পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত হুগলি জেলার শ্রীরামপুর সাবডিভিশনের একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ ইতিহাস বিজড়িত জনপদ হল রিষড়া (Rishra) । এই জনপদের অধিকাংশ অঞ্চলই কলকাতা মেট্রোপলিটান ডেভেলপমেন্ট অথরিটির অন্তর্গত।
ভৌগোলিক অবস্থানের বিচারে ২২.৭১০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.৩৫০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত এই রিষড়া জনপদটি। হুগলি নদীর পাড়ে অবস্থিত রিষড়ার উত্তরে শ্রীরামপুর, দক্ষিণে কোন্নগর, পশ্চিমে দিল্লি হাইওয়ে এবং পূর্ব হুগলি নদী। প্রশাসনিকভাবে পূর্ব রিষড়া এবং পশ্চিম রিষড়া এই দুই ভাগে বিভক্ত সমগ্র জনপদটি। রিষড়া রেলওয়ে স্টেশনের পূর্ব দিকে রয়েছে পূর্ব রিষড়া এবং পশ্চিম দিকে রয়েছে পশ্চিম রিষড়া। পশ্চিম রিষড়া আবার মোরপুকুর নামেও পরিচিত।

প্রাক ঔপনিবেশিক যুগে রিষড়ার উৎপত্তি ঘটে বলে জানা যায়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে বিপ্রদাস পিপলাইয়ের লেখা ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে প্রথমবার রিষড়া জনপদটির উল্লেখ পাওয়া যায়। বাণিজ্যতরীতে করে ভাগীরথী নদীর বুকে চাঁদ সদাগর যখন যাচ্ছিলেন, সেই সময়কার বর্ণনা কবি বিপ্রদাস পিপলাই দিচ্ছেন এইভাবে-
‘রিষিড়া ডাইনে বাহে বামে সুখচর
পশ্চিমে হরিষে রাজা বাহে কোননগর।’
পরবর্তীকালে এই জনপদের নামের নানারকম বানান খেয়াল করা যায়। কোথাও কোথাও ইষিরা, কোথাও আবার রিষিড়া বা ইছারা বা কোথাও ইচ্রা হিসেবেও এই জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়। ফরাসি পর্যটক ভার্নিয়েরের ভ্রমণ বৃত্তান্তে বলা হয় এই রিষড়া জনপদটি কলকাতা থেকে আট মাইল দূরে অবস্থিত। সেন বংশের রাজত্বকালে ভাগীরথী নদীর তীরে ঠিক এই জায়গাতেই ঋষি কিংবা ব্রাহ্মণদের সমাবেশ ঘটেছিল। সেই অনুষঙ্গ থেকেই এই জনপদের নাম ‘রিষড়া’ হয়েছে বলে অনেকে মনে করে থাকেন। ফলে ঋষি বা সন্ত থেকেই ‘রিষড়া’ শব্দের উৎপত্তি বলে অনেকের ধারণা।
মুঘল আমলে রিষড়া জনপদটি এবং তার চারপাশের আরও অন্যান্য ছোটো ছোটো জনপদগুলিতে প্রবলভাবে জনসমাগম গড়ে ওঠে। এইসব অঞ্চলের উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়া এখানে বস্ত্রশিল্পের বিকাশ ঘটতে সাহায্য করে। এছাড়া এই অঞ্চল রেশম বয়নের জন্য বেশ বিখ্যাত ছিল। এখানে হিন্দু তাঁতিরা মিহি সুতোর কাপড় তৈরি করতেন এবং মুসলিম তাঁতিরা মূলত রেশম বস্ত্রবয়নেই বিখ্যাত ছিলেন। এখানকার উর্বর মাটিতে ধান, পাট, পান ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হত। প্রাচীনকালে কৈবর্ত সম্প্রদায়ের মানুষেরা এখানকার জলাভূমিগুলিতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে এই অঞ্চল মূলত ওলন্দাজদের দখলে ছিল। কিন্তু পরে ব্রিটিশরা যখন শ্রীরামপুরের দখল নিল, সেই সময় থেকেই রিষড়াকে একটি পৃথক জনপদ হিসেবে গড়ে তোলা হয় এবং একে শ্রীরামপুর মিউনিসিপ্যালিটির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই সময় গঙ্গার দিক থেকে শুরু করে বর্তমান রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত প্রায় ৫৭০ বিঘা জমির মধ্যে ১৯৬ বিঘা জমিতে পাটের চাষ হত। মাহেশের সীমানা থেকে শুরু করে বর্তমান বিধানচন্দ্র কলেজ পর্যন্ত সমগ্র এলাকাটি আগে ‘রিষড়া বাগান’ নামে পরিচিত ছিল। এখানেই প্রায় ৬০ বিঘা জমি নিয়ে গড়ে ওঠে ভারতের প্রথম পাটকল। ১৮৫০ সালে স্থাপিত এই পাটকলের নাম ছিল ‘ওয়েলিংটন জুট মিল’। ১৭৮০ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস সাহেব এই ওয়েলিংটন জুটমিল ব্যতিরেকে সমগ্র অঞ্চলের অবশিষ্ট জমির মধ্যে ১৩৬ বিঘা জমি কিনে নেন। ক্রমশ এই পাটকলে কাজ করতে আসা শ্রমিকেরা ধীরে ধীরে এই অঞ্চলেই তাদের থাকার জায়গা গড়ে তুলতে শুরু করে এবং সেই থেকেই এই সমগ্র অঞ্চল জুড়ে শুধুমাত্র ওয়েলিংটন জুটমিলকে কেন্দ্র করে অসংখ্য আবাসস্থল গড়ে ওঠে।
বর্তমানে যেখানে রিষড়া মিউনিসিপ্যালিটি অফিস রয়েছে সেই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল চারুচন্দ্রনগর। এখানকার বিস্তীর্ণ জমির মালিকানা ছিল ডা. চারুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নামে। এখানকার উর্বর চাষজমিতেই বর্তমানে গড়ে উঠেছে প্রেসিডেন্সি জুটমিল, ফসফেট কোং লিমিটেড, জয়শ্রী টেক্সটাইলস কুসুম প্রোডাক্টস লিমিটেড, জে. কে. লিমিটেড ইত্যাদি কোম্পানিগুলি। রিষড়া আর কোন্নগরের সন্ধিস্থলে অবস্থিত বাগের খাল প্রাচীনকালে আলিনগর মৌজা নামে পরিচিত ছিল। হেস্টিংস হাউজের উত্তর দিকেও একটি খাল কাটা হয় যার নাম চম্পা খাল। ১৮৯০ সালে গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডের পূর্ব দিকে সমগ্র জনপদের বর্জ্য জল নিকাশির সুবিধার্থে ‘রাইল্যাণ্ড চ্যানেল’ নামে আরেকটি খাল খনন করা হয়। ১৮৭৫ সালে এখানে হেস্টিংস জুটমিল প্রথম কাজ করা শুরু করে অ্যাডাম ব্রিকমায়ার এবং আর্কি ব্রিকমায়ারের যৌথ উদ্যোগে। ল্যাঙ্কাশায়ারের মতো এখানেও ছিল ৪০ ফুট লম্বা ইঁটের চিমনি। প্রায় হাজার তিনেক কর্মী কাজ করতো এই পাটকলে। ১৯৪৪ সালের ১৫ এপ্রিল এই হেস্টিংস জুটমিলেই ইন্দো-বার্মার কেন্দ্রীয় বায়ুবাহিনীর অফিস গড়ে ওঠে। প্রথম পাটকল থেকে শুরু করে গঙ্গার তীর ধরে একের পর এক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছিল এই রিষড়াতেই। বাংলার বিপ্লবী আন্দোলন শুরু হলে এই রিষড়াতেই ননীবালা দেবী তাঁর বাড়িতে বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতেন বলে জানা যায়। ইতিহাসবিদরা মনে করেন রিষড়াতেই প্রথম বিশ্বম্ভর সেন নামে এক বাঙালি কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে রিষড়ায় ‘বিশু সেনের ঘাট’ নামে একটি ঘাটও রয়েছে। এই জনপদের মাটিতে আগে নীলচাষও হতো এবং মদ তৈরির কারখানাও দিনেমারদের আমলে গড়ে উঠেছিল রিষড়ায়। মিস্টার প্রিন্সেপের ফ্যাক্টরিতে নানা রকমের ছাপা কাপড় তৈরি হত।
১৮৭৫ সালে হেস্টিংসের বাগান বাড়িতেই গড়ে ওঠে হেস্টিংস জুটমিল। তার আগে এই বাড়ির নাম ছিল রিষড়া হাউস। ঐতিহাসিকদের মতে, এই বাড়িতেই ওয়ারেন হেস্টিংসের দ্বিতীয় স্ত্রী মাদাম গ্র্যাণ্ড নিজে হাতে আম গাছ পুঁতেছিলেন। ১৭৭৪ সালে এই রিষড়া হাউজের নিলাম হওয়ার সংবাদও ছাপা হয়েছিল ‘কলকাতা গেজেট’ পত্রিকার পাতায়। তাছাড়া রিষড়ার মোড়পুকুরে শোনা যায় গোস্বামী বৈষ্ণবদের একটি বাগান ছিল ‘সাধন কানন’ নামে। পরে কেশবচন্দ্র সেন ১৮৭৬ সালে এই জায়গাটি কিনে নেন এবং প্রায়ই তিনি এখানে সাধনা করতে আসতেন বলে শোনা যায়।
রিষড়ার বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় ডা. শৈলধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা যিনি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজে অন্যতম সহকর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। লালকেল্লায় যুদ্ধবন্দী ভারতীয়দের বিচারের সময় তিনিও অন্যতম একজন যুদ্ধবন্দী ছিলেন। এছাড়াও ১৮৬২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.ডি পরীক্ষায় প্রথম স্থানাধিকারী ডা. চন্দ্রকুমার দে এই রিষড়ারই মানুষ ছিলেন। গোপাল উড়ের শিষ্য কবিয়াল কৈলাস বাড়ুইয়ের জন্মস্থান এখানে। এছাড়া ১৮৮৫ সালে প্রথম প্রকাশিত ‘ভারতবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক হরিদাস গড়গড়ি রিষড়াতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
রিষড়ার গড় সাক্ষরতার হার ৭৪ শতাংশ। ১৮২৮ সালে মিসেস মার্শম্যান এখানে দুটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন বলে জানা যায় যার মধ্যে প্রথমটি হল ডানকানি লাইন স্কুল এবং পরেরটি হল স্টার্লিং স্কুল। এখানকার রিষড়া প্রাথমিক বালক বিদ্যালয় সবথেকে প্রাচীন স্কুলগুলির মধ্যে অন্যতম। ১৯৩১ সালে প্রমথনাথ দাঁ ও হরিনাথ দাঁ তাঁদের পিতা স্বর্গীয় হেমচন্দ্র দাঁ’র স্মৃতিতে নির্মাণ করেছিলেন রিষড়া উচ্চ বিদ্যালয়। এই স্কুলটি এই জনপদের মধ্যে সবথেকে প্রাচীন উচ্চ বিদ্যালয়। এছাড়া অন্যান্য স্কুলগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রিষড়া বাণী ভারতী, সেন্ট মেরিজ স্কুল, গসপেল হোম স্কুল, রাধিকা টাউন হাই স্কুল, লরেটো হাই স্কুল, সেন্ট থমাস অ্যাকাডেমি, রিষড়া অঞ্জুমান হাই স্কুল, রিষড়া বিদ্যাপীঠ হিন্দি হাই স্কুল, রিষড়া ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র হাই স্কুল, শৈবলিনী দেবী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, বামুনারী হাই স্কুল ইত্যাদি। রিষড়ায় একটি মাত্র কলেজ রয়েছে যার নাম বিধানচন্দ্র কলেজ। স্কুলগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শিক্ষা পর্ষদের অধীনস্থ স্কুলের সংখ্যা বেশি হলেও সিবিএসই এবং আইসিএসই স্কুলগুলিও রয়েছে এখানে।
প্রাচীন শিল্পনগরী হওয়ার সুবাদে এখানে বিভিন্ন জাত ও ধর্মের মানুষের আনাগোনা ছিল প্রাচীনকাল থেকেই। তবুও হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যাই এখানে বেশি। দুর্গাপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, কালীপূজা, ছটপূজা, মহরম ইত্যাদি প্রায় সব অনুষ্ঠানই খুব ধুমধাম করে এখানে পালিত হয়। তবে নভেম্বর মাসে জগদ্ধাত্রী পূজাই এখানকার সবথেকে বড় উৎসব বলে পরিগণিত হয়। গুপ্তিপাড়া, চন্দননগর থেকে বহু মানুষ এখানে পুজো দেখতে আসেন। চন্দননগরে যেদিন নবমী পালিত হয়, সেদিন রিষড়ার জগদ্ধাত্রী পুজোয় পালিত হয় ষষ্ঠী। তাছাড়া জগন্নাথদেবের রথযাত্রা এবং স্নানযাত্রাকে উপলক্ষ করেও এখানে বহু জনসমাগম হয়ে থাকে। পার্শ্ববর্তী মাহেশের স্নানযাত্রার জনপ্রিয়তার উল্লেখ প্রাচীন ‘সমাচারদর্পণ’ পত্রিকার পাতাতেও পাওয়া যায়। আগে ব্রহ্মা পূজাও হতো রিষড়াতে, তবে বর্তমানে এই রীতি অবলুপ্ত।
প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে এখানে বড় করে রিষড়া মেলা বসে। নানা জাতির, নানা ধর্ম ও নানা ভাষার মানুষ এই মেলাকে কেন্দ্র করে একত্রিত হয়। এখানে বাঙালিদের পাশাপাশি ওড়িয়া, বিহারি, মারোয়াড়ি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষের সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়।
রিষড়ায় অবস্থিত দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম হল হেস্টিংসের বাগানবাড়ি। এছাড়াও সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, মোড়পুকুর, শ্যামনগরের হাট ইত্যাদি অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থানের মধ্যেই পড়ে।
রিষড়ার কথা উঠল আর ফেলু মোদকের মিষ্টির দোকানের কথা উঠবে না তা কখনো হয় নাকি! দেড় শতাধিক বছরের প্রাচীন এই মিষ্টির দোকান পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যশালী বিখ্যাত দোকানগুলির মধ্যে অন্যতম। এই দোকানের রাবড়ির খ্যাতি সারা বাংলা জুড়ে রয়েছে।