ণমালার ‘D’ লিখতেন, কিন্তু ঐ চিঠিগুলিতে স্বাক্ষরে ‘D’-এর বদলে শ্রীপৎ অর্থাৎ ‘T’ লেখা ছিল। এই সময় ডাঙ্গে-বিরোধী গোষ্ঠীর সদস্য হয়েও ডাঙ্গের এই বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে তিনি কোনো বক্তব্য রাখেননি। ব্রিটিশ সরকার ভেবেছিল এই কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলার পরে ভারতের বুক থেকে সম্পূর্ণরূপে কমিউনিস্ট আন্দোলনকারীদের বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারকে চমকে দিয়ে ঠিক এর পরের বছরই ১৯২৫ সালে আবার ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নিয়ে একটি সর্বভারতীয় সভা আয়োজিত হয়।