ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর মৃত্যু

ভীষ্মের শরশয্যা

মহাভারতের ভীষ্মপর্বের একেবারে শেষ ঘটনা হল ভীষ্মের শরশয্যা । কুরুপিতামহ ভীষ্ম ছিলেন ইচ্ছামৃত্যুর বরপ্রাপ্ত। তাই তাঁর ইচ্ছা না হলে কেউ তাঁকে মারতে পারবে না। ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি কোনো নারী বা আগে নারী ছিল এমন পুরুষের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না। এই প্রতিজ্ঞার সুযোগ নিয়ে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের ছেলে শিখণ্ডী, যুদ্ধের দশম দিনে ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেন। যেহেতু শিখণ্ডী আগে নারী ছিলেন, তাই ভীষ্ম তাঁর প্রহার সহ্য করতে থাকেন।

এইভাবে অর্জুন ও শিখণ্ডীর বাণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ আগে ভীষ্ম রথ থেকে পড়ে গেলেন। গোটা পৃথিবী কেঁপে উঠল। ‘হায় হায়’ বলে সব যোদ্ধারা ও আকাশের দেবতারাও কেঁদে উঠলেন। ভীষ্মের শরীরে এতো বাণ বিঁধেছিল যে রথ থেকে পড়ে গিয়েও তাঁর শরীর মাটি স্পর্শ করল না। রাশি রাশি বাণের বিছানা বা ‘শরশয্যা’য় ভীষ্ম শুয়ে রইলেন।
শরশয্যায় শুয়ে শুয়ে ভীষ্ম স্বর্গের কথা ভাবতে লাগলেন। তখন আকাশ থেকে দেবতারা বললেন, “হে মহাবীর! সূর্যদেব এখনো আকাশের দক্ষিণভাগে রয়েছেন। এই সময় কোনো মহাপুরুষের মৃত্যুর জন্য উপযুক্ত নয়। আপনি কি এমনসময় দেহত্যাগ করবেন?” এই কথা শুনে ভীষ্ম বললেন, “আমি তো এখনো প্রাণত্যাগ করিনি!”

সেই সময় আকাশ দিয়ে মানস সরোবরের দিকে একঝাঁক হাঁস উড়ে যাচ্ছিল। তারা ভীষ্মকে জিজ্ঞাসা করল, “এখন সূর্যদেবের দক্ষিণায়ন শেষ হয়নি। মহাত্মা ভীষ্ম কি এইসময়েই দেহত্যাগ করবেন?” হাঁসগুলিকে দেখে ভীষ্ম কিছু সময় চিন্তা করলেন। তারপর তিনি বুঝতে পারলেন সেগুলি সাধারণ হাঁস নয়, এঁরা তাঁর মা গঙ্গাদেবীর পাঠানো স্বর্গের ঋষিরা। ভীষ্ম তখন হাঁসগুলিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আমার বাবা আমাকে ইচ্ছামৃত্যুর বর দিয়েছিলেন। আমি সত্য বলছি, সূর্যদেব আকাশের উত্তরভাগে না যাওয়া পর্যন্ত আমি দেহত্যাগ করব না।”

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ভীষ্ম রথ থেকে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ থেমে গেল। পান্ডবদের দলে মহাশঙ্খ বেজে উঠল। ভীম রথের উপরেই আনন্দে নাচতে লাগলেন। আর কৌরবপক্ষের যোদ্ধারা ভীষণ দুঃখে ও ভয়ে কাঁদতে লাগলেন। দ্রোণ অজ্ঞান হয়ে রথ থেকে মাটিতে পড়ে গেলেন। তারপর সব যোদ্ধারা নিজেদের বর্ম ও অস্ত্র-শস্ত্র ত্যাগ করে, নতমুখে হাত জোড় করে ভীষ্মের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।
ভীষ্ম তাঁদের দেখে বললেন, “হে মহাবীরগণ! তোমাদের মঙ্গল তো? তোমাদের দেখে আমি খুব খুশি হলাম। দেখ, এভাবে শুয়ে আমার মাথা ঝুলে পড়ছে। আমাকে বালিশ দাও।”

ভীষ্মের কথা শুনে তখনই রাজারা রাশি রাশি কোমল ও মূল্যবান বালিশ নিয়ে ভীষ্মের কাছে এলেন। ভীষ্ম তা দেখে হেসে বললেন, “এরকম বালিশ এই বিছানার উপযুক্ত নয়। বাছা অর্জুন, আমাকে উপযুক্ত বালিশ দাও।”
অর্জুন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “দাদামশাই! কী করতে হবে আদেশ করুন।”

ভীষ্ম বললেন, “বাছা! তুমি ধনুর্বিদদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমান ও ক্ষত্রিয়ের ধর্মে দীক্ষিত। আমার মাথা ঝুলছে, উপযুক্ত বালিশ দাও।”
এই কথা শুনে অর্জুন ভীষ্মের পায়ের ধুলো নিয়ে গাণ্ডীব ধনুক তুলে নিলেন। তারপর তিনটি বাণ মেরে ভীষ্মের মাথা উঁচু করে দিলেন। তাতে ভীষ্ম খুব খুশি হয়ে অর্জুনকে আশির্বাদ করে সবাইকে বললেন, “এই দেখ! অর্জুন আমার উপযুক্ত বালিশ দিয়েছে।”
তারপর দুর্যোধন ভালো ভালো বৈদ্য, কবিরাজ ও প্রচুর ওষুধপত্র নিয়ে ভীষ্মের কাছে এলেন। কিন্তু চিকিৎসার সরঞ্জাম দেখে ভীষ্ম খুশি হলেন না। তিনি দুর্যোধনকে বললেন, “এসব ওষুধপত্র আমার কোনো কাজে লাগবে না। এখন আমার চিকিৎসার সময় নয়। আমাকে পোড়াবার সময়।” কাজেই বৈদ্য ও কবিরাজরা ফিরে গেলেন। তারপর রাত হলে সেই জায়গায় পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করে সবাই যে যার শিবিরে চলে গেলেন। পরের দিন ভোরবেলায় আবার সবাই ভীষ্মের কাছে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করলেন। আস্তে আস্তে সমস্ত স্ত্রী, পুরুষ, বালক ও বৃদ্ধরা ভীষ্মকে দেখবার জন্য সেখানে আসতে লাগলেন। মেয়েরা তাঁর উপর ফুলের মালা, চন্দনচূর্ণ ও খই ছড়াতে লাগল। গায়ক, নর্তক ও বাজনদারেরা সেখানে এসে উপস্থিত হল। রাজা ও রাজপুত্ররা বিনম্র ভাবে ভীষ্মের চারিদিকে ঘিরে রইলেন। তখন সেই স্থানের শোভা হল স্বর্গের মত! এমন সময় ভীষ্ম বললেন, “জল দাও।” এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাজারা ব্যস্ত হয়ে নানারকম সুস্বাদু মিষ্টান্ন ও ঠান্ডা জল নিয়ে এলেন। কিন্তু ভীষ্ম বললেন, “আমি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চলেছি। তাই এখানকার মানুষেরা যে খাবার ও জল খায় আমি তা খাব না। অর্জুন কোথায়?” অর্জুন কাছেই ছিলেন। ভীষ্মের ডাক শুনে তিনি সামনে এসে ভীষ্মকে প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন ডাকছেন দাদামশাই? কী করতে হবে আদেশ করুন!”
ভীষ্ম হাসিমুখে বললেন, “বাছা অর্জুন! তুমি আমাকে বিছানা দিয়েছ, বালিশও দিয়েছ। এবার এই সবকিছুর উপযুক্ত জল দাও!”
অর্জুন ভীষ্মের মনের ভাব বুঝতে পারলেন। তিনি আবার গাণ্ডীব তুলে নিয়ে তাতে ‘পর্জন্যাস্ত্র’ জুড়লেন। সেই অস্ত্র ভীষ্মের ডানদিকের মাটিতে ছুঁড়ে মারার সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে অতি পবিত্র নির্মল জল উঠে আসতে লাগল। ভীষ্ম আকণ্ঠ সেই ঠান্ডা মিষ্টি জল পান করলেন। তৃপ্ত হয়ে তিনি বারবার অর্জুনকে আশির্বাদ করে বললেন, “অর্জুন! তোমার সমান ধনুর্ধর এই পৃথিবীতে নেই। পান্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আমরা দুর্যোধনকে বারবার বারণ করেছিলাম। কিন্তু সে আমাদের কারোর কথা শুনলো না। এই যুদ্ধে কৌরবদের পরাজয় নিশ্চিত।”

দুর্যোধন তখন ভীষ্মের কাছেই ছিলেন। তিনি এইসব কথা শুনে ভীষণ দুঃখ পেলেন। তাঁকে দেখতে পেয়ে ভীষ্ম বললেন, “বাছা দুর্যোধন! তুমি তো দেখলে অর্জুন আজ কী আশ্চর্য কাণ্ড করল। এমন কাজ আর কেউ করতে পারে না। এই পৃথিবীতে কৃষ্ণ ও অর্জুন ছাড়া আর কেউ আগ্নেয়, বরুণ, সৌম্য, বায়ব্য, ঐন্দ্র, পাশুপত, পারমেষ্ট, প্রাজাপত্য, ধাত্র, ত্বাষ্ট্র, সাবিত্র ও বৈবস্বত অস্ত্রের প্রয়োগের ক্ষমতা রাখে না। তুমি এইসময় পান্ডবদের সাথে সন্ধি করো। আমার মৃত্যুতেই এই যুদ্ধ শেষ হোক। আমি সত্য বলছি, এখনও যদি আমার কথা না শোনো, তোমার মৃত্যু কেউ আটকাতে পারবে না।”

এই বলে ভীষ্ম চুপ করলেন। সবাই যে যার শিবিরে ফিরে গেলেন। এমন সময় কর্ণ এসে ভীষ্মকে প্রণাম করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “হে কুরুশ্রেষ্ঠ! যে প্রতিদিন আপনার সামনে এসে আপনাকে অপমান করে কষ্ট দিত, আমি সেই রাধেয় (রাধার ছেলে, কর্ণের পালিকা মায়ের নাম ছিল রাধা)।”

ভীষ্ম তখন খুব কষ্ট করে চোখ মেলে চেয়ে দেখলেন সেখানে আর কেউ নেই, শুধু প্রহরীরা আছে। ভীষ্ম প্রহরীদের সরে যেতে আদেশ দিয়ে এক হাত দিয়ে কর্ণকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “কর্ণ! তুমি এসে ভালো করেছ। আমি নারদ আর ব্যাসদেবের মুখে শুনেছি, তুমি অধিরথ আর রাধার ছেলে নও, তুমি কুন্তীর ছেলে। তুমি দুষ্ট দুর্যোধনের দলে যোগ দিয়ে পান্ডবদের নিন্দা করতে, তাই আমি তোমাকে কঠিন কথা বলতাম। কিন্তু আমি কখনো তোমাকে খারাপ ভাবিনি। আমি জানি, তোমার মত ধার্মিক, দাতা আর বীর এই পৃথিবীতে নেই। তুমি এখন তোমার ভাইদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকো, আমার মৃত্যুতেই এই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাক।”
কিন্তু ভীষ্মের অনুরোধেও কর্ণের মন ফিরল না। তিনি বললেন, “পান্ডবদের সঙ্গে আমার শত্রুতা কিছুতেই মিটবে না। আপনি অনুমতি দিন, আমি যুদ্ধ করব। আর যদি আপনার কাছে আমি কোনো অপ্প্রাধ করে থাকি, তবে আমাকে দয়া করে ক্ষমা করুন।”
কর্ণের কথা শুনে ভীষ্ম বললেন, “যদি যুদ্ধ করবেই, তবে ক্ষত্রিয়দের মত রাগশূন্য মনে যুদ্ধ করতে করতে স্বর্গে চলে যাও।”
কর্ণ ভীষ্মকে প্রণাম করে চলে গেলেন। শরশয্যায় ভীষ্মের আটান্ন দিন কেটেছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মাঘ মাসের শুক্লপক্ষে সূর্যের উত্তরায়ন শুরু হওয়ায় ভীষ্ম দেহত্যাগ করেন।

তথ্যসূত্র


  1. কালীপ্রসন্ন সিংহ বিরচিত ‘মহাভারত’, ভীষ্মপর্ব, অধ্যায় ১২০-১২৪, পৃষ্ঠা ৫০০-৫০৬
  2. ‘ছেলেদের মহাভারত', উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বসাক বুক স্টোর প্রাইভেট লিমিটেড, তৃতীয় মুদ্রণ, ভীষ্মপর্ব, পৃষ্ঠা ১৩৬-১৪০
  3. ‘মহাভারত সারানুবাদ', রাজশেখর বসু, কলিকাতা প্রেস, তৃতীয় প্রকাশ, ভীষ্মপর্ব, অষ্টাদশ অধ্যায়, শরশয্যায় ভীষ্ম, পৃষ্ঠা ৩৬৯-৩৭২

আপনার মতামত জানান