নঈম চৌধুরী

নঈম চৌধুরী

নঈম চৌধুরী (Naiyyum Chaudhury) একজন বাংলাদেশি জৈবপ্রযুক্তিবিদ ও পরমাণু বিজ্ঞানী যিনি ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় জৈবপ্রযুক্তি নীতির পথিকৃৎ। তিনি ‘বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন’ এর চেয়ারম্যান হিসেবে এবং বাংলাদেশের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৪৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর অধুনা বাংলাদেশের কুমিল্লায় নঈম চৌধুরীর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম আবদুল জলিল চৌধুরী ও মায়ের নাম সাদিয়া বেগম। নঈম চৌধুরীর সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপিকা নঈম শামীমা খাতুনের বিবাহ হয়। তাঁদের দুই সন্তানের মধ্যে পুত্র সন্তানের নাম সাজিদ মুহাইমিন চৌধুরী ও কন্যা সন্তানের নাম সারা নাহিন চৌধুরি।

ননঈম চৌধুরী বাংলাদেশের চৌমোহানি কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। ১৯৬৭ সালে তিনি ওই শিক্ষায়তন থেকেই জৈব রসায়ন বিভাগে স্নাতকোত্তরের পরীক্ষা দেন এবং প্রথম শ্রেণীতে তৃতীয় স্থান লাভ করেন। এরপর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যান। ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির অধীনে পি.এইচ.ডি করার জন্য তিনি কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের উপর পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচারের ঘটনার সক্রিয়ভাবে প্রতিবাদ করেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ কানাডার কিউবেক শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন’। নঈম ছিলেন এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তাঁর সক্রিয় প্রতিবাদের জন্যই বাংলাদেশের চট্রগ্রামে জেট প্লেনের যন্ত্রাংশ পাঠানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণে তিনি তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ সম্পূর্ণ করতে না পেরে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৮২ সালে নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি জৈবপ্রযুক্তিবিদ্যায় ডক্টরেট লাভ করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি ইউরোপীয়ান ইকোনোমিকাল কমিউনিটি ফেলোশীপ লাভ করেন এবং পশ্চিম জার্মানির কার্লস্রুহে বিশ্ববিদ্যালয় (University of Karlsruhe) থেকে পোস্ট ডক্টরেট-এর জন্য গবেষণা শুরু করেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৮০ সালের শেষের দিক থেকে ১৯৯০ সালের প্রথমদিক পর্যন্ত তিনি একইসঙ্গে জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগে এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (BUAT)-এর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে সাময়িক সময়ের অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৮২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এই শিক্ষায়তনে মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ের জন্য একটি পৃথক বিভাগ গড়ে তোলার কাজে তিনি সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। ১৯৯৩ সালে তিনি এই বিভাগের পুরো সময়ের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে এই বিভাগের চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং জৈবপ্রযুক্তিবিদ্যা বিভাগের অতিথি শিক্ষক ছিলেন।

১৯৯৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য হন। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি এখানকার ব্যবস্থাপক সভা (senate)-এর সদস্য হন। ২০০০ সাল থেকে তিনি জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েরও ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হয়েছিলেন। ২০০৩ সাল থেকে তিনি BUAT -এর সিন্ডিকেট সদস্য হয়েছিলেন।

সারাজীবনে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়ভার নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন (BAEC)-এর সাধারণ সদস্য থেকে তিনি ক্রমে এই সংস্থার চেয়ারম্যান পদে উন্নীত হয়েছিলেন। তিনি ইনস্টিটিউট অফ ফুড অ্যান্ড রেডিয়েশন বায়োলজি-এর ডিরেক্টর ছিলেন। তিনি রিজিওনাল কোঅপারেটিভ অ্যাগ্রিমেন্ট (RCA)-এর জাতীয় কোঅর্ডিনেটর ছিলেন। এই সংস্থা পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগর সংলগ্ন অঞ্চলে পরমাণু বিজ্ঞান ও তার প্রযুক্তির সমবন্টনের ব্যাপারে কাজ করে। পরবর্তীকালে তিনি এই সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ফুড মাইক্রোবায়োলজি, মাইক্রোবিয়াল বায়োটেকনোলজি এবং পরমাণু শক্তির আরো বিবিধ শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর প্রায় ১৫০টি গবেষণামূলক প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে । তিনি ছিলেন ‘বাংলাদেশ জার্নাল অফ সায়েন্স’-এর প্রধান সম্পাদক এবং ‘বাংলাদেশ জার্নাল অফ মাইক্রোবায়োলজি’-এর সম্পাদক। এছাড়াও ‘জার্নাল অফ বাংলাদেশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস’ এবং ‘জার্নাল অফ NOAMI’-এর সম্পাদকীয় বিভাগের সদস্য ছিলেন তিনি।

নঈম চৌধুরী উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞানমূলক বিভিন্ন বৈঠক ও কর্মশালা, সেমিনার, কনফারেন্স ইত্যাদির জন্য পৃথিবীর বহু দেশে ভ্রমণ করেছেন যার মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন, জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, জাপান, মরক্কো, সৌদি আরব, ইজিপ্ট, দক্ষিণ আফ্রিকা উল্লেখযোগ্য।

বিজ্ঞানে অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য তিনি ২০০০ সালে বাংলাদেশের সাংবাদিক সংস্থা প্রদত্ত পুরস্কার (Bangladesh Journalist’s Association Award) লাভ করেন। এই বছরই তিনি জাকি (Zaki) স্মৃতি স্বর্ণপদকও লাভ করেন। ২০০২ সালে পান বি.এ.এস স্বর্ণপদক। তিনি ২০০৪ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি (Bangladesh Academy of Sciences)-এর সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ২০০৭ সাল পর্যন্ত এই পদে থাকেন। পুনরায় ২০০৮ সালে তিনি এই পদের জন্য নির্বাচিত হন এবং ২০১১ সাল পর্যন্ত এই পদের দায়িত্ব পালন করেন।

২০১৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ৭২ বছর বয়সে বাংলাদেশের ঢাকায় নঈম চৌধুরীর মৃত্যু হয়। তাঁর দেহ ঢাকার বনানিতে সমাধিস্থ করা হয়।

আপনার মতামত জানান