মুদ্রণের ইতিহাসে একজন পথপ্রদর্শকস্বরূপ ছিলেন পঞ্চানন কর্মকার (Panchanan Karmakar)। তাঁকে বাংলা মুদ্রণাক্ষরের জনক বললেও অত্যুক্তি হয় না। বাংলা হরফ নির্মাণের কলাকৌশল ছিল তাঁর আয়ত্তে। চার্লস উইলকিনসন নামে এক সাহেবকে হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণ বই ছাপার জন্য প্রয়োজনীয় বাংলা টাইপফেস তৈরিতে সাহায্য করেছিলেন পঞ্চানন। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের অনুপ্রেরণায় কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছাপাখানা তৈরি হলে সেখানেও নিয়ে যাওয়া হয় পঞ্চানন কর্মকার কে। তাঁকে বাংলা মুদ্রণাক্ষরের জনক বললেও অত্যুক্তি হয় না। । পরবর্তীকালে উইলিয়াম কেরি শ্রীরামপুর মিশনের প্রেস শুরু করেছিলেন তাঁর সঙ্গেই। কেরির বাংলা বই পঞ্চাননের তৈরি হরফে ছাপা হয়েছিল। বাংলা হরফ ছাড়াও দেবনাগরী হরফও নির্মাণ করেছিলেন তিনি। কেরীর সংস্কৃত ব্যাকরণ ছাপার কাজে সে-হরফ ব্যবহার করা হয়েছিল। দীর্ঘকাল পর্যন্ত এই দেশের বিভিন্ন ছাপাখানায় তাঁর তৈরি হরফের ব্যবহার চলেছিল। বাংলা ও সংস্কৃত ছাড়াও আরবি, ফার্সি, মারাঠি, তেলেগু, বার্মিজ এবং চীনা সহ প্রায় ১৪টি ভাষার হরফ নির্মাণ করেছিলেন পঞ্চানন। মুদ্রণযন্ত্রের গোড়ার ইতিহাস এবং তার বিবর্তন বিষয়ে অনুসন্ধান করলে পঞ্চানন কর্মকারের নামকে উপেক্ষা করা যাবে না।
পঞ্চানন কর্মকারের জন্মসাল নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে পন্ডিত মহলে। স্পষ্ট করে কোনো একটি বছরকে চিহ্নিত করা যায় না। তবে তাঁর কর্মজীবন ও আনুষঙ্গিক কিছু তথ্য থেকে অনুমান করা যায় যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের কোনো একসময়ে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে পঞ্চানন কর্মকারের জন্ম হয়। তাঁর প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। পন্ডিতেরা বলেন তাঁর পূর্বপুরুষরা হুগলি জেলার অন্তঃপাতি জিরাট-বালাগড়ের অধিবাসী ছিলেন সেখান থেকে পরবর্তীকালে ত্রিবেণীতে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। বৃত্তিগতভাবে কর্মকার হলেও আরও পূর্বে একেবারে আদিতে তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন মল্লিক এবং পেশায় তাঁরা ছিলেন লিপিকর। মূলত তাম্রপট, ধাতব পাত্র, অস্ত্রশস্ত্রের উপর অলঙ্করণ, নামাঙ্কনের কাজ করতেন তাঁরা। এককথায় এক শিল্পীবংশের উত্তরপুরুষ ছিলেন পঞ্চানন। মাঝের বহু পুরুষ অতিক্রম করে তাঁর মধ্যেই সেই পূর্বের শিল্পীমন দেখা দিয়েছিল পুনরায় এবং তখন তা আরও পরিণত এবং সময়ের নিয়মে প্রযুক্তিগতভাবে আরও বেশি এগিয়ে।
হুগলির ত্রিবেণীতেই ছিল পঞ্চাননের কর্মস্থল। একজন কামার হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি সেখানে। তখন খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের হিড়িক চলেছে চারদিকে। বিভিন্ন গ্রন্থও প্রকাশিত হচ্ছে খ্রিস্টধর্মের দ্বারা প্রভাব বিস্তার করে ধর্মান্তরকরণের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির জন্য। এমনই এক সময়ে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক এক সাহেব ফাদার অ্যান্ড্রুজ হুগলিতে একটি ছাপাখানা স্থাপন করেছিলেন। সেই ছাপাখানাটি খোলার উদ্দেশ্য অবশ্য ছিল, কোম্পানির কর্মচারীদের এই বঙ্গদেশ সম্পর্কে, এখানকার ভাষা সম্পর্কে জানানো। ইংরেজদের বঙ্গভাষা শিক্ষার সুবিধার্থে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোনসের শিষ্য ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড রচনা করেছিলেন ‘আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’। বইটি ইংরেজিতে রচিত হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বোঝানোর সুবিধার্থে হ্যালহেডকে বাংলা ভাষার ব্যবহার করতে হয়েছিল। ১৭৭৮ সালে এই গ্রন্থটি অ্যান্ড্রুজ সাহেবের প্রেস থেকে ইংরেজ টাইপোগ্রাফার চার্লস উইলকিন্সের তত্ত্বাবধানে যখন ছাপা হচ্ছে তখন বাংলা হরফগুলি নিয়ে তৈরি হয় সমস্যা। উইলকিন্স সাহেব যখন খুবই পরিশ্রম করছিলেন বাংলা হরফ নির্মাণের জন্য, তখন পঞ্চানন কর্মকার তাঁর পূর্বপুরুষজাত ব্যবহারিক প্রযুক্তিজ্ঞান নিয়ে সাহেবকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। সঙ্গে ছিলেন পঞ্চানের ভাই গদাধর। উইলকিন্সের তত্ত্বাবধানেই পঞ্চানন নির্মাণ করেন ছেনিকাটা ঢালাই করা চালনশীল ধাতব বাংলা হরফ। সাহেব এবং পঞ্চাননের যুগ্ম প্রচেষ্টাতেই এই হরফ নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু বইতে মুদ্রাকরের জায়গায় কেবল স্থান পেয়েছিল চার্লস উইলকিন্সের নাম। সেই প্রথম বাংলা হরফ নির্মিত হল বলে পঞ্চানন কর্মকারকে বাংলা মুদ্রণাক্ষরের জনক বললেও অত্যুক্তি হয় না। উইলকিন্স নিজে ছিলেন একজন প্রশিক্ষিত মুদ্রক, এছাড়াও তাঁর সহায়তাকারী জোসেফ শেফার্ড ছিলেন একজন দক্ষ রত্ন ও সীল খোদাইকারী। এঁদের থেকে পঞ্চানন, গদাধরেরাও অনেক কৌশল শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন।
এই ধাতব বাংলা হরফ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে হতবাক করে দিয়েছিল। হ্যালহেডের ব্যাকরণ বইয়ের অভূতপূর্ব সাফল্য লক্ষ্য করে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস খুবই উৎসাহী হয়ে ওঠেন এবং তাঁরই অনুপ্রেরণায় ১৭৭৯ সালে কলকাতায় চার্লস উইলকিন্সের পরিচালনাধীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছাপাখানা গড়ে ওঠে কলকাতা শহরে। সেখানেও নিয়ে আসা হয় পঞ্চাননকে সঙ্গে থাকেন তাঁর ভাই গদাধর। ১৭৮৫ সাল নাগাদও পুরোদমে এই সরকারি ছাপাখানায় কাজ চলত এবং পঞ্চানন সেখানে কাজ করতেন দক্ষতার সঙ্গে। হরফ নির্মাণের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কলাকৌশল ছিল তাঁর আয়ত্তে। ১৭৮০-এর দশকেই দুই ভাই শ্রীরামপুরের বটতলাতে একটি খুপরি ঘরে বসবাস শুরু করেছিলেন। এর কিছুকাল পরে উইলিয়াম কেরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল পঞ্চাননের। কেরী ছিলেন একজন খ্রিস্টধর্ম প্রচারক। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাভাষায় খ্রিস্টধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ ছাপিয়ে চারদিকে বিলি করা। কিন্তু বাংলা হরফে গ্রন্থ ছাপানো সহজ ব্যপার নয় তা তিনি জানতেন। গোড়ার দিকে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসে মালদার মদনাবতী অঞ্চলের খিদিরপুরে একটি ছাপাখানা বসিয়ে বিচল হরফের সাহায্যে বাংলা বই ছাপানোর কথা ভাবলেও খরচের দিকে তাকিয়ে পিছিয়ে এসেছিলেন। ১৭৯৫ সাল নাগাদ কেরী বিলেত থেকেই খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলেন বাংলার এক-একটি হরফ ঢালাই করতে ১৮ শিলিং করে খরচ হবে। সেই অনুযায়ী ছশো ছেনি হরফ তৈরি করে দশহাজার বই ছাপতে যে পরিমাণ খরচ হত তা ছিল উইলিয়াম কেরীর সাধ্যের অতীত।
এদিকে উহলিয়াম কেরী ও টমাসের উদ্যোগে ধর্মপ্রচারের জন্য শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠিত হল ১৮০০ সালে। মিশন প্রতিষ্ঠিত হওয়া মানে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য প্রয়োজন গ্রন্থ মুদ্রণ। কলকাতায় অবস্থিত কোম্পানির ছাপাখানার প্রধান এক কর্মচারী পঞ্চাননের সঙ্গে পরিচয় হয় কেরীর। তিনি পঞ্চাননকে শ্রীরামপুর মিশনে আসার প্রস্তাব দেন। সেই প্রস্তাবে সায় দিয়ে কোম্পানির ছাপাখানার তৎকালীন কর্তা কোলব্রুক সাহেবের কাছ থেকে মাসখানেক ছুটি নিয়ে পঞ্চানন এসে যোগ দেন শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে। সেখানে পুরাতন মেশিন এবং পঞ্চাননকে নিয়ে ১৮০০ সালে শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের কাজ শুরু হয়েছিল। পঞ্চানন প্রতি হরফ পিছু দর নিতেন এক টাকা চার আনা। কেরীর অনুবাদ করা নিউ টেস্টামেন্ট বাংলায় পঞ্চাননের তৈরি হরফেই ১৮০১ সালে ছাপা হয়েছিল। কালে কালে এই প্রেসটি এশিয়ার বৃহত্তম অক্ষর তৈরির কারখানা বা টাইপ ফাউন্ড্রিতে পরিণত হয়েছিল পঞ্চাননেরই উদ্যোগে। তবে কেবল বাংলা অক্ষরই নয়, ১৮০৩ সালে ভারতবর্ষে প্রথম দেবনাগরী হরফ নির্মাণের কৃতিত্বও কিন্তু পঞ্চাননেরই। কেরীর সংস্কৃত ব্যাকরণ বইয়ের মুদ্রণের জন্য সেই হরফ তৈরি করেছিলেন তিনি। পঞ্চানন এবং গদাধর শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগেই প্রকাশিত প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক ও মাসিক সংবাদপত্র ‘দিগদর্শন’ এবং ‘সমাচার দর্পনে’রও ফন্ট তৈরি করেছিলেন।
একটা সময় পর পঞ্চানন আরও ছোট ও সুক্ষ্ম বাংলা টাইপের একটি সেট নির্মাণ করেছিলেন। দেবনাগরীর ক্ষেত্রেও করেছিলেন তেমনটা। পঞ্চাননের তৈরি হরফ দীর্ঘকাল ধরে ভারতবর্ষের নানা ছাপাখানায় ব্যবহার হয়ে এসেছে। পঞ্চানন এই শৈল্পিক কাজ পঞ্চানন তাঁর জামাতা মনোহর এবং দৌহিত্র কৃষ্ণচন্দ্রকেও শিখিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা পঞ্চাননের সৃষ্টিকে পূর্ণতা দিয়েছিল বলা চলে। উইলকিন্স ও কেরীর নির্দেশনায় বাংলা এবং দেবনাগরী ছাড়াও চীনা, বার্মিজ, তামিল, তেলগু, কন্নড়, ওড়িয়া সহ প্রায় ১৪টি ভাষায় মুদ্রিত বইয়ের জন্য নতুন ধাতব হরফ নির্মাণ করেছিলেন। মিশনারী প্রেস বন্ধ হয়ে গেলেও কেশব চন্দ্র স্ট্রীটে কৃষ্ণচন্দ্রের দুই ভাই রামচন্দ্র ও হরচন্দ্র ‘অধর টাইপ ফাউন্ড্রি’ নামে হরফ তৈরির কারখানা নির্মাণ করেন, যা ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। শোনা যায়, সেখান থেকেই বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁর ‘বর্ণপরিচয়’-এর জন্য অক্ষর তৈরি করিয়েছিলেন। পঞ্চাননের উত্তরপুরুষের কাছ থেকে শোনা যায় মাউন্টিং অর্ডার মোকাবিলায় সাহায্য করবে এমন ২০টি মেশিন অর্ডার দিয়েছিলেন পঞ্চানন, কিন্তু তা জলদস্যুদের হাতে পড়ে লুট হয়ে যায়। পরে মনোহর একটি নতুন অর্ডার পাঠান এবং ১৮০৯ সালে ১২টি মেশিন এসে পৌঁছয়।
বৃদ্ধ বয়সে পঞ্চানন বটতলার বই প্রকাশকদের জন্য চিত্র খোদাইয়ের কাজ করেছিলেন। জামাতা মনোহর কর্মকারকেও এই শিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন তিনি। ১৮০৪ সালে বাংলা হরফের জনক, ভারতবর্ষের মুদ্রণ ইতিহাসের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, পঞ্চানন কর্মকারের মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র
- বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান, সম্পাদক : শামসুজ্জামান খান, সেলিনা হোসেন, আজহার ইসলাম, নূরুল ইসলাম, অপরেশ কুমার ব্যানার্জী, আমিনুর রহমান সুলতান, তপন বাগচী, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত তৃতীয় সংস্করণ, জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮/ জুন ২০১১,
- https://en.m.wikipedia.org
- https://peoplepill.com
- https://en.banglapedia.org/
- shttps://eisamay.com/