রানাঘাট

রানাঘাট

পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত নদীয়া জেলার একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ ইতিহাস বিজড়িত জনপদ হল রানাঘাট (Ranaghat) । রানাঘাট সাবডিভিশনের এটি সদর দপ্তর।

ভৌগোলিক অবস্থানের বিচারে রানাঘাট ২৩.১৮০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.৫৮০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। কলকাতা থেকে ৭৪ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এই রানাঘাট জনপদ। নিকটবর্তী কৃষ্ণনগর থেকে এটি ২৬ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। চূর্ণী নদীর ধারে অবস্থিত এই রানাঘাটের মোট আয়তন মোটামুটিভাবে ৩০ বর্গকিমি। চাকদা, কালনা, শান্তিপুর, বিরনগর ইত্যাদি সবই রানাঘাটের চারপাশে বিস্তৃত।

রানাঘাটের নামকরণ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। ইতিহাসের পাতায় কত শত স্মৃতি, কত ঘটনার অভিঘাত বুকে নিয়ে জেগে আছে রানাঘাট। অনেকেই বলে থাকেন এই জনপদের পূর্বনাম ছিল ব্রহ্মডাঙা। চূর্ণী নদীর ধারে এই জনপদে তখন ছিল বিখ্যাত রানা ডাকাতের আস্তানা। আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে চূর্ণী নদীর বুকে চড়ে বেড়ানো মালবাহী জাহাজ সবই লুঠ করতো রানা ডাকাত। ফলে ভয়ে থাকতো জাহাজের সকল যাত্রীরা। ফলে সেই ভয় থেকেই চূর্ণী নদীর ধারে এই বঙ্গভূমি লোকমুখে রানা ডাকাতের ঘাট থেকে হয়ে উঠলো রানাঘাট। শোনা যায় এখানে নাকি রানা ডাকাতের পূজ্য কালী মায়ের মন্দিরও আছে। আবার অনেকে মনে করেন যে, নদীয়ার রাজপরিবারের বধূরা এই চূর্ণী নদীর ঘাটে স্নান করতে আসতেন বলে একে বলা হতো রানির স্নানের ঘাট। এই রানির স্নানের ঘাট থেকে রানাঘাট নামের উৎপত্তি বলেও অনেকে মনে করেন। বহু মানুষের স্মৃতিতে ও বিশ্বাসে রাজপুত রানার অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে এই নামকরণে। কলকাতার থেকেও বয়সে অনেকটা প্রাচীন এই জনপদের নামকরণের পাশাপাশি আঞ্চলিক ইতিহাসও বেশ ঐতিহ্যপূর্ণ।

নদীয়া জেলার নবদ্বীপ আর রানাঘাট এই দুই জনপদের ইতিহাস বহুধা বিস্তৃত। রানাঘাটের ইতিহাসের মধ্যে প্রাধান্য পায় নদীয়ার রাজপরিবার অর্থাৎ পালচৌধুরী বংশের ইতিহাস। চূর্ণী নদীর ধারের এই রানাঘাট জনপদ নিলামে কিনে নিয়েছিলেন কৃষ্ণপান্তি ও শম্ভু পান্তি। যদিও পান্তি তাঁদের আসল পদবি ছিল না। ১৬৬২ সাল নাগাদ পানের ব্যবসায়ী মহেশচন্দ্র পাল এই রানাঘাটে এসে বসতি শুরু করেন। তাঁর প্রপৌত্র কৃষ্ণকান্ত এবং শম্ভুকে পান ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে মানুষ ‘পান্তি’ বলে ডাকতে শুরু করে। এই কৃষ্ণ পান্তি একসময় প্রভূত সম্পদের অধিকারী হলে মহারাজা শিবচন্দ্র তাঁকে ‘চৌধুরী’ উপাধি দেন। সেই থেকেই এই বংশের মানুষেরা পালচৌধুরী পদবির অধিকারী হন। রানাঘাটের পালচৌধুরীদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিখ্যাত রথযাত্রার ইতিহাস। রানাঘাটের বড়বাজার সংলগ্ন এলাকায় গোপীনাথ মন্দিরে আগে পুজো হতো কৃষ্ণকান্ত ও শম্ভু পান্তির রথ। পরে কৃষ্ণপান্তি রথযাত্রার বিশেষ উৎসব চালু করেন, স্থাপিত হয় জগন্নাথ মন্দির। উল্লেখ্য যে, কৃষ্ণপান্তির রথে জগন্নাথ বরং অধিষ্ঠান করতেন নারায়ণ। রথের পুজোর দিন মন্দিরের বাইরে সাত পাক ঘুরে পুজোপাঠ শেষ করে তবে রথের রশিতে টান পড়ে। এসবই প্রায় তিনশো বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য। তখনও বাংলায় ব্রিটিশরা পাকাপাকিভাবে রাজত্ব স্থাপন করেনি। পালচৌধুরীদের জমিদারবাড়ি আজও সেই ইতিহাস বহন করে চলেছে। স্কটিশ স্থাপত্যে তৈরি বিশাল প্রাসাদ আর ভিতরে টেরাকোটার কাজ করা মন্দির খুবই সৌন্দর্যপূর্ণ। ১৮৬৪ সালে রানাঘাট পুরসভা গঠনের আগেই এখানে রেলপথ বসে। ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত কবি নবীনচন্দ্র সেন একসময় রানাঘাট মহকুমায় জেলা-শাসকের পদে আসীন ছিলেন। ইতিহাস অনুযায়ী তাঁর আমন্ত্রণেই এখানে প্রথম রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন। স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ারে আপামর বাঙালিকে প্রাণিত করতে এই জনপদের বুকে কাজী নজরুল ইসলামের পদধূলি পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতেই এখানে এশিয়ার প্রথম রবীন্দ্রভবন নির্মিত হয়। বিখ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রও কর্মসূত্রে এই রানাঘাটে আসতেন এবং এই জনপদের চারপাশে সে সময় প্রচুর নীলচাষ হতো। এই নীলচাষকে প্রত্যক্ষ করেই তিনি পরে লেখেন ‘নীলদর্পণ’ নাটক। নীলবিদ্রোহের অন্যতম এক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল রানাঘাট। ব্রিটিশ আমলে এই জনপদ আরো বিস্তৃত হয়। ১৮৯৯ সালে গিরিজানাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এই রানাঘাট থেকে প্রকাশ পায় ‘বার্তাবহ’ পত্রিকা। রেলস্টেশনের কাছেই ছিল গিরিজানাথ মুখোপাধ্যায়ের পত্রিকা-দপ্তর এবং শোনা যায় সেখানে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছিলেন একবার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে রানাঘাটের নাম। বাংলা ভাগের সময় প্রথমে ভাগ হয়েছিল এই নদীয়া জেলাও। নদীয়াও এই বিভাজনে বাদ যায়নি, নদীয়া ভেঙে দু-খান হল। প্রথমে নদীয়া জেলা চলে গিয়েছিল পাকিস্তানের মানচিত্রে। কিন্তু দেখা যায় এখানকার মেহেরপুর, কুষ্টিয়া আর চুয়াডাঙায় মুসলমান সংখ্যাগুরু হলেও একমাত্র কৃষ্ণনগর আর রাণাঘাটে হিন্দুদের বসবাস ছিল। তাই কৃষ্ণনগর আর রানাঘাটের হিন্দু রাজারা কখনোই নিজেদের পাকিস্তানের অন্তভুর্ক্ত করতে চায়নি। সেই উত্তাল সময় কৃষ্ণনগরের রাজা সৌরীশচন্দ্র রায় নিজে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে আলোচনায় বসেন এবং তার ফলেই দেশভাগের পরিবর্তিত সিদ্ধান্তে রানাঘাট এবং কৃষ্ণনগর ভারতের মানচিত্রে অক্ষত রয়ে যায়। দেশভাগের সময় ছিন্নমূল অজস্র মানুষ এসে ঠাঁই নিয়েছিলেন এই রানাঘাটে আর তাই রানাঘাটে সেসময় তৈরি হয় কুপার্স ক্যাম্প। শোনা যায় নাকি স্বয়ং বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এই জনপদে পা রেখেছিলেন আর সেই কাহিনি নিয়েই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘আইনস্টাইন ও ইন্দুবালা’ নামের গল্পটি। রানাঘাটের স্টেশন থেকে বেরিয়েই ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, বিভূতিভূষণের বিখ্যাত উপন্যাস যাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। রানাঘাটের প্রাচীন ইতিহাসে জড়িয়ে আছে এক বিশেষ সঙ্গীত ঘরানার অনুষঙ্গ। নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের হাত ধরে এই সঙ্গীত ঘরানা গড়ে ওঠে যার উল্লেখযোগ্য শিল্পী ছিলেন শিবকুমার চট্টোপাধ্যায়।

রানাঘাটের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিখ্যাত কিছু মানুষের নাম। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলামের কথা তো বলা হয়েছে। কিন্তু শুধু তারাই নন, খেলাধূলাই হোক বা স্বাধীনতা সংগ্রাম কিংবা সঙ্গীত সবেতেই রানাঘাটের মানুষদের অবাধ বিচরণ। সঙ্গীত জগতে নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সৃষ্ট ঘরানায় গান গেয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন রানাঘাটের নির্মল চট্টোপাধ্যায়, প্রমথনাথ ভট্টাচার্য, সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, সৌরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। গানের পাশাপাশি নৃত্যের ক্ষেত্রে শিল্পী জ্যোতিপ্রকাশ মিত্রের নাম আজও রানাঘাটবাসীর স্মৃতিতে অমলিন। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, শিক্ষাবিদ পণ্ডিত কালীময় ঘটক, কলকাতার প্রাক্তন মেয়র সন্তোষকুমার বসু, রায়বাহাদুর কুমুদনাথ মল্লিক প্রমুখ উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বদের বাসস্থান ছিল এই রানাঘাটেই। গান্ধিজীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন রানাঘাটের শিবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র মিত্র, নেপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, শিশিরকুমার বসু প্রমুখ। এছাড়া মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনে সহায়তা করেছিলেন এই রানাঘাটেরই সহায়রাম দাস। তাছাড়া ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগদানকারী অসীমকুমার মজুমদার, বিমল কুমার চট্টোপাধ্যায়, কুমারেশ বিশ্বাস, শ্রীধর মুখোপাধ্যায়, মহম্মদ কালু শেখ প্রমুখরা সকলেই রানাঘাটের উজ্জ্বল প্রতিভা। ফুটবল খেলার জগতে এখানেই একসময় গড়ে উঠেছিল পাইওনিয়ার, বিশ্বাস পাড়া, তরুণ ব্যায়াম সমিতি, বোসপাড়া ভারতী সঙ্ঘ ইত্যাদি ফুটবল ক্লাব যেখানে বহু খেলোয়াড় কলকাতার মাঠে খেলে বা বিদেশে খেলে সুনাম অর্জন করেছেন। তাঁদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া সফরকারী অজিত নন্দী, মেলবোর্ন অলিম্পিকে প্রতিনিধিত্বকারী নিখিল নন্দী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

রানাঘাটেই জন্মেছেন আধুনিক সময়ের বিখ্যাত কবি জয় গোস্বামী। অভিনেত্রী রাখি গুলজারের জন্ম এই রানাঘাটেরই উদ্বাস্তু কলোনিতে। এছাড়া অ্যাথলিট ও অলিম্পিয়ান সোমা বিশ্বাসও এই রানাঘাটের অধিবাসী।

২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী রানাঘাটের মানুষদের সাক্ষরতার হার ছিল গড়ে ৮৪ শতাংশ। প্রাচীন ঐতিহ্যসম্পন্ন এই স্থলে শিক্ষার চর্চা বেশ গভীর। রানাঘাট কলেজ এখানকার বিখ্যাত সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও কারিগরি শিক্ষার জন্য এখানে রয়েছে রানাঘাট পলিটেকনিক কলেজ। এগুলি ছাড়াও বহু অনামী প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে রানাঘাটে।

দোলযাত্রা এবং রথযাত্রার জন্য বিখ্যাত এই রানাঘাট। এই জনপদের হরিনগর গ্রামে এখনও বহু মানুষ কীর্তনের আসরে জমায়েত হন। চূর্ণীর তীরবর্তী এই জনপদে পালচৌধুরীদের হাত ধরেই প্রথম রথযাত্রার সূচনা ঘটে যে ঐতিহ্য এবং রীতি আজও একইভাবে বহমান।

লোকসংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে খেলাধূলা, নাটক, পত্রিকা প্রকাশ সব ক্ষেত্রেই রানাঘাটের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সঙ্গীতের বিশেষ ঘরানার পাশাপাশি এখানে গড়ে উঠেছিল ব্রজনাথ পালচৌধুরী ও দ্বারিকানাথ পালচৌধুরীদের হাত ধরে। তাঁরা প্রথম এখানে গড়ে তোলেন বাসন্তী ক্লাব নামে একটি গ্রুপ থিয়েটার আর তারপর থেকে একে একে হ্যাপি ক্লাব, মেরি ক্লাব, ন্যাশনাল ক্লাব, ডিফেন্স ড্রামাটিক ক্লাব, সুহৃদ সঙ্ঘ, শিল্পীদল, রূপকার, বৈকালী ইত্যাদি নানাবিধ নাট্যসংস্থা গড়ে ওঠে। ক্লাবের নাটকের এক বিশেষ ঐতিহ্য রয়েছে রানাঘাটে। রানাঘাটের নাট্য আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা ছিল পরিচালক ও নাট্যকার দেবনারায়ণ গুপ্ত এবং হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ‘বার্তাবহ’ এই জনপদের প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা। এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরবর্তীকালে প্রকাশ পেয়েছে ‘অশনি’, ‘সীমান্তবাণী’, ‘ছাত্রবাণী’, ‘টর্চ’, ‘ঝড়’, ‘সবুজসোনা’, ‘চূর্ণী’, ‘রাতু’ ইত্যাদি নানা পত্র-পত্রিকা। রানাঘাটের হস্তশিল্প ও বুটিক খুবই জনপ্রিয়। বস্ত্রশিল্পের জগতে রানাঘাটের স্বল্প হলেও অবদান অনস্বীকার্য। কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়ার মতো রানাঘাটের পান্তুয়ার স্বাদও পুরো বাংলা জুড়ে আর দ্বিতীয় কোথাও পাওয়া যায় না।

রানাঘাট ও তার আশেপাশের অনেকটা জায়গা কৃষিকাজের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। ধান, গম ও বিভিন্ন ফলের চাষ হয় এখানে। তাছাড়া ফুল চাষের ক্ষেত্রে রানাঘাট অত্যন্ত প্রসিদ্ধ।

দর্শনীয় স্থানে মধ্যে চুর্ণী নদীর সেতু, সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, শঙ্করপুরের ক্ষেত সহ দেখে আসা যায় পালচৌধুরীদের রথ।

সবমিলিয়ে নদীয়ার কৃষ্ণনগর, নবদ্বীপের পাশে ইতিহাসের দিক থেকে রানাঘাট বৃহত্তর ঐতিহাসিক তাৎপর্যের দাবিদার। রথযাত্রা, ডাকাতে কালী, চুর্ণী নদীর ধার এসবই মিলে মিশে ফুলে ফলে মফস্বলের গন্ধে ভরিয়ে তুলেছে রানাঘাটের আকাশ-বাতাস। কলকাতা থেকে মাত্র চুয়াত্তর কিলোমিটার দূরেই যেন এক ইতিহাসের আখড়া রানাঘাট।

2 comments

আপনার মতামত জানান