স্যাম মানেকশ

স্যাম মানেকশ

১৯৭১ সালের ইন্দো-পাক যুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘চিফ অফ দ্য আর্মি স্টাফ’ পদে আসীন ছিলেন স্যাম মানেকশ (Sam Manekshaw)। তিনিই ছিলেন ভারতের প্রথম সেনা যিনি ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত হয়েছিলেন। দীর্ঘ চার দশকের সেনাজীবনে মোট পাঁচটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। তখনও পর্যন্ত যে ভারতীয় সেনাবাহিনী এই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না, সে কথা তিনিই প্রথম তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে জানিয়েছিলেন। পাক সেনার সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে সাতটা গুলি খেয়েও অকুতোভয় স্যাম লড়াইয়ের ময়দানে অবিচল থেকেছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের কাছে তিনি ‘স্যাম বাহাদুর’ নামেই পরিচিত ছিলেন। ভারত সরকার তাঁর বীরত্ব ও সাহসের স্বীকৃতি স্বরূপ স্যাম মানেকশকে পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত করেন।

১৯১৪ সালের ৩ এপ্রিল পাঞ্জাবের অমৃতসরে স্যাম মানেকশর জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম ছিল স্যাম হোরমুশজী ফ্রামজি জামশেদজী মানেকশ। তাঁর বাবা হোরমিজ্‌দ মানেকশ একজন ডাক্তার ছিলেন এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল হিলা নি মেহেতা। তাঁরা দুজনেই গুজরাটের ভালভাদ শহর থেকে অমৃতসরে চলে আসেন। মুম্বাইয়ের থেকে লাহোরে যাওয়ার কথা ছিল তাঁদের। কিন্তু মাঝপথে অমৃতসরে এসে গর্ভবতী হিলা নি মেহেতার প্রসবযন্ত্রণা উঠলে বাধ্য হয়ে অমৃতসরেই নেমে যেতে হয় তাঁদের। সেখানে একটি ডাক্তারখানা গড়ে তোলেন স্যামের বাবা হোরমিজ্‌দ। তাঁদের চার পুত্র এবং দুই কন্যা সন্তান ছিল। স্যাম মানেকশ ছিলেন তাঁদের পঞ্চম সন্তান এবং তৃতীয় পুত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাঁর বাবা ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ভারতীয় মেডিক্যাল অফিসারের পদে কর্মরত ছিলেন। তাঁর দুই দাদা ফালি এবং জ্যান প্রকৌশলী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন এবং ভাই জামি তাঁরই মতো ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ছোটবেলায় তাঁর ইচ্ছা ছিল বাবার মতো ডাক্তার হওয়ার। পরবর্তীকালে ১৯৩৯ সালের ২২ এপ্রিল সিল্লু বোডের সঙ্গে বিবাহ হয় স্যাম মানেকশর। তাঁদের দুই কন্যা সন্তান রয়েছে।   

পাঞ্জাবের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু হয় স্যামের। তারপর তিনি ভর্তি হন নৈনিতালের শেরউড কলেজে। ১৯২৯ সালে ১৫ বছর বয়সে জুনিয়র কেমব্রিজ শংসাপত্র নিয়ে কলেজ ত্যাগ করেন তিনি। ১৯৩১ সালে ডিস্টিংশন সহ সিনিয়র কেমব্রিজ পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হন তিনি। ঠিক এই সময় মানেকশ লণ্ডনে গিয়ে ডাক্তারি পড়তে চাইলেও তাঁর বাবা সেই সময় তাতে সায় দেননি। ফলে অমৃতসরের হিন্দু মহাসভা কলেজে ভর্তি হন স্যাম। ১৯৩২ সালের এপ্রিল মাসে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত চূড়ান্ত পরীক্ষায় বিজ্ঞানে তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন তিনি। সেই সময় ইণ্ডিয়ান মিলিটারি কলেজ কমিটির পক্ষ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য তিন বছরের একটি কোর্স চালু হয়েছিল এবং ১৯৩২ সালের ১ অক্টোবর সেই কোর্সের প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম ১৫ জন প্রার্থীর মধ্যে তিনি ৬ষ্ঠ স্থান অধিকার করেন। তাঁর বাবা ডাক্তারি পড়তে লণ্ডনে যেতে না দেওয়ায় এই সেনাবাহিনীতে যোগদানের মধ্য দিয়ে তিনি প্রতিবাদ জানান। ইণ্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে তাঁরাই ছিলেন প্রথম ব্যাচ যাঁদের বলা হত ‘দ্য পাইওনিয়ার্স’। তাঁদের সঙ্গে কোর্স শুরু করা ৪০ জনের মধ্যে মাত্র ২২ জনই এই কোর্সটি সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলেন। স্যাম মানেকশ ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি স্নাতক উত্তীর্ণ হওয়ার পরে গোর্খা রেজিমেন্টে যোগ দেন, ভারতের একমাত্র স্নাতক চিফ অফ দ্য আর্মি স্টাফ ছিলেন তিনি এবং একইসঙ্গে তিনিই একমাত্র ফিল্ড মার্শালের পদে উন্নীত হয়েছিলেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৩৪ সালের ২২ ডিসেম্বর তিনি ৪/১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টে নিযুক্ত হন মানেকশ। প্রথমে লাহোরে একটি ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে কাজ করতে পাঠানো হয় তাঁকে। ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মানেকশ আবার ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টে ফিরে আসেন। একাধারে হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, পাঞ্জাবি এবং গুজরাটি ভাষায় দক্ষ হওয়ার কারণে ১৯৩৮ সালে তিনি পশতু ভাষার হায়ার স্ট্যাণ্ডার্ড আর্মি ইন্টারপ্রিটার হিসেবে নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে তরুণ মানেকশ ব্রিটিশ বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করছিলেন। ১৯৪২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জাপানি সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় একবারে একাধিক গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতরভাবে আহত হন স্যাম মানেকশ। সাতটা গুলি লেগেছিল তাঁর। তাঁর অধীনস্থ শের সিং তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে সেই জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে যান। সৌভাগ্যক্রমে তিনি সেইবার সুস্থ হয়ে যান। দুঃসাহসী স্যাম ডাক্তারের অপারেশনের সময় বলেছিলেন, কয়েকটা ছুঁচো তাঁকে সামান্য আঘাত দিয়েছে মাত্র। এই সময় ডিভিশনাল কমাণ্ডার স্যার কাওয়ান্স স্যামের এই সাহসিকতার পরিচয় পেয়ে ছুটে আসেন সিতাং ব্রিজে আহত হয়ে পড়ে থাকা স্যামের কাছে। সেখানে পৌঁছে স্যার কাওয়ান্স নিজের মিলিটারি ক্রস খুলে তাঁর জামায় আটকে দেন এবং তাঁকে গ্যালান্ট্রি পদকে সম্মানিত করেন। ১৯৪৪ সালের ২২ অক্টোবর তারিখে রামজাক ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি এবং এই বছরই ৩০ অক্টোবর তারিখে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল পদে উন্নীত হন স্যাম। বিশ্বযুদ্ধে জাপান আত্মসমর্পণ করার পরে প্রায় ৬০ হাজার জাপানি যুদ্ধবন্দীদের সঠিকভাবে বন্দি করে রেখেছিলেন তিনি।

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে স্যাম মানেকশর নেতৃত্বে ৪র্থ ব্যাটেলিয়ন এবং ১২তম ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয়। তাই মানেকশকে আবার অষ্টম গোর্খা রাইফেলস-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৫৯ সালের ১ অক্টোবর তাঁকে ওয়েলিংটনের ডিফেন্স সার্ভিসেস স্টাফ কলেজের কমাণ্ড্যান্ট পদে নিযুক্ত করা হয়। ইতিমধ্যে মেজর জেনারেল ব্রিজমোহন কল লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে আসীন হলে মানেকশ বুঝতে পারেন যে নেহেরু বা কে. কে. মেননের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে এবং ভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার এই গোপন আঁতাতকে ভাল চোখে দেখেননি মানেকশ। এর বিরুদ্ধে মুখ খুললে তাঁকে দেশদ্রোহী আখ্যা পেতে হয়। ঠিক এই সময়েই তাঁর সেনাজীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ বদল আসে এবং আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর পদোন্নতি আটকে যায়, জনমানসে তাঁর চরিত্রের অবনমন ঘটে। ১৯৬৯ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অষ্টম চিফ অফ দ্য স্টাফ পদে নিযুক্ত হন স্যাম। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে তেরো দিন ধরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী। তিনিই প্রথম তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে জানিয়েছিলেন যে তখনও ভারতীয় সেনাবাহিনী এই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না। মাত্র বারোটি ট্যাঙ্ক এই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বারবার ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে জোর করলে স্যাম মানেকশ ইস্তফা দিতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ইস্তফাপত্র স্বীকার না করে তাঁকে নিজের মতো করে পরিকল্পনা করে যুদ্ধযাত্রা করতে নির্দেশ দেন ইন্দিরা গান্ধী। সেই মতো স্থানীয় সশস্ত্র মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে একজোট হয়ে স্যাম ও ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধ ঘোষণা করে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধে প্রায় ৭৫ হাজার গেরিলা আক্রমণকারী পাকিস্তানি সেনাদের পর্যুদস্ত করেছিল। এছাড়া স্যাম মানেকশর তত্ত্বাবধানে সাধারণ বাংলাদেশি বাহিনীকেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। প্রায় বারো দিন ধরে চলা যুদ্ধে ৮৪ হাজার পাকিস্তানি সেনাকে কারাবন্দি করা হয়েছিল। এর ফলে অবশেষে পূর্ব পাকিস্তান ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানের প্রায় ৬০০০ সৈন্য ও অন্যান্য মানুষ মারা যায় এবং ভারতের হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রায় হাজার দুয়েক।

১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সৌজন্যে স্যাম মানেকশ ভারতের প্রথম ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত সেনার মর্যাদা লাভ করেন। ১৯৭২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পদ্মবিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ১৯৭৭ সালে নেপালের রাজা বীরেন্দ্র সিং-এর কাছ থেকে ‘অর্ডার অফ ত্রিশক্তি পাট্টা’-র সম্মান লাভ করেন স্যাম। ২০০৭ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি স্যার এ.পি.জে আবদুল কালাম ওয়েলিংটনে মানেকশর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে তিরিশ বছরের কর্মময় সেনাজীবনের স্বীকৃতি স্বরূপ ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকার একটি চেক দান করেন।

প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর দিনটি ১৯৭১ সালের ইন্দো-পাক যুদ্ধে স্যাম মানেকশর অবদানকে স্মরণে রেখে পালিত হয় ‘বিজয় দিবস’। ২০০৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিলের অনুমোদনে ভারতের ডাকবিভাগ ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশর ছবি সম্বলিত একটি পোস্টাল স্ট্যাম্প প্রকাশ করে।

২০০৮ সালের ২৭ জুন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৯৪ বছর বয়সে স্যাম মানেকশর মৃত্যু হয়।

আপনার মতামত জানান