রুডলফ ডিজেল

রুডলফ ডিজেল

রুডলফ ডিজেল (Rudolf Diesel) ছিলেন উনিশ শতকের শেষভাগ এবং বিশ শতকের প্রথমার্ধের সম্ভবত সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবক এবং প্রযুক্তিবিদ। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন ডিজেল ইঞ্জিনের আবিষ্কারক হিসেবে। ঠেলাগাড়িতে করে বাবার তৈরি চামড়ার বা কাঠের জিনিসপত্র বিক্রি করে জীবন শুরু করা ছোট্ট ছেলেটি পরবর্তীকালে প্রযুক্তির দুনিয়ায় তাঁর উদ্ভাবনের জোরে প্রভূত অর্থ উপার্জন করার পরেও মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে কোনও কর্মশালার বা ফ্যাক্টরির মালিকানা সব সময় থাকা উচিত তার কর্মচারীদের হাতে। খ্যাতির শিখরে পৌঁছেও এই গভীর বিশ্বাস কোনওদিন ছেড়ে যায়নি তাঁকে। আর তাই রুডলফ ডিজেলের মৃত্যু নিয়ে রহস্য থাকলেও তাঁর জীবনদর্শন নিয়ে কারুর মনে কোনও রহস্য ছিলনা। সময়ের থেকে বহুযুগ এগিয়ে থাকা কাজপাগল এক বিজ্ঞানী, যার গোটা জীবনটাই কেটে গেছিল আমাদের জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সহজ, সরল সমাধানের উদ্দেশ্যে।   

১৮৫৮ সালের ১৮ মার্চ ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে রুডলফ ডিজেলের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম থিওডোর ডিজেল এবং মায়ের নাম এলিস ডিজেল। দক্ষিণ-পূর্ব জার্মানির ব্যাভারিয়াতে বসবাসকালে দপ্তরির বা বই বাঁধাইয়ের কাজ করলেও প্যারিসে আসার পর ১৮৫৫ সালে এলিস স্ট্রবলের সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়ে থিওডোর পেশা পরিবর্তন করে হয়ে ওঠেন একজন চর্মশিল্পী। রুডলফ ছাড়াও তাঁদের আরও দুই কন্যা সন্তান ছিল। ১৮৮৩ সালে রুডলফ বিবাহ করেন প্যারিস নিবাসী এক জার্মান ব্যবসায়ীর কন্যা মার্থা ফ্ল্যাশকে। এই প্যারিসে থাকাকালীন পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে তাঁদের তিন সন্তানের জন্ম হয় রুডলফ জুনিয়র, হেডি এবং ইউজিন।  

জন্মের অব্যবহিত পরেই রুডলফকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভিন্সেন্সে একটি কৃষক পরিবারের কাছে। জীবনের প্রথম ন’টি মাস তাঁদের সাথে কাটিয়ে রুডলফ ফিরে আসেন প্যারিসে তাঁর পরিবারের কাছে। এই সময়ে রুডলফকে শুধু যে বাবার কর্মশালায় সাহায্য করতে হত তাই নয়, ঠ্যালাগাড়িতে করে সেইসব পন্য বিক্রি করতেও বেরোতে হত। সেই সময় একটি প্রটেস্টান্ট স্কুলে পড়াশুনো করার সুযোগ পান রুডলফ আর সেখানেই প্রথম তিনি আকৃষ্ট হন প্রযুক্তিবিদ্যার প্রতি। শিক্ষাক্ষেত্রে অসাধারণ মেধার পরিচয় রেখে ১২ বছর বয়সে রুডলফ পেয়ে যান সোসাইটি ফর এলিমেন্টারি এডুকেশনের তরফ থেকে ব্রোঞ্জ পদক। প্রথাগত পড়াশুনোর ক্ষেত্রে এটাই তাঁর প্রথম স্বীকৃতি। নতুন স্বপ্নে বুক বেঁধে যে সময়ে রুডলফ হায়ার প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশুনো আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ঠিক সেই সময়ে ১৮৭০ সালে ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। রাতারাতি ডিজেল পরিবারকে প্যারিস ছেড়ে সংসার পাততে হয় লন্ডনে। সেখানে কিছুদিন একটি ইংলিশ স্কুলে পড়াশুনোর পরে রুডলফের মা তাঁকে পাঠিয়ে দেন তাঁদের আদি বাসস্থান জার্মানির অগসবারগে তাঁর পিসির বাড়িতে। তাঁর পিসেমশাই অগসবারগের রয়্যাল কাউন্টি ভোকেশনাল কলেজে অংকের অধ্যাপক ছিলেন। ১২ বছর বয়সী রুডলফ জার্মান ভাষা শেখার জন্য ভর্তি হন সেই কলেজে। মৌলিক শিক্ষার পর ১৮৭৩ সালে রুডলফ ভর্তি হন অগসবারগে নবনির্মিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুলে, কারণ ততদিনে তিনি বুঝে গেছেন তাঁর পছন্দের বিষয়টি হল প্রযুক্তিবিদ্যা। এর দু’বছরের মাথায় যখন তাঁর বাবা মা চাইছিলেন রুডলফ ফিরে এসে তাঁর কর্মজীবন শুরু করুক তিনি মিউনিখের রয়্যাল ব্যাভারিয়ান পলিটেকনিকে পড়ার জন্য একটি সাম্মানিক বৃত্তি অর্জন করেন। এই প্রতিষ্ঠানে পাঠ শুরু করার পর টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রথম সুযোগে স্নাতক পরীক্ষায় বসতে পারেননি তিনি। দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় বসার আগের সময়টুকুকে তিনি ব্যবহার করেন সুইজারল্যান্ডের সালজার ব্রাদার্স মেশিন ওয়ার্কসে শিক্ষানবিশি করে। হাতেকলমে কারিগরি শিক্ষার প্রথম অভিজ্ঞতা তাঁর হয় এখানেই। ১৮৮০ সালের জানুয়ারিতে তিনি বসেন স্নাতকস্তরের পরীক্ষায় এবং প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে সর্বোচ্চ্ নম্বর পেয়ে, প্রথম স্থান অধিকার করে ফিরে আসেন প্যারিসে তাঁর পরিবারের কাছে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

বিশিষ্ট জার্মান উদ্ভাবক, প্রযুক্তিবিদ ও শিল্পপতি কার্ল ভন লিন্ডের নাম সেই সময় রেফ্রিজারেশন সাইকেল নিয়ে তাঁর যুগান্তকারী কাজের জন্য গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। এই প্রবাদপ্রতিম প্রযুক্তিবিদ ছিলেন মিউনিখের রয়্যাল ব্যাভারিয়ান পলিটেকনিকে রুডলফের শিক্ষক। থার্মোডায়নামিক্স নিয়ে প্রফেসর লিন্ডের তত্ত্ব প্রভাবিত করেছিল তাঁকে। প্যারিসে ফিরে এসে কার্ল ভন লিন্ডের সংস্থাতেই যোগ দেন তিনি আধুনিক রেফ্রিজারেশন ও আইসপ্লান্টের নকশা তৈরির কাজে তাঁর শ্রদ্ধেয় অধ্যাপককে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। এই সংস্থার সাথে রুডলফ পরবর্তী বেশ কিছু বছর যুক্ত থাকেন, উন্নীত হন ডিরেক্টরের পদে এবং তাঁর গবেষণালব্ধ কাজের জন্য অর্জন করেন বেশ কিছু পেটেন্ট। ১৮৯০ সালে তিনি সপরিবারে চলে আসেন বার্লিনে, লিন্ডের সংস্থার গবেষণা ও বিশ্লেষণ বিভাগের দায়িত্ত্ব নিয়ে। কিছুদিন পরে তিনি জানতে পারেন পূর্ববর্তী কয়েক বছরের গবেষণালব্ধ পেটেন্টগুলি তিনি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতে পারবেননা, যেহেতু সেগুলি লিন্ডের সংস্থার ছত্রছায়ায় তৈরি হয়েছিল।

খুব সহজে হার মানার মানুষ ছিলেননা রুডলফ ডিজেল। নিজের গবেষণার ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করেন রেফ্রিজারেশন সিস্টেম সংক্রান্ত কাজের বাইরে। অ্যামোনিয়া বাষ্পচালিত ইঞ্জিন তৈরি করার উদ্দেশ্যে তিনি থার্মাল এফিসিয়েন্সি ও ফুয়েল এফিসিয়েন্সি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৮৯৩ সাল থেকে তিনি এই বিষয়ে কাজ আরম্ভ করেন এবং পরবর্তী কয়েক বছরের গবেষণার মূল উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে এই নতুন ইঞ্জিনের পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত করা। এই উদ্যোগের মধ্যে ক্রমান্বয়ে আসতে থাকে বাধা। পরীক্ষা করার সময় যান্ত্রিক গোলযোগে ইঞ্জিন ফেটে গিয়ে প্রচণ্ড আঘাত পান রুডলফ, যার ফলে দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হয় তাঁকে। এই দুর্ঘটনার প্রভাব তাঁর শরীরের ও দৃষ্টিশক্তির উপর থেকে যায় জীবনের শেষ দিন অব্ধি। অবশেষে ১৮৯৭ সাল নাগাদ তিনি তাঁর গবেষণার ফলে খুশী হন এবং একটি নিরপেক্ষ পরীক্ষার ফলে ইঞ্জিনের থার্মাল এফিসিয়েন্সি’র মাত্রা সন্তোষজনক বলে প্রমাণিত হয়।

কার্ল ভন লিন্ডের থেকে পাওয়া শিক্ষার উপর ভিত্তি করে শুরু করা এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল কারনট সাইকেলের দ্বারা নির্ধারিত সর্বাধিক থার্মাল এফিসিয়েন্সি’র লক্ষ্যে পৌছনো। এত বছরের অমানুষিক পরিশ্রম এবার তাঁর শরীরের ওপর থাবা বসাচ্ছিল। অনিদ্রা, অত্যধিক মাথা ব্যথার মতো রোগ তাঁকে উত্তরোত্তর ঠেলে দিচ্ছিল দীর্ঘস্থায়ী অবসাদের দিকে। মাঝেমাঝেই তাঁকে স্যানাটোরিয়ামে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করিয়ে আসতে হচ্ছিলো। কিন্তু তাঁর তৈরি করা সেই প্রথম সফল ডিজেল ইঞ্জিন মোটর ২৫০/৪০০ আজও গেলে দেখতে পাওয়া যাবে মিউনিখের জার্মান টেকনিক্যাল মিউজিয়ামে। ১৮৯৮ সাল নাগাদ তাঁর মনে হয় এই যন্ত্রটি এখন বানিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত। গোটা দুনিয়ার থেকে লগ্নিকারিরা আগ্রহ দেখান। কিন্তু কিছু অনিবার্য যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে প্রচুর বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। প্রবল মানসিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েন রুডলফ ডিজেল। ১৮৯০ এর দশকে যে মানুষটাকে খ্যাতি ও আর্থিক প্রতিপত্তির শিখরে উঠতে দেখেছে পৃথিবীর মানুষ, দশক শেষ হতে না হতেই একটা বড় প্রশ্নচিহ্নের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ডিজেল ইঞ্জিনের সুবিধা ছিল পেট্রোলচালিত ইঞ্জিনের থেকে বেশী থার্মাল এফিসিয়েন্সি, যার ফলে আরও বেশী পরিমানে তাপশক্তি, যান্ত্রিক শক্তিতে পরিবর্তিত হতে পারে। বেশী থার্মাল এফিসিয়েন্সি এবং তুলনামুলকভাবে সহজ ডিজাইন ডিজেল ইঞ্জিন কে রাতারাতি বিখ্যাত করে তোলে। ১৯১২ সাল নাগাদ দেখা যায় প্রায় ৭০,০০০ ডিজেল ইঞ্জিন গোটা পৃথিবীজুড়ে ফ্যাক্টরি আর জেনারেটরের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। দেখা যায় রেলপথের পরিবহনের প্রযুক্তিতে বিপ্লব এনে দিয়েছে ডিজেল ইঞ্জিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দেখা যায় কম খরচে বেশী ওজন বয়ে নেওয়ার জন্য ট্রাক ও বাসেও ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হচ্ছে। সাধারণ পরিবহন ব্যবস্থাতেও তাঁর ইঞ্জিনের সাফল্য নিজের জীবিতাবস্থায় দেখে যাওয়া হয়নি এই কালজয়ী প্রযুক্তিবিদের।বহুযুগ পরে ১৯৭৮ সালে অটোমোবাইল হল অফ ফেম-এ রুডলফ ডিজেলের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়।

ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহারের সম্পূর্ণ স্বত্ব তাঁর কাছে চেয়েছিল জার্মান নৌসেনা, যা তিনি দিতে রাজি হননি। এর পরেই তিনি পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে, যেখানে বেশ কিছু মিটিং করার কথা ছিল তাঁর, যার মধ্যে একটি হওয়ার কথা ছিল ব্রিটিশ নৌসেনার সাথে।

১৯১৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ারপ থেকে ইংল্যান্ডের হারউইচ যাওয়ার উদ্দেশ্যে ড্রেসডেন জাহাজে চড়েন তিনি। রাতে শুতে যাওয়ার আগে জাহাজের পরিচারককে বলেন পরের দিন ভোর ৬-১৫ এ তাঁকে তুলে দিতে। কিন্তু পরের দিন সকালে আর তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। জামাকাপড় পরিপাটি করে রাখা ছিল। ১০ দিন পরে একটি ডাচ জাহাজের নজরে আসে এই ভাসমান মরদেহ। তাঁর পকেটের মধ্যে থেকে পাওয়া আই ডি কার্ড, চশমা এবং পকেট নাইফ দেখে তাঁকে শনাক্ত করেন তাঁর পুত্র ইউজিন। তাঁর শরীর ভাসিয়ে দেওয়া হয় সাগরের জলে। হত্যা? না আত্মহত্যা? সেই রহস্যের কিনারা আজও হয়নি।

১৯৫০ সালের মাঝামাঝি সময়ে জাপানের ডিজেল ইঞ্জিন প্রস্তুতকারক সংস্থা ইয়ামানারের প্রতিষ্ঠাতা মাগোচিচি ইয়ামোকা পশ্চিম জার্মানি সফরকালীন সময়ে জানতে পারেন যে জার্মানিতে রুডলফ ডিজেলের কোন সমাধি বা স্মৃতিস্তম্ভ নেই। ইয়ামোকা ও তাঁর সংস্থা ঠিক করেন তখন ডিজেলকে তাঁরাই সম্মান জানাবেন। ১৯৫৭ সালে বাভারিয়ার অগসবার্গের উইটসেলব্যাকার পার্কে ডিজেলের জন্মশতবার্ষিকী এবং ডিজেল ইঞ্জিন আবিষ্কারের ৬০তম বার্ষিকী উপলক্ষে ইয়ামোকা রুডলফ ডিজেল মেমোরিয়াল গার্ডেনটি তৈরি করে দেন।

আপনার মতামত জানান