বিখ্যাত বাঙালি ভূতত্ত্ববিদ এবং জীবাশ্ম-বিশেষজ্ঞ প্রমথনাথ বসু (Pramatha Nath Bose) প্রথম ওড়িশার ময়ূরভঞ্জে প্রথম লৌহ আকরিকের সন্ধান পেয়েছিলেন। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার একজন পদস্থ অফিসার হিসেবে শিবালিক পর্বতের জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণা ও সমীক্ষা পরিচালনা করেছিলেন তিনি। প্রমথনাথ বসুই প্রথম ভারতের প্রথম সাবান কারখানা স্থাপন করেন এবং পরে জামশেদজি টাটার সঙ্গে একত্রে লৌহ আকরিকের প্রভূত সম্ভারের সম্ভাবনা দেখে লৌ-ইস্পাত কারখানা গড়ে তোলেন। বাংলার প্রথম ভূতত্ত্ববিদ ছিলেন তিনিই। বেঙ্গল টেকনিক্যাল কলেজের কর্ণধার ও উপদেষ্টা পদেও আসীন ছিলেন তিনি। ১৮৮৪ সালে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান-শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি লেখেন ‘প্রাকৃতিক ইতিহাস’ নামের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ লক্ষ্য করা যায় ‘উপায় কী?’ নামক প্রবন্ধে যেখানে তিনি দেশীয় শিল্পের অগ্রগতির মধ্য দিয়ে ধনসম্পদ বৃদ্ধি করার কথা বলেন। এই স্বদেশি শিল্প গড়ে তুলতেই প্রমথনাথ বসু প্রথম ১৮৯১ সালে গড়ে তোলেন ‘ভারতীয় শিল্পোদ্যোগ সম্মেলন’। দূর্গম পাহাড়ে, জঙ্গলে খনিজ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রসমীক্ষা করে বরাকর-রানিগঞ্জে অভ্র, দার্জিলিং-এ কয়লা, সিকিমে তামা, জব্বলপুরে ম্যাঙ্গানিজ ও লোহা, ব্রহ্মদেশে গ্রানাইট ও কয়লার সন্ধান পান তিনি। তাঁর পরামর্শেই সাকচিতে প্রথম টাটার লৌহ-ইস্পাত কারখানা স্থাপিত হয় যে স্থান পরবর্তীকালে জামশেদপুর নামে পরিচিতি লাভ করে।
১৮৫৫ সালের ১২ মে ২৪ পরগণার কুশদহের অন্তর্গত গোবরডাঙার গৈপুর গ্রামে প্রমথনাথ বসুর জন্ম হয়। তাঁর বাবা তারাপ্রসন্ন বসু সরকারের জলপুলিশ বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল শশীমুখী দেবী। তাঁদের নয় সন্তানের মধ্যে প্রমথনাথ ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান তথা জ্যেষ্ঠ পুত্র। ছোটবেলা থেকেই খুবই মেধাবী ছিলেন তিনি। ১৮৮২ সালের ২৪ জুলাই ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্তের কন্যা কমলার সঙ্গে প্রমথনাথ বসুর বিবাহ হয়। তাঁদের সেই বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথ। তাঁদের মোট নয় সন্তান জন্মায়।
খাঁটুরার আদর্শ বঙ্গ বিদ্যালয়ে প্রাথমিক পড়াশোনা সম্পন্ন হয় তাঁর। তাঁর ঠাকুরদাদা নবকৃষ্ণ বসু ১৮৬৪ সালে তাঁকে কৃষ্ণনগরে নিয়ে যান এবং কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে প্রমথনাথকে ভর্তি করে দেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই দশম শ্রেণির পাঠ সমাপ্ত করেন প্রমথনাথ বসু। সেকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৬ বছর না হলে বসাই যেত না, তাই পরের বছর ১৮৭১ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপরে ১৮৭৩ সালে কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে এফ এ পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেন এবং কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে স্নাতক স্তরে ভর্তি হন। তবে কৃষ্ণনগর কলেজের অধ্যক্ষ স্যামুয়েল লর এবং অন্যতম শিক্ষক অম্বিকাচরণ চক্রবর্তীই প্রথম প্রমথনাথ বসুকে গিলক্রাইস্ট বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। ১৮৭৪ সালে সমগ্র ভারতে গিলক্রাইস্ট বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার পাঁচ বছরের জন্য বিলেতে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দেন। ঐ বছরই অক্টোবর মাসে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের স্নাতক স্তরের ক্লাসে ভর্তি হন প্রমথনাথ বসু। সেখানে রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, প্রাকৃতিক ভূগোল, তর্কশাস্ত্র ও দর্শন বিষয়ে অধ্যয়ন করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রমথনাথ উদ্ভিদবিদ্যায় প্রথম এবং জীববিদ্যায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। এরপরে ১৮৭৮ সালে রয়্যাল স্কুল অফ মাইনসে ভর্তি হন তিনি। প্রাণীবিদ্যা ও প্রত্নজীববিদ্যায় এবারে তিনি প্রথম স্থান লাভ করেন। এখানেই প্রথম বিখ্যাত অধ্যাপক ও জীববিজ্ঞানী টি এইচ হাক্সলির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাঁর। ১৮৭৯ সালে বৃত্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ছাত্রদের পড়িয়ে এবং ভারতবর্ষ সম্পর্কে বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দিয়ে অর্থোপার্জন করতে শুরু করেন প্রমথনাথ বসু। ইংল্যান্ডে থাকার সময়েই ব্রিটিশ শাসনের অন্ধকারময় দিকগুলি এবং ভারতে তাঁদের শাসনব্যবস্থার অরাজকতা সম্পর্কে বক্তব্য তুলে ধরতে থাকেন। লন্ডনে প্রবাসী ভারতীয়দের সমস্যা সমাধান ও আলোচনার জন্য স্থাপিত ইন্ডিয়া সোসাইটির সম্পাদক হন তিনি। এই সময়েই দাদাভাই নৌরজি, আনন্দমোহন বসু এবং লালমোহন ঘোষের সঙ্গে প্রমথনাথের আলাপ হয়।
১৮৮০ সালের ১৩ মে থেকে ১৯০৩ সালের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ২৪ বছর ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ‘জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’র চাকরিতে নিযুক্ত থেকেছেন প্রমথনাথ বসু। অত্যন্ত শীতে খোলা প্রান্তরে তাঁবু খাটিয়ে, কখনও উট কিংবা ঘোড়ার পিঠে চড়ে, নৌকা করে নদীপথে, কখনও আবার দুর্গম অরণ্য, পাহাড় ইত্যাদি নানা স্থানে খনিজ অনুসন্ধান করেছেন তিনি। প্রথমে ছয় মাস ব্যাপী এভাবেই ক্ষেত্র সমীক্ষা আর তারপর অফিসে বসে তার প্রতিবেদন তৈরি করেছেন প্রমথনাথ বসু। ‘রেকর্ডস অফ জি এস আই’-তে প্রমথনাথের মোট ১৩টি গবেষণাপত্র ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাঁর এই ক্ষেত্র সমীক্ষার ফলেই মধ্যপ্রদেশের ধূলি ও রাজহরাতে আকরিক লোহা, রায়পুরে লিগনাইট কয়লা, দার্জিলিং-এ কয়লা, সিকিমে তামা, বরাকর ও রানিগঞ্জে অভ্র, জব্বলপুরে ম্যাঙ্গানিজ ও লোহা, ব্রহ্মদেশে কয়লা ও গ্রানাইট পাথর ইত্যাদি খনিজ আবিষ্কৃত হয়। এই খনিজগুলি ভারতের শিল্প সমৃদ্ধির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাত বছর পর ডেপুটি সুপারিনটেন্ডেন্ট পদে উন্নীত হন তিনি। এই সব দু বছর যাবৎ তিনি কার্যকরী দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপারিনটেন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করেন। ইতিমধ্যে দু বছরের জন্য ফার্লো ছুটি কাটান প্রমথনাথ, পরে ফিরে এসে দেখেন তাঁর অধস্তন টমাস হেনরি হল্যান্ডের পদোন্নতি হয়েছে, কিন্তু তাঁকে সেই ডেপুটি সুপারিনটেন্ডেন্টের পদেই বহাল রাখা হয়। ফলে এই ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়ে চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন প্রমথনাথ বসু। এর ফলে মাত্র ৪১৩ টাকা সরকারি ভাতাতেই সারাজীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে তাঁকে।
১৯০৩ সালের ১৫ নভেম্বর প্রমথনাথ বসু উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ এলাকায় স্টেট জিওলজিস্ট হিসেবে নিযুক্ত হন। এখানেই গরুমহিষানিতে লৌহ আকরিকের ভান্ডার আবিষ্কার করেন তিনি। এই আবিষ্কারের পরেই টাটা কোম্পানির তৎকালীন কর্ণধার জামশেদজী টাটাকে চিঠি লিখে প্রমথনাথ বসু ভারতের এই অঞ্চলে একটি লৌহ-ইস্পাত কারখানা গড়ে তোলার কথা ভাবতে অনুরোধ করেন। চিঠি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই জামশেদজী টাটার মৃত্যু হয় এবং পরে ১৯০৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি স্যার দোরাবজী টাটার তত্ত্বাবধানে সুবর্ণরেখা ও খরকাই নদীর সঙ্গমে সাকচিতে টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টীল ওয়ার্কস লিমিটেড কারখানা গড়ে ওঠে। টাটা কর্তৃপক্ষ তাঁর এই কাজে খুশি হয়ে কোম্পানির শেয়ার বিনামূল্যে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এই প্রস্তাবে অসম্মত হন প্রমথনাথ বসু।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রমথনাথ বসুর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। প্রমথনাথের বাড়িতে এসে বহুবার গান গেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সঙ্গে একত্রেই ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন প্রমথনাথ বসু। স্বদেশি শিল্পের প্রসারের জন্য তিনি ১৮৯১ সালে গড়ে তোলেন ভারতীয় শিল্পোদ্যোগ সম্মেলন। তাছাড়া আসানসোলে কয়লাখনি পরিচালনা, পূর্ব ভারতে প্রথম আধুনিক সাবান কারখানা স্থাপনের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার পিছনে রাসবিহারী ঘোষ, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে প্রমথনাথ বসুর নামও জড়িয়ে আছে। বিজ্ঞান শিক্ষার আধুনিকীকরণে প্রমথনাথ বসু অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ১৮৮৬ সালে ‘টেকনিক্যাল এডুকেশন ইন বেঙ্গল’ নামে একটি পুস্তিকা লেখেন তিনি। ১৯০১ থেকে ১৯০৩ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে ভূতত্ত্ব বিষয়ে অধ্যাপনাও করেছেন তিনি। তাছাড়া মহেন্দ্রলাল সরকার কর্তৃক স্থাপিত ‘ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান উৎকর্ষ সভা’য় ভূতত্ত্ব পড়াতেন প্রমথনাথ। বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রথমে অধ্যক্ষ এবং পরে রেক্টর পদে আসীন ছিলেন প্রমথনাথ বসু। হরিদ্বারের পশ্চিম প্রান্ত থেকে জম্মু পর্যন্ত বিস্তৃত শিবালিক পাহাড়ে তিন ধরনের নর-বানর জাতীয় প্রাণীর জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছেন প্রমথনাথ বসু যাদের নাম তিনি দিয়েছিলেন শিব-পিথেকাস, ব্রহ্ম-পিথেকাস এবং রাম-পিথেকাস।
১৮৮৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত তিন খণ্ডের ইতিহাসের বিজ্ঞান খণ্ডের সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত হয় প্রমথনাথ বসুর লেখা ‘এ হিস্ট্রি অফ হিন্দু সিভিলাইজেশন ডিউরিং ব্রিটিশ রুল’ বইটির প্রথম খণ্ড। তাঁর বেশিরভাগ রচনাই ইংরেজিতে লেখা হলেও বাংলাতেও বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন প্রমথনাথ বসু যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘প্রাকৃতিক ইতিহাস’ (১৮৮৪), ‘উপায় কী?’ ইত্যাদি। তাঁর লেখা প্রকাশিত বই ও পুস্তিকার সংখ্যা তিরিশটিরও বেশি।
১৯৩৪ সালে ২৭ এপ্রিল প্রমথনাথ বসুর মৃত্যু হয়।
One comment