সতীপীঠ বৈদ্যনাথ মন্দিরটি ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দেওঘর জেলায় অবস্থিত। এটি একান্ন সতীপীঠের একটি পীঠ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর হৃদয় পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী জয়দুর্গা ও ভৈরব হলেন বৈদ্যনাথ। শক্তিপীঠ হওয়ার পাশাপাশি এটি একটি শৈবতীর্থও বটে। বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে অন্যতম হল এই সতীপীঠ বৈদ্যনাথ। শিবরাত্রি উদ্যাপনের জন্য প্রতি বছর এখানে মানুষের ঢল নামে। দেওঘরের বৈদ্যনাথ মন্দিরের মাহাত্ম্য অধিকাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বীর মনে বিরাজমান।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজের বাপের বাড়িতেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব এই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখণ্ডগুলিই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠিত হয়। বলা হয়, বৈদ্যনাথ সতীপীঠে সতীর হৃদয় পড়ে তৈরি হয়েছে এই শক্তিপীঠটি।
শৈব পুরাণে এই মন্দিরকে দুই আত্মার মিলনস্থল বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আবার মৎস্যপুরাণে এই মন্দিরের ভৈরবকে আরোগ্য বৈদ্যনাথ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে যিনি সর্বরোগহারী। রামায়ণের কাহিনীতেও এই বৈদ্যনাথ মন্দিরের প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। রামায়ণের পুরাণ কাহিনী অনুযায়ী দেখা যায়, ত্রেতা যুগে শিবভক্ত দশানন রাবণ একবার চাইলেন শিবকে কৈলাশ থেকে নিয়ে এসে লঙ্কায় প্রতিষ্ঠিত করে পুজো করতে। এই ভেবে দুর্জয় ও অমর হওয়ার বাসনায় কৈলাশ আক্রমণ করে বসেন তিনি। সে সময় কৈলাশের দ্বাররক্ষী নন্দীকে ‘অর্ধপশু অর্ধনর’ বলে অপমান করলে নন্দী রাবণকে অভিশাপ দেন যে বন্য বানর আর মানুষের হাতেই স্বর্ণলঙ্কা সহ রাবণের বিনাশ ঘটবে। এতে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে রাবণ নন্দীকে আছড়ে ফেলে যখন পুরো কৈলাশ পর্বতকেই তুলে ধরলেন, সেই সময় শিব বাম হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে পর্বতকে আবার মাটিতে বসিয়ে রাবণকে কঠোর তপস্যা করার আদেশ দেন। কঠিন তপস্যা শুরু করেন রাবণ, নিজের নয়টি মাথা বলি দিয়ে দেন তিনি। অবশেষে শেষ মাথাটি বলি দেওয়ার সময় আবির্ভূত হন শিব এবং রাবণের মনোবাসনা শুনে তাঁকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন। চন্দ্রহাস নামে একটি বিরাট শক্তিশালী অস্ত্রও রাবণকে উপহার দেন শিব। কিন্তু নিজ সিদ্ধান্তে অটল রাবণকে অবশেষে শিব আত্মলিঙ্গ অর্পণ করে লঙ্কায় প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। একইসঙ্গে তিনি রাবণকে সতর্ক করে দেন যে কৈলাশ থেকে লঙ্কার পথমধ্যে কোথাও যদি রাবণ শিবলিঙ্গকে ভূমিতে স্থাপন করেন, তিনি সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হবেন। দিব্য বিমাণে চড়ে রাবণ শিবলিঙ্গকে নিয়ে লঙ্কার দিকে আসতে লাগলেন। অন্যদিকে বিষ্ণু এবং শিবের বুদ্ধিতে রাবণকে প্রতিহত করার একটা পরিকল্পনা করা হল। বরুণদেব রাবণের উদরে প্রবেশ করলে প্রবল মূত্রবেগে দিব্য বিমান থেকে নেমে পড়তে বাধ্য হন রাবণ। এদিকে দ্বৈত সংকট উপস্থিত। শিবলিঙ্গকে সঙ্গে নিয়ে মূত্রত্যাগ করা যাবে না, আবার শিবলিঙ্গকে মাটিতে রাখাও যাবে না। কিন্তু কারো হাতে দেবার মতো লোকজনও সেখানে কেউ ছিল না। বিষ্ণু সেই সময় এক রাখালের বেশে তাঁর সামনে আসলে তাঁর হাতেই রাবণ শিবলিঙ্গকে রেখে মূত্রত্যাগে যান। কিন্তু রাখালবেশী বিষ্ণু সেই লিঙ্গ মাটিতে স্থাপন করেন। ব্রহ্মা স্বয়ং তাতে প্রথম পুজো করেন। আর রাবণের মূত্রত্যাগের ফলে সেই সময়েই শিবলিঙ্গের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে একটা বিরাট কুণ্ড তৈরি হয়ে যায়। ‘হরলিজুড়ি’ নামের সেই কুণ্ড আজও আছে। রাবণ ফিরে এসে এই অবস্থা দেখে বহু চেষ্টা করেও শিবলিঙ্গকে মাটি থেকে তুলতে পারলেন না। এই কাহিনীর পাশাপাশি এক ভীল বালকের অনুষঙ্গও জড়িয়ে আছে। বৈজু নামে এক ভীল বালকের পরম ভক্তি দেখে শিব তাঁর ইচ্ছা মতো এখানে বৈজুনাথ নামে পরিচিত হলেন আর যেহেতু সেই বৈজু ছিলেন এক বৈদ্য, তাই বৈজুনাথের পাশাপাশি তিনি বৈদ্যনাথ নামেও পরিচিত হন।
ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায় যে, মোগল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ এই বৈদ্যনাথ শক্তিপীঠের মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। আবার মতান্তরে জানা যায় দেওঘর রাজ্যের রাজা গিধাউর এই মন্দির নির্মাণের কাজে সহায়তা করেছিলেন এবং পরে ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি এই মন্দির সংস্কারে প্রভূত সাহায্য করে।
বৈদ্যনাথে শিব ও শক্তি একসাথে বিরাজমান। তবে শিবক্ষেত্র হিসাবেই বৈদ্যনাথ বেশি পরিচিত। এক সময়ে এই মন্দিরের কিছু দূরে শ্মশান ছিল যেখানে মায়ের হৃদয় পড়েছে বলে মনে করা হয়। এই জায়গাটি বর্তমানে চিতাভূমি নামে পরিচিত। মায়ের হৃদয় পতিত হওয়ায় এই পীঠ ‘হৃদয়পীঠ’ নামেও পরিচিত। বৈদ্যনাথ মন্দিরের ঠিক সামনে শক্তিপীঠটি অবস্থান করছে। শিব মন্দিরের সাথে মায়ের মন্দিরের চূড়া লাল সুতো দিয়ে গাঁট বন্ধনে বাঁধা থাকে। ভক্তদের বিশ্বাস এই পীঠে বর-কনে একসঙ্গে পুজো দিলে তাদেরও বন্ধন অটুট হবে। প্রধান মন্দিরের সঙ্গে পার্বতী মন্দিরের এই সুতোর বন্ধন হিন্দু ধর্মীয় ব্যাখ্যায় শক্তি ও শিবের মিলনের প্রতীক।
প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকেন। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। বৈদ্যনাথ সতীপীঠে দেবী হলেন জয়দুর্গা এবং ভৈরব হলেন বৈদ্যনাথ।
এই সতীপীঠে শিবরাত্রি পালিত হয় মহা ধুমধাম করে। বহু জায়গা থেকে অগণিত দর্শনার্থী বছরের এই বিশেষ সময়ে এই মন্দিরে সমাগত হন। শিব ও পার্বতীর বিবাহের দিন হিসেবেই এখানে পালিত হয় শিবরাত্রি। ফলে এই অনুষ্ঠানের সবথেকে আকর্ষণীয় বিষয় হল শিবের বরযাত্রীর অনুষ্ঠান যাকে ‘বারাত’ বলা হয়।