রাজেশ খান্না

রাজেশ খান্না

রাজেশ খান্না (Rajesh Khanna) একজন চলচ্চিত্র অভিনেতা যিনি হিন্দি চলচ্চিত্রে তাঁর অসামান্য অভিনয় দক্ষতার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। বলিউডের প্রথম সুপারস্টার ছিলেন তিনিই। বলিউডে সবথেকে বেশি জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করার বিরল রেকর্ড রয়েছে তাঁর। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে তাঁর অভিনীত পরপর পনেরোটি চলচ্চিত্র বিপুলভাবে জনপ্রিয় হয়। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে সবথেকে বেশি সাম্মানিকভোগী অভিনেতা ছিলেন রাজেশ খান্না । ১৯৬৬ সালে ‘আখরি খত’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে তাঁর অভিনয় জীবন শুরু হয় এবং সেই ছবিটিই ছিল প্রথম ভারতীয় ছবি যা অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। তাঁর অভিনীত অন্যতম জনপ্রিয় ছবিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘আনন্দ’, ‘দাগ’, ‘বাওয়ার্চি’, ‘কুদরত’, ‘হাথি মেরে সাথি’, ‘অমর প্রেম’, ‘বর্সাত’, ‘কাটি পতঙ্গ’, ‘স্বর্গ’, ‘নসীব’, ‘আন্দাজ’, ‘দো রাস্তে’, ‘রোটি’, ‘নমকহারাম’, ‘ইত্তেফাক’, ‘প্রেম কাহানি’, ‘খামোশি’ ইত্যাদি। মোট পাঁচবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পাওয়া ছাড়াও ২০০৫ সালে ফিল্মফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। এছাড়াও ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে লোকসভার সদস্যও হয়েছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কার অর্জন করেন রাজেশ খান্না।

১৯৪২ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাঞ্জাবের অমৃতসরে এক হিন্দু ক্ষত্রিয় পরিবারে রাজেশ খান্নার জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম ছিল যতীন খান্না। চুনিলাল খান্না ও লীলাবতী খান্নার কাছেই তিনি বড় হয়েছেন। তাঁর প্রকৃত বাবা ও মায়ের নাম ছিল যথাক্রমে লালা হীরানন্দ খান্না এবং চন্দ্রাণী খান্না। তাঁর বাবা লালা হীরানন্দ পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে অমৃতসরে এসে উঠেছিলেন। পেশায় তিনি ছিলেন বুরেওয়ালার এমসি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তাঁর পালক পিতা ছিলেন একজন রেলওয়ে কন্ট্র্যাক্টর এবং ১৯৩৫ সালে তাঁরা সকলে লাহোর থেকে বম্বেতে এসে ওঠেন। মুম্বাইতে গিরাগাঁওয়ের কাছে ঠাকুরদ্বারে ‘সরস্বতী নিবাস’ নামক বাড়িতে বসবাস করতেন রাজেশ খান্না। বিখ্যাত অভিনেত্রী ডিম্পল কাপাডিয়াকে বিবাহ করেছিলেন তিনি। তাঁদের দুই কন্যা যথাক্রমে টুইঙ্কল এবং রিঙ্কি।

সেন্ট সেবাস্টিয়ান গোয়ান্স হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন রাজেশ খান্না। এই স্কুলে তাঁর সহপাঠী ছিলেন রবি কাপুর। এই রবি কাপুরই পরবর্তীকালে অভিনয় জগতে এসে পরিচিত হন ‘জিতেন্দ্র’ নামে। স্কুল জীবন থেকেই থিয়েটারের প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করেন রাজেশ এবং স্কুল ও কলেজে পড়ার সময় বহু থিয়েটারে অভিনয়ও করেন তিনি। আন্তঃকলেজ নাট্য প্রতিযোগিতায় তিনি বেশ কয়েকটি পুরস্কারও পেয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে ‘অন্ধা যুগ’ নাটকে একজন আহত মূক সৈনিকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রাজেশ খান্না এবং তাঁর অভিনয় সকলের কাছেই খুব প্রশংসিত হয়। ১৯৬০ সালের আগেভাগে তাঁকে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে থিয়েটারে কিংবা চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় জায়গা করে নেওয়ার জন্য। পুনের নৌরজি ওয়াডিয়া কলেজে ভর্তি হন তিনি ১৯৫৯ সালে এবং মাত্র দুই বছর পড়েই ১৯৬১ সালে স্নাতক পড়া ছেড়ে দেন তিনি। এরপরে তিনি মুম্বাইয়ের কে. সি. কলেজে ভর্তি হন। রাজেশের কাকার পরামর্শেই চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় আসার উপযোগী করে যতীন খান্নার বদলে তিনি নতুন নাম নেন রাজেশ খান্না হিসেবে। তাঁর স্ত্রী ও তাঁর বন্ধুরা সকলেই তাঁকে ‘কাকা’ বলে ডাকত, পাঞ্জাবি ভাষায় যার অর্থ হল ‘শিশুর মতো দেখতে যে বালক’।


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

১৯৬৬ সালে চেতন আনন্দ পরিচালিত ‘আখরি খত’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন রাজেশ খান্না। এরপরেই রবীন্দ্র ডেভের পরিচালনায় ‘রাজ’ ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। এর আগে ১৯৬৫ সালে ‘অল ইণ্ডিয়া ট্যালেন্ট কনটেস্ট’-এ অভিনয়ের জন্য ফরিদা জালালের পাশাপাশি তিনিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে সেই ‘আখরি খত’ ছবিটিই প্রথম ভারতীয় ছবি হিসেবে শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার ছবির শ্রেণিতে চল্লিশতম অস্কার অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছিল। এরপরে ‘ইউনাইটেড প্রোডিউসার’ নামের একটি সম্মিলিত প্রযোজনা সংস্থার পরপর বেশ কয়েকটি ছবিতে রাজেশ খান্না অভিনয় করেন এবং ভারতীয় দর্শকমহলে সেই ছবিগুলি জনপ্রিয় হতে থাকে। এই প্রযোজনা সংস্থার হয়ে ‘বাহারোঁ কে সপ্‌নে’, ‘অঊরত’, ‘ডোলি’, ‘ইত্তেফাক’ ইত্যাদি ছবিতে অভিনয় করে সাড়া জাগান রাজেশ খান্না। ‘বাহারোঁ কে সপ্‌নে’ ছবিটি এত জনপ্রিয় হয় যে দর্শকের বিপুল চাহিদা অনুযায়ী এক সপ্তাহ ছবিটি চলার পরে সেই ছবির বিয়োগান্তক অংশকে পালটে মিলনান্তক করে দিতে বাধ্য হন পরিচালক। এরপরে ওয়াহিদা রহমানের পরামর্শে অসিত সেন পরিচালিত ‘খামোশি’ ছবির মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান রাজেশ খান্না। ‘আরাধনা’ ছবিতে শর্মিলা ঠাকুর ও ফরিদা জালালের বিপরীতে দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি ভারতের অন্যতম ‘সেরা সুপারস্টার’ হয়ে ওঠেন। এই ছবির মধ্য দিয়েই ভারতীয় দর্শকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে কিশোর কুমারের যিনি পরবর্তীকালে অনেকগুলি ছবিতে রাজেশ খান্নার লিপে জনপ্রিয় কিছু গান গেয়েছিলেন।

১৯৭১ সালে তাঁর অভিনীত ‘হাথি মেরে সাথি’ ছবিটি তৎকালীন সময়ে সবথেকে বেশি বাণিজ্য-সফল ছবির মর্যাদা পায়। এই ছবিটিই সেলিম-জাভেদ জুটির প্রথম চিত্রনাট্য ছিল। সেলিম-জাভেদ অর্থাৎ সেলিম খান এবং জাভেদ আখতার। এই সময়েই রাজেশ খান্না মুম্বাইয়ের কার্টার রোডে রাজেন্দ্র কুমারের একটি বাংলো ‘ডিম্পল’ কিনে নেন ৩১ লক্ষ টাকার বিনিময়ে এবং তার নাম [পাল্টে রাখেন ‘আশীর্বাদ’। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে তাঁর অভিনীত মোট পনেরোটি ছবি পরপর বাণিজ্যসফল ও বিপুল জনপ্রিয় হয়। এই ছবিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘আরাধনা’, ‘ডোলি’, ‘বন্ধন’, ‘ইত্তেফাক’, ‘দো রাস্তে’, ‘খামোশি’, ‘সফর’, ‘দ্য ট্রেন’, ‘কাটি পতঙ্গ’, ‘সচ্চা ঝুটা’, ‘আ মিলো সজনা’, ‘মেহবুব কি মেহেন্দি’, ‘ছোটি বহু’, ‘আনন্দ’ এবং ‘হাথি মেরে সাথী’ । এই সব ছবিই কেবলমাত্র তাঁর একার অভিনয়ের সাফল্যেই বিপুলভাবে জনপ্রিয় হয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘বদনাম ফারিস্তে’-তে তিনি অভিনয় করলেও সেই ছবিটি বক্স অফিসে অসফল হয়। ১৯৭২ সালে তাঁর অভিনীত ‘অমর প্রেম’, ‘আপনা দেশ’, ‘মেরে জীবন সাথী’ ইত্যাদি ছবিগুলি পাঁচ কোটিরও বেশি অর্থ উপার্জন করে এবং তাঁর অভিনীত ‘দিন দৌলত দুনিয়া’, ‘বাওয়ার্চি’, ‘জরু কা গুলাম’ ইত্যাদি ছবিগুলি সাড়ে চার কোটি টাকা উপার্জন করেছিল সেই সময়। ১৯৭৩ সালে ভি. বি. রাজেন্দ্রপ্রসাদের পরিচালনায় ‘বাঙ্গারু বাবু’ নামে একটি তামিল ছবিতে অতিথি শিল্পী হিসেবে কাজ করেন রাজেশ খান্না । ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে মোট সাতটি ছবিতে অভিনয় করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন রাজেশ খান্না যার মধ্যে রয়েছে ‘মেহবুবা’, ‘ত্যাগ’, ‘পল্কো কি চাহো মে’, ‘নকরি’, ‘চক্রব্যুহ’ ইত্যাদি। এইসব ছবির পরিচালক ছিলেন শক্তি সামন্ত, ঋষীকেশ মুখার্জি, বাসু চ্যাটার্জি প্রমুখ। মূলত রোম্যান্টিক ছবিতে অভিনয়ের ফলেই তাঁর একটা বিরাট জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছিল, মাঝে বেশ কিছু অ্যাকশনধর্মী ছবিতেও কাজ করেছিলেন রাজেশ খান্না, কিন্তু সেগুলি বিশেষ দর্শক আনুকূল্য পায়নি। বিখ্যাত পরিচালক রাজ কাপুর তাঁর ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ ছবির জন্য মুখ্য ভূমিকায় রাজেশ খান্নার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ছবিতে রাজেশ খান্নার বদলে শশী কাপুর অভিনয় করেন।

তামিল ছবির বিখ্যাত অভিনেতা কমল হাসানের সঙ্গে তাঁর বেশ সখ্যতা ছিল। রাজেশ খান্না কমল হাসান অভিনীত তিনটি তামিল ছবির রিমেকে অভিনয় করেছিলেন এবং অন্যদিকে কমল হাসানও রাজেশ খান্না অভিনীত দুটি হিন্দি ছবি তামিল ভাষায় রিমেক করেন। আশির দশকে মোট এগারোটি ছবির মধ্যে তাঁর অভিনীত আটটি ছবিই বক্স অফিসে সাফল্য এনে দেয়। ‘রাজপুত’, ‘ধর্মকান্ত’, ‘নিশান’, ‘মকসদ’ ইত্যাদি ছবিতে তিনি অন্য অভিনেতাদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। ১৯৭৮ সালে তামিল ভাষায় বক্স অফিসে সফল ছবি ‘সিগাপ্পু রোজাক্কাল’ ছবির হিন্দি ভাষায় পুনর্নির্মাণ করেন পরিচালক ভারতী রাজা। ‘রেড রোজ’ নামের সেই ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন রাজেশ খান্না যদিও তা দর্শক আনুকূল্য পায় নি। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি কংগ্রেসের পক্ষ থেকে লোকসভার সদস্য হয়েছিলেন। ১৯৯২ সালের পর তাই তাঁকে দশটির বেশি ছবিতে দেখা যায়নি। এরপর থেকেই ছবিতে অভিনয় করা কমিয়ে দেন তিনি।

মোট পাঁচবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েছেন তিনি, সেইসঙ্গে ২০০৫ সালে ফিল্মফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ২০১৩ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কার অর্জন করেন রাজেশ খান্না।

২০১২ সালের ১৮ জুলাই মুম্বাইতে নিজের বাংলো ‘আশীর্বাদ’-এ কিছুদিন যাবৎ অসুস্থতার পরে রাজেশ খান্নার মৃত্যু হয়।  

    

2 comments

আপনার মতামত জানান