পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুরে অবস্থিত শান্তিনিকেতন। এখানে বহু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। সেগুলো ঘোরার জন্য লোকাল গাইডের সাহায্য নেওয়া যায়। সাধারণত টোটো বা গাড়ি করে তারা এখানের বিভিন্ন স্থানগুলো ঘুরে দেখায়। তবে টোটো বা গাড়ি ভাড়া করার আগে জিজ্ঞেস করে নেবেন কোন কোন স্থান তারা দেখাবে। তাদের সঙ্গে সাধারণত তালিকা থাকে। সেই তালিকার বাইরেও আপনি কিছু দেখতে চাইলে আগে থেকে কথা বলে নিন। শান্তিনিকেতনে কী দেখবেন সেই স্থানগুলোকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস এবং শান্তিনিকেতনের অন্যান্য ভ্রমণস্থান। সেই সমস্ত জায়গাগুলোর একটি তালিকা এখানে দেওয়া হল –
বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস
শান্তিনিকেতনের প্রাণকেন্দ্র হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের হাতে গড়ে তোলা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকৃতির মাঝে উন্মুক্ত শিক্ষাচিন্তার ভাবনা থেকে তিনি এটি গড়ে তুলেছিলেন। পরবর্তীকালে শিক্ষা ও শিল্পের অন্যতম পীঠস্থান হয়ে ওঠে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। উদ্বোধনের ত্রিশ বছর পড়ে ১৯৫১ সালে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে। করোনা মহামারীর আগে অবধি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে বিভিন্ন ভবনগুলো দেখা যেত। বর্তমানে দুটি স্থান ছাড়া ক্যাম্পাসের আর কোথাও প্রবেশ করা যায় না। বাইরে থেকে স্থানগুলো ঘুরে দেখতে পারেন।
শান্তিনিকেতন ভবন – প্রথম দর্শনীয় স্থান অবশ্যই শান্তিনিকেতন ভবন, যা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তৈরি করেছিলেন। এটি আশ্রমের সর্বাপেক্ষা পুরনো বাড়ি ।প্রথমে বাড়িটি একতলা ছিল পরে দোতলা বাড়ি হয়। এই বাড়িতে তিনি ধ্যানে বসতেন। ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় স্থাপনের সময় রবীন্দ্রনাথ কিছুকাল সপরিবারে এই বাড়িতে বাস করেছিলেন। তবে পরে আর কখনো তিনি এটি বসতবাড়ি হিসেবে ব্যবহার করেননি। এই বাড়ির সামনে বিখ্যাত শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ নির্মিত একটি ভাস্কর্য রয়েছে।
উত্তরায়ন – পাঁচটি বাড়ি নিয়ে গড়ে উঠেছে উত্তরায়ন। বাড়িগুলির নাম হল – উদয়ন, কোনার্ক, শ্যামলী, পুনশ্চ এবং উদীচী।এই প্রতিটি বাড়ি ঢোকার মুখেই লেখা আছে কবে কখন কী কারণে রবীন্দ্রনাথ সেই বাড়িগুলি তৈরি করেছিলেন । রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, নোবেল পুরস্কারের রেপ্লিকা, বিভিন্ন দেশ থেকে পাওয়া উপহার ,বাদ্যযন্ত্র, কলম সবকিছুই ‘উদয়ন’ বাড়িটিতে সাজানো রয়েছে। বিভিন্ন সময় কবি এই বাড়িগুলোতে বাস করেছিলেন। বিশ্বভারতী উত্তরায়ন চত্বরে একটি ‘চিত্রভানু-গুহাঘর’ তৈরি করেছে, যেখানে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি সংরক্ষিত আছে। পুরো উত্তরায়ন চত্বর জুড়ে রয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য ও বট, শিরীষ ,মালতি সহ নানান গাছের সারি। এটি শান্তিনিকেতন রবীন্দ্র মিউজিয়াম নামেও পরিচিত এবং টিকিট কেটে এখানে প্রবেশ করতে হয়। টিকিটের মূল্য ৭০ টাকা।

ছাতিমতলা – দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে এক ছাতিমতলায় কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম করতেন। যদিও পুরাতন সেই ছাতিম গাছটি মারা গেছে, তার জায়গায় দুটি ছাতিম গাছ রোপন করা হয়েছে; কিন্তু আজও সেই ছাতিমতলা শান্তিনিকেতনের অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
তালধ্বজ– অনন্য সুন্দর মাটির বাড়িটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে ,একটি তালগাছ কে কেন্দ্র করে এই বাড়িটি নির্মিত হয়েছে এবং তাল গাছের পাতা গুলি ধ্বজার মতো বাড়িটির ওপরে শোভা পায় বলেই বাড়িটির নাম তালধ্বজ।

দেহলি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃণালিনী দেবীর সাথে এখানে বাস করতেন। মৃণালিনী দেবীর স্মরণে এখানে শিশুদের বিদ্যালয় ‘মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালা’র সূচনা হয়। এটি আম্রকুঞ্জের ঠিক দক্ষিণ কোণে অবস্থিত। দেহলির পাশে যে খড়ের বাড়িটি আছে তাকেই নতুন বাড়ি বলা হয়। নতুন বাড়ির পশ্চিম দিকে একটি খড়ের চালের বাড়ি আছে। সেটি শান্তিনিকেতন আশ্রমের মহিলাদের সমিতির ঘর, তার নাম ‘’আলাপিনী মহিলা সমিতি’।
পাঠভবন – পাঠভবনে প্রাথমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা দেওয়া হয়। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ এটি প্রতিষ্ঠা করেন। ভবনটিতে নন্দলাল বসুর তৈরি অসাধারণ শিল্পকলার প্রকাশ রয়েছে।

কলাভবন ও কালো বাড়ি– কলাভবন ছিল ঔপনিবেশিক শিল্পশিক্ষারীতির বিরুদ্ধে বিকল্প, দেশীয় শিল্পশিক্ষা। কলাশিক্ষা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব ভাবনা এবং নন্দলালের প্রায়োগিক কুশলতায় কলাভবন ক্রমে ক্রমে হয়ে ওঠে বিশ্বভারতীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সেই কলাভবনের কাছেই রয়েছে কালো বাড়ি, যা শুরু করেছিলেন নন্দলাল বসু। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও প্রথমে এই কাজে সন্তুষ্ট না হলেও পরে বাড়িটি দেখে নন্দলালকে নাকি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘এ আশ্রমের বিশেষ সম্পদ।’’
রবীন্দ্র ভবন – বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসের মধ্যেই অবস্থিত রবীন্দ্র ভবনটি ১৯৪২ সালে কবি প্রয়াণের ঠিক পরেই স্থাপিত হয়। এ ভবনটিতে একটি সংগ্রহশালা আছে যেখানে রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি, ছবি ,রবীন্দ্রনাথের হাতে আঁকা কিছু চিত্র, এছাড়া বিভিন্ন বই,পত্রিকা এবং কবির জীবনের সমস্ত জিনিসপত্র এই ভবনটিতে সংরক্ষিত আছে।এই ভবনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

উপাসনা গৃহ – বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসের মধ্যেই অবস্থিত এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বেলজিয়াম কাচের রঙিন কারুকার্যময় নান্দনিক নকশায় নির্মিত এই উপাসনা গৃহ স্থানীয় লোকজনের কাছে কাঁচের মন্দির নামে পরিচিত। শুধুমাত্র বুধবারে এটি খোলা থাকে এবং সাধারণের জন্য এখানে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে এখানে প্রবেশ করতে হলে সকলকে সম্পূর্ণ সাদা পোশাক পড়ে যেতে হয়। ছেলেদের ক্ষেত্রে সাদা পাঞ্জাবি, ধুতি এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে সাদা শাড়ি পড়ে এখানে প্রবেশ করতে হয়।
পৌষ মেলার মাঠ – উপাসনা গৃহের ঠিক উলটোদিকে রাস্তার অপর পাড়ে রয়েছে পুরনো পৌষ মেলার মাঠ। কোভিডের সময় থেকে এখানে পৌষ মেলা বন্ধ আছে। বর্তমানে শুধুমাত্র বাইরে থেকে এই মাঠ দেখা যায়, ভেতরে প্রবেশ করা যায় না। বর্তমান পৌষ মেলাটি পুরনো মেলা থেকে এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
এছাড়াও বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসের মধ্যে রয়েছে সংগীত ভবন, চিনা ভবন, নিপ্পন ভবন, বাংলাদেশ ভবন, ভাষা ভবন, আম্র কুঞ্জ, সিংহ সদন, ঘন্টা তলা, রতন কুঠি, মালঞ্চ, শালবিথী, গৌড় প্রাঙ্গণ, তিনপাহাড়, বকুলবীথি ইত্যাদি যা কেবল বাইরে থেকেই দেখতে পারেন।
শান্তিনিকেতনের অন্যান্য ভ্রমণস্থান
বল্লভপুর অভয়ারণ্য – বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস থেকে দেড় কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত বল্লভপুর অভয়ারণ্য। এখানে মূলত চিতল হরিণ দেখতে পাওয়া যায়। ছাত্রছাত্রীদের জন্য টিকিট মূল্য ন্যুনতম হওয়ার ফলে প্রচুর ছাত্রছাত্রী এখানে আড্ডা দিতে আসে। বল্লভপুর অভয়ারণ্য ভ্রমণের খুঁটিনাটি জানতে পড়ুন এখানে।
সৃজনী শিল্পগ্রাম – বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বে শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন রোডের ওপর অবস্থিত সৃজনী শিল্পগ্রাম। এটি শান্তিনিকেতনের তুলনামূলক ভাবে নবীন পর্যটনকেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০০৮ সালে এই গ্রাম তৈরি করে। টিকিট কেটে এখানে প্রবেশ করতে হয়। এখানে পুরো গ্রামটাই দেখার মত। মাঠ জুড়ে রয়েছে নানা আকারের নানা মূর্তি যা দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে যায়। গ্রামটি ঘুরে দেখতে প্রায় ঘণ্টা খানেক সময় লাগবে।

সোনাঝুরি – বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস থেকে চার কিলোমিটার দূরে খোয়াই রোডের ওপর অবস্থিত সোনাঝুরিতে রোজ হাট বসলেও শনিবারে খুব বড় করে হাট বসে। এখানে হাতের তৈরি প্রচুর সুন্দর জিনিস পাওয়া যায়। ঘর সাজানোর জিনিস থেকে শুরু করে শাড়ি, গয়না, বেতের জিনিস, বিভিন্নজনকে উপহার দেওয়ার জন্য বিভিন্ন জিনিস এখানে পাওয়া যায়। সেখান থেকে অবশ্যই কিছু কিনুন। সেই একই জিনিস বেশ কিছু ব্যবসায়ী কিনে এনে কলকাতার বিভিন্ন মলে বা দোকানে অনেক চড়া দামে বিক্রি করে। এই হাটে কেনাকাটি ছাড়াও উপরিপাওনা হল বাউলদের জমায়েত। তাদের কণ্ঠে বাউলসঙ্গীত শুনলে একমনে কখন যে সন্ধ্যে নেমে আসবে বুঝতেও পারবেন না। শান্তিনিকেতনে এলে অবশ্যই এখানে আসার চেষ্টা করবেন। তবে শুধু সোনাঝুরিতেই না, শান্তিনিকেতন মানেই তো বাউলদের জায়গা। আপনি গোটা শান্তিনিকেতন জুড়েই তাদের পাবেন। স্থানীয়রা এখানে পিকনিকের জন্য আসেন। শীতকালে গাছের ছায়ায় বসে পিকনিক করার মজাই আলাদা।
প্রকৃতি ভবন – বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস থেকে চার কিলোমিটার দূরে খোয়াই রোডের ওপর অবস্থিত প্রকৃতি ভবন। সোনাঝুরি হাট থেকে পায়ে হাঁটা দুরত্বেই এটি অবস্থিত। প্রকৃতি দ্বারা তৈরি ভাস্কর্য নিয়ে এই জায়গাটি বানানো হয়েছে। টিকিট কেটে এখানে প্রবেশ করতে হয়।

কোপাই নদী ভিউ পয়েন্ট – যদিও শান্তিনিকেতনের নানা জায়গা দিয়েই বয়ে গেছে ছোট্ট নদী কোপাই, তাও ভিউ পয়েন্ট বলতে যেটা বোঝায়, সেটা রয়েছে বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। “আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে” – বলা হয় কোপাই নদীকে কেন্দ্র করেই রবি ঠাকুর লিখেছিলেন কবিতাটি। তাই এই নদীর এক ঐতিহাসিক এবং কাব্যিক গুরুত্ব রয়েছে। বর্ষাকাল ছাড়া বছরের অন্যান্য সময় এখানে জল থাকে খুবই কম। সৌন্দর্যের দিক থেকেও আহামরি কিছু নয়, কিন্তু যে জায়গা নিয়ে রবি ঠাকুর লিখে গেছেন, তা দেখতে দেখতে মন যে হারিয়ে যাবেই সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমার কুটির – বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস থেকে সাড়ে ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সবুজে ঘেরা আমার কুটির। বিপ্লবী সুষেণ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল আমার কুটির। গ্রামের মানুষের হাতে তৈরি জিনিস বিক্রি হয় এখানে। হাতের কাজের জিনিসের জন্য জায়গাটা বিখ্যাত। এখানের শোরুম থেকে বেতের সামগ্রী, ঘর সাজানোর বিভিন্ন জিনিস, শাড়ি, জুয়েলারী, চামড়ার ওপর বাটিকের কাজ বা ব্যাগ, কাঁথা কাজ, গালা শিল্প, তাঁত শিল্প ইত্যাদি কিনতে পারেন। ঘর সাজাতে বা বিভিন্নজনকে উপহার দেওয়ার জন্য এইগুলো খুবই ভালো। শোরুমের পাশেই একটা মিউজিয়াম আছে যেখানে আমার কুটিরকে কেন্দ্র করে কিছু ছবি ও শিল্পসামগ্রী প্রদর্শন করা হয়।
সর্বশেষ সম্পাদনার সময়কাল – ২০২৩