দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ঠাকুর পরিবারের দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ছেলে এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ। তিনি ছিলেন একাধারে কবি গণিতজ্ঞ,দার্শনিক ও সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ।

১৮৪০ খ্রীস্টাব্দের ১১ মার্চ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মায়ের নাম সারদাদেবী ও স্ত্রীর নাম সর্বসুন্দরী দেবী। ছেলে সুধীন্দ্রনাথ, দীপেন্দ্রনাথ, অরুণেন্দুনাথ। নাতি দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সৌমেন্দ্রনাথ, নাতনি লতিকা দেবী।
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বালক বয়সের শিক্ষা বাড়িতে থেকেই লাভ করেন। পরে দু’বছর তিনি সেন্ট পলস স্কুলে পড়াশোনা করেন। কিছুদিন হিন্দু কলেজ তথা বর্তমান প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াশোনা করেন।

কবি হিসেবে দ্বিজেন্দ্রনাথের স্থান বিশিষ্ট। ১৮৭৫ সালে স্বপ্নপ্রয়াণ নামে  রূপক  কাব্য রচনা করে তিনি বাংলা সাহিত্যে নিজের জায়গা করে নেন। ভাষা,  ছন্দ ও রচনাভঙ্গির দিক দিয়ে ঈশ্বর গুপ্তের বোধেন্দুবিকাশ (১৮৬৩) ও বিহারীলালের সারদামঙ্গল (১৮৭০) দুইয়েরই আদর্শ স্বপ্নপ্রয়াণে লিখিত হয়েছিল। পরে কাব্যমালা (১৯২০) নামে দ্বিজেন্দ্রনাথের আরও একটি কবিতার বই  প্রকাশিত হয়।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

দ্বিজেন্দ্রনাথ বাংলা ভাষায় প্রথম গানের  স্বরলিপি ও বাংলা শর্টহ্যান্ডবিষয়ক বই রেখাক্ষর বর্ণমালা (১৯১২) লেখেন।বাংলা  ব্যাকরণ নিয়েও তিনি চর্চা করেন। স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি কলকাতায় হিন্দুমেলার (১৮৬৭) আয়োজন করেন এবং ১৮৭০-৭৩ পর্বে তিনি এর সম্পাদক ছিলেন। বিদ্বজ্জন-সমাগম (১৮৭৪), সারস্বত সমাজ (১৮৮২), ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা, ন্যাশনাল সোসাইটি, বেঙ্গল থিওসফিক্যাল সোসাইটি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন।

দ্বিজেন্দ্রনাথ ১৮৯৪ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বিশিষ্ট সদস্য এবং পরপর তিনবার (১৮৯৭-১৯০০) এর সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের (১৯১৩) মূল সভাপতি এবং আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদকের (১৮৬৬-৭১) দায়িত্বও পালন করেন। ১৮৭৭ সাল থেকে দীর্ঘ সাত বছর তিনি ভারতী ও ১৮৮৪ সাল থেকে সুদীর্ঘ ২৫ বছর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি সাপ্তাহিক হিতবাদী (১৮৯১) পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

পরে দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতীয় দর্শন ও সমাজতত্ত্ব চর্চায় মগ্ন ছিলেন। এসব বিষয়ে তাঁর অনেক মূল্যবান রচনা আছে। দর্শনবিষয়ক রচনাগুলিতে তিনি শঙ্করের অদ্বৈতবাদকে খন্ডন করার চেষ্টা করেন। তিনি মহর্ষি-নির্দিষ্ট আদর্শ অনুসরণে উপাসনামূলক ব্রহ্মবাদের ব্যাখ্যা করেন। সমাজতত্ত্ববিষয়ক রচনায় দ্বিজেন্দ্রনাথ উনিশ শতকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আদর্শের সংঘাতের কারণ গভীর পর্যবেক্ষণ সহকারে আলোচনা করেন। এ বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর মিল পাওয়া যায়।

দ্বিজেন্দ্রনাথ ছবি আঁকাতেও বিশেষ দক্ষ ছিলেন। গণিত,  দর্শন, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর বেশ কয়েকটি বই আছে। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভ্রাতৃভাব (১৮৬৩), তত্ত্ববিদ্যা (৪ খন্ড, ১৮৬৬-৬৯), সোনার কাঠি রূপার কাঠি (১৮৮৫), সোনায় সোহাগা (১৮৮৫), আর্য্যামি এবং সাহেবিআনা (১৮৯০), সামাজিক রোগের কবিরাজী চিকিৎসা (১৮৯১), অদ্বৈতমতের সমালোচনা (১৮৯৬), ব্রহ্মজ্ঞান ও ব্রহ্মসাধনা (১৯০০), বঙ্গের রঙ্গভূমি (১৯০৭), হারামণির অন্বেষণ (১৯০৮), গীতাপাঠের ভূমিকা (১৯১৫), প্রবন্ধমালা (১৯২০) প্রভৃতি। ইংরাজি ভাষাতেও তাঁর কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়, যেমন Ontology (১৮৭১), Boxometry (বাক্স রচনা সম্পর্কিত, ১৯১৩)  ইত্যাদি। এছাড়া জ্যামিতি-বিষয়ে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি গ্রন্থ আছে, যাতে বারোটি পুরানো স্বতঃসিদ্ধ বাতিল করে তিনি বারোটি নতুন স্বতঃসিদ্ধ উদ্ভাবন করেন।

দ্বিজেন্দ্রনাথ কিছু  ব্রহ্মসঙ্গীত ও স্বদেশী গান লিখেছিলেন। হিন্দুমেলার জন্য লেখা তাঁর এরূপ একটি জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান হল ‘মলিন মুখচন্দ্রমা ভারত তোমারি।’ সেইসময় প্রতিবিম্ব, তত্ত্ববোধিনী, ভারতী,  সাধনা, নবপর্যায়ের  বঙ্গদর্শন,  মানসী,  সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, শান্তিনিকেতন, প্রবাসী,  সবুজপত্র প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর অনেক রচনা প্রকাশিত হয়। 

১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি শান্তিনিকেতনে তাঁর মৃত্যু হয়। 

আপনার মতামত জানান