কলকাতা প্লেগ ও ভগিনী নিবেদিতা

কলকাতা প্লেগ ও ভগিনী নিবেদিতা

শহর কলকাতার ইতিহাসে একটি অন্যতম কালো অধ্যায় হল প্লেগ মহামারী। ১৮৯৮ সালের মে মাসে কলকাতায় প্রথম এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায় যা কালক্রমে মহামারীর আকার ধারণ করে। কলকাতা প্লেগ ও ভগিনী নিবেদিতা ‘র সেই প্রসঙ্গে অবিস্মরণীয় ভূমিকা সম্পর্কে আমরা অনেকেই সম্যক ওয়াকিবহাল নই। সেই সময়ে কিভাবে তাঁর মাতৃরূপ জাগরিত হয়ে ওঠে সমগ্র ভারতবাসীর কাছে আজ সেটাই জানব।

প্লেগ হল (Plague) Yersinia pestis নামক ব্যাকটেরিয়া ঘটিত মারাত্মক একটি সংক্রামক রোগ। প্রায় ৩০০০ বছর আগে এই রোগের অস্তিত্ব প্রথম ধরা পড়ে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগ মহামারী আকারে দেখা দেয়। ইঁদুর থেকে মানুষে প্লেগ জীবাণু স্থানান্তরের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে এবং রোগের উপসর্গ সৃষ্টি করে । প্রাচীন কলকাতার পরিবেশ ছিল অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। বিশেষত অষ্টাদশ ও উনিশ শতকে প্রায় প্রতি বছরেই কোন না কোন মহামারীতে আক্রান্ত হওয়া ছিল কলকাতার নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। বর্ষাতে আমাশা আর কলেরার প্রকোপ বাড়ত আবার শীত এলে প্রকোপ কমত। শোনা যায় অষ্টাদশ শতকে জনৈক ওলন্দাজ নাবিক গঙ্গার ওপর দিয়ে জাহাজে চড়ে যাওয়ার সময় অন্য পাড়ে বহু নরকঙ্কাল দেখতে পেয়ে কলকাতা শহরকে ‘গলগোথা’ বলে উল্লেখ করেন।আরামিক ভাষায় ‘গলগোথা’ শব্দের অর্থ যে স্থানে বহু নরকঙ্কাল ছড়িয়ে থাকে। যিশু খ্রিস্টকে গলগোথা পাহাড়ে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল৷ উনিশ শতকের ইম্পিরিয়াল গেজেট অনুযায়ী কোনও এক সময় পরপর সাতবছর ধরে কলকাতায় মহামারী হয়েছিল যাতে শহরে বসবাসকারী ইউরোপীয়দের এক চতুর্থাংশ মারা যায়। মহামারীর প্রকোপ থেকে বাদ যায়নি ভারতীয়রাও। এই বিপুল মৃতদেহের শেষকৃত্য করা সম্ভব ছিল না বলে মৃতদেহগুলি নদীর তীরে ফেলে রাখা হয়েছিল।

১৮৯৮ সালে কলকাতায় প্লেগ মহামারী আকার ধারণ করে৷ প্লেগ সম্পর্কে সমসাময়িক পত্রপত্রিকায় যে বিবরণ পাওয়া যায় তা খুব সাংঘাতিক। সেখানে বলা হয়, ”প্লেগের কথা শুনিয়া কলিকাতাস্থ লোকের আতঙ্ক ভয়ানক বৃদ্ধি পাইয়াছিল। সকলেই বিভব দূরে ফেলিয়া পুত্রকন্যা লইয়া শহর ত্যাগে প্রস্তুত হইল। সে ভয়, সে ভাবনা সহজে বর্ণনা করা যায় না…।’’ কলকাতার মানুষ ভেবেছিল দূরে কোথাও চলে গেলে এই মহামারী থেকে মুক্তি মিলবে৷ ফল হল উল্টো। মারাত্মক ভিড় জমল স্টেশনে, স্টিমার ঘাটে। শুরু হল দাঙ্গা হাঙ্গামা৷ এই সুযোগে ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি, নৌকা, মুটে, সকলেই ভাড়া চারগুণ, পাঁচগুণ বাড়িয়ে দিল৷ তিন মাস ব্যাপী এমন অবস্থা চলার পর সরকার ঘোষণা করল, কর্পোরেশনের লোক বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখবে, কারও প্লেগ হয়েছে কিনা। যদি রোগীর সন্ধান পায়, তাহলে জোর করে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। মানুষ তাতে আরও ভয় পেয়ে গেল কারণ তখন কলকাতাবাসীর ধারণা ছিল প্লেগ রোগ নিয়ে হাসপাতালে গেলে কেউ বাঁচে না ডাক্তারেরা নাকি ইনজেকশন দিয়ে রোগীকে মেরে ফেলে৷ ফলে এর প্রতিবাদে শহরের ঝাড়ুদার, মেথর, ভিস্তিওয়ালা ও কুলি-মজুররা শুরু করল ধর্মঘট। শহর ভরে গেল আবর্জনা ও দুর্গন্ধে৷ শেষপর্যন্ত অবস্থা প্রশমিত করতে বাংলার ছোটলাট স্যার জন উডবার্ন ঘোষণা করলেন, প্লেগ হলে সকলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে না। বাড়িতে একটা পরিষ্কার ঘরে কোয়ারান্টাইন করে রাখলেই চলবে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

কলকাতায় এই মহামারীতে প্রথমবার ত্রাণের কাজ করেছিল তখনকার সদ্যগঠিত রামকৃষ্ণ মিশন এবং এই সেবার কাজে যেসমস্ত মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে স্মরণীয় হলেন ভগিনী নিবেদিতা। কলকাতা প্লেগ ও ভগিনী নিবেদিতা র ভূমিকা সেই প্রসঙ্গে আজও সমানভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে। মিশনের পক্ষে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল যেখানে নিবেদিতা হলেন সম্পাদিকা, স্বামী সদানন্দ প্রধান কার্যাধ্যক্ষ এবং অন্যান্য কমীদের মধ্যে ছিলেন স্বামী সদ্যানন্দ, স্বামী নিত্যানন্দ, স্বামী আত্মানন্দ। ঘরবাড়ি পরিছন্ন রাখাই হল প্লেগ নিরাময়ের প্রাথমিক উদ্যোগ৷ দরিদ্র বস্তিতে এই উদ্যোগ নেওয়া ছিল একপ্রকার অসম্ভব । কিন্তু সেই ভার নিজ হাতে তুলে নিয়েছিল মিশনের নব গঠিত কমিটি৷ ৩১ মার্চ ১৮৯৯ সালে গুড ফ্রাইডের দিন স্বামী বিবেকানন্দ নিজে এসে বস্তিতে বসবাস করতে লাগলেন৷ চলতে লাগল সাফাই কর্ম। নিবেদিতা ‘ প্লেগ ও ছাত্রদের কর্তব্য ‘ নিয়ে উদ্দীপনাপূর্ন একটি ভাষণ দেন। এই ভাষনের উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে সকলকে সচেতন করে তোলা। এটি কেবল একটি ভাষণ ছিল না এটি একটি আকুল আহ্বান ছিল । ১৮৯৮ সালে প্লেগ মহামারীতে নিবেদিতা কতটা সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তার সঠিক প্রামাণ্য পাওয়া না গেলেও বেলুড় মঠের সন্ন্যাসীদের দ্বারা গঠিত ক্যাম্প বা অস্থায়ী হাসপাতালে তিনি স্বামীজীর সঙ্গে যে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছিলেন তা সহজেই অনুমান করা যায়৷ নিবেদিতার যে প্লেগ সম্পর্কে আগে থেকেই ধারণা ছিল তা তিনি নিজেই লিখেছেন ‘The Plague’ প্রবন্ধে : “প্রকৃত প্লেগ কি না বােঝার জন্য ওপর ওপর দেখলে বােঝা যায় না। তার জন্য গভীরে প্রবেশ করতে হয়। প্রথম এই রােগের ধ্বংসলীলার কথা শুনেছিলাম এক ইউরােপীয় ভােজসভায়, তারপর বাড়ি ফিরে শুনলাম, আমাদের বাড়ির রাস্তাতেই এক সপ্তাহে সাতজন মারা গেছে।” এই মহারণে তিনি যে ঝাঁপ দিয়েছিলেন তা বোঝা যায় ১৮৯৯ সালের মার্চ মাসে মিস ম্যাকাউলকে নিবেদিতার লেখা পত্রাংশে, “আমি দু সপ্তাহ ছুটিতে ছিলাম অর্ধেকটা প্লেগের জন্য, বাকী অর্ধেকটা সত্যি আমার প্রয়োজন ছিল।” ১৮৯৯ সালের প্লেগ কিন্তু খুব শীঘ্র বিদায় নেয়নি। এই মহামারী থেকে উদ্ধারের জন্য সাহায্য সমিতি গড়তে চান স্বামীজী, তারজন্য তিনি নির্ভর করেছিলেন নিবেদিতা এবং আরও দুই সন্নাসীর উপর৷ কলকাতার প্লেগ সেবা কার্যে স্বামীজী উদ্যোগ বহুপ্রাণে সাড়া জাগিয়েছিল৷ মিশনের কাজে অর্থ ও শ্রম দিতে এগিয়ে এসেছিল অনেকেই৷ সেই সময়কার একটি ঘটনা, স্বামী সদানন্দ, স্বামীজীকে জানান নিবেদিতা কীভাবে একান্তভাবে সেবাকার্যে নিযুক্ত আছেন৷ সব শুনে স্বামীজী বলেন, ” ঐ প্রকার কার্যোদ্যম ঐ মনুষত্য ও সহযোগিতা ছাড়া ধর্ম হতেই পারে না৷ ঐ দেখ নিবেদিতা কেমন এক কোনায় পড়ে আছে, আর ইংরেজরা তাঁকে সাহায্য করছে৷” ৯ এপ্রিল স্বামীজীর কাছে নিবেদিতা এসে তুলে ধরেন প্লেগের নানা কথা৷ স্বামীজী কেবল বলে ওঠেন “প্লেগ, নিবেদিতা প্লেগ।” নিবেদিতার অদম্য সেবার কথা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে, সেই কথা পৌছায় সরকারি দপ্তরে৷ হেলথ অফিসার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসে দেখেন কগজপত্র ছড়ানো ডেস্কের সামনে বসে একটি মেয়ে একমনে কাজ করছে৷ নিবেদিতা অফিসারকে জানান, “বাগবাজারটা আমরা বাঁচাব ঠিকই, সাধারণের জন্য সাধারণ এখানে খাটছে।…” নিবেদিতার আত্মত্যাগ ও তাঁর অদম্য উৎসাহ সত্যিই আমাদের প্রেরণা দেয়। অক্লান্ত ভাবে নিবেদিতা কাজ করে চলেছেন তখন। সাথে উৎসাহ দিয়ে চলেছেন মানুষকে আরও আকুলভাবে এই সেবাকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য – “ ঝাড়ুদারও যদি একটা আদর্শের প্রেরণায় কাজ করে, তাহলেই বৃহত্তর আদর্শের জন্য তার প্রস্তুতি হয়ে গেল। সে-আদর্শ কী? সেটা ঠিক করে নেওয়া তােমাদের দায়। বাগবাজারকে রক্ষা করে আমরা নতুন প্রাণ নিয়ে ভারতের ইতিহাস রচনা করলাম। এ-ইতিহাস আগে কখনও লেখা হয়নি। এই আমাদের রামায়ণ।” এক বিদেশিনীর মুখে ভারত সম্পর্কে ‘আমাদের’ কথাটি ছাত্রদের বিহ্বল করে দিত। নিবেদিতার কথা তাদের মনে যোগাত অক্লান্ত উৎসাহ।

রাস্তাঘাট পরিছন্ন রাখার দায়ভার গ্রহণ করেছিলেন নিবেদিতা। নর্দমা থেকে রাস্তার পাশটুকু পর্যন্ত পরিষ্কার না হওয়া অবধি তিনি সেখান থেকে যেতেননা। সকলকে তিনি হাসি মুখে বোঝাতেন পরিস্কার পরিছন্ন থাকলেই মুক্তি হবে প্লেগ থেকে। কিন্তু এই বোঝানোতেও যখন ফললাভ হল না তিনি নিজেই ঝাড়ু হাতে বেড়িয়ে পড়লেন রাস্তায়। পরবর্তীকালে প্লেগ সেবাকার্যে তাঁর বিচিত্র কিছু অভিজ্ঞতা তিনি লিপিবদ্ধ করলেন ‘The Plague’ প্রবন্ধে। স্বামীজীর ভাবাদর্শে সেবা ধর্মের প্রথম শর্ত ছিল নিজেকে সঁপে দেওয়া। এই মন্ত্রেই দীক্ষিত ছিলেন নিবেদিতা৷ প্লেগে আক্রান্ত হলে মৃত্যু অসম্ভাবী জেনেও আর্তের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নিবেদিতা৷ অক্লান্তভাবে হাসিমুখে নিজ দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি৷ ‘The Plague’ প্রবন্ধে নিবেদিতা লিখছেন : “প্রতিরােধ করা যায় এমন বিষয় দুটি হল : ১) অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং অজ্ঞতা। তাই প্লেগের অন্যতম ও সেইসঙ্গে সর্বোত্তম দান হল নিম্নবর্ণের মানুষদের মনুষ্যপদবাচ্য হওয়া। এই মুহূর্তে তাদের কায়িক শ্রমের চাহিদা প্রচণ্ড। মেথরদের ফুটফুটে বালকও এখন সময়ের স্বল্পতা, প্রবল উৎসাহ ও কর্মোদ্যমের কারণে পূর্ণবয়স্কের মজুরির দাবিদার। ওরা যখন দল বেঁধে বালতি হাতে ও কোদাল কাঁধে আসে তখন তাদের কতই না গর্বিত বলে মনে হয়! একটা যুগের মহৎ এক উদ্দেশ্য রূপায়ণে সবকিছু কেমন ঐক্যবদ্ধভাবে ঘটে যাচ্ছে—এ এক বিস্ময়ের ব্যাপার…।”

বিখ্যাত সেবাব্রতী রাধাগোবিন্দ কর লিখেছেন, “এই সংকট সময়ে বাগবাজার পল্লীর প্রতি বস্তিতে ভগিনী নিবেদিতার করুণাময়ীমূর্তি লক্ষিত হইত৷ আপনার আর্থিক অবস্থার প্রতি লক্ষ্য না রাখিয়া তিনি অপরকে সাহায্য দান করতেন।” কঠিন সময়টুকুতে নিঃস্বার্থ সেবা দিয়ে নিবেদিতা তাঁর আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন৷ হোক না লড়াই কঠিন তবুও লড়তে হবেই৷ যুদ্ধ বিনা হার স্বীকার করেননি তিনি৷ কলকাতা প্লেগ ও ভগিনী নিবেদিতা র ভূমিকা সেই দিনগুলিতে কলকাতা কখনও ভুলবে না।

আপনার মতামত জানান