বাংলা সাহিত্যের এক দিকপাল কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় (Shirshendu Mukhopadhyay)। শিশু থেকে বৃদ্ধ প্রত্যেক বাঙালি পাঠকের কাছে লেখক হিসেবে যথেষ্ট সমাদৃত তিনি। পঞ্চাশের দশকের বিশৃঙ্খল সময়েই সাহিত্যজগতে পদার্পণ করেন তিনি। সমাজ ও ব্যক্তির সংকট ও দ্বন্দ্বের নানা রূপ নিপুণ শব্দের বুননে ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়। ১৯৫৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ার সময়েই প্রথম ছোটগল্প প্রকাশিত হয় তাঁর। তারপরে ১৯৬৭ তে ‘ঘুণপোকা’ উপন্যাস প্রকাশের পরই সাহিত্যজগতে স্থায়ী আসন লাভ করেন শীর্ষেন্দু। গভীর জীবনবোধে দৃপ্ত তাঁর রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে ‘দূরবীন’, ‘পারাপার’, ‘মানবজমিন’, ‘উজান’ ইত্যাদি কালজয়ী সব উপন্যাস। শিশু-কিশোরদের জন্যেও তিনি বহু গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। ‘গয়নার বাক্স’, ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’, ‘ছায়াময়’, ‘বিপিনবাবুর বিপদ’, ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’, ‘পাতালঘর’ ইত্যাদি সবই এই ধারার রচনা। গোয়েন্দা এবং ভূতের গল্প লেখাতেও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় অতুলনীয়। শীর্ষেন্দুর লেখা ‘পাতালঘর’, ‘দূরত্ব’, ‘হীরের আংটি’, ‘গয়নার বাক্স’, ‘আজব গাঁয়ের আজব কথা’, ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’ ইত্যাদি উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে।
১৯৩৫ সালের ২ নভেম্বর অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। তাঁদের আদি নিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে। তাঁর বাবা ফণীন্দ্রলাল মুখোপাধ্যায় পেশায় একজন রেলকর্মী ছিলেন এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল গায়ত্রী মুখোপাধ্যায়। তাঁর ঠাকুরদা আইন ব্যবসার পসারের জন্য বিক্রমপুরের বাইনখাড়া গ্রাম থেকে চলে আসেন ময়মনসিংহে। শীর্ষেন্দুর বাবার বদলির চাকরির সুবাদে শৈশবেই বাংলা, অসম ও বিহারের বহু জায়গায় ঘোরা হয়ে গিয়েছিল তাঁর। বিশেষত উত্তরবঙ্গের মাল জংশন, দোমোহানি, পাণ্ডু, লামডিং, বদরপুর, আলিপুরদুয়ার, শিলিগুড়ি ইত্যাদি জায়গায় তাঁর জীবনের অনেক মুহূর্ত কেটেছে। পরবর্তীকালে এই সব ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তাঁর লেখার মধ্যে রূপ পেয়েছে। জীবনের প্রথম এগারোটি বছর এই ময়মনসিংহের বাড়িতেই কেটেছিল শীর্ষেন্দুর। পরবর্তীকালে ১৯৬৮ সালে সোনামন চক্রবর্তীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন শীর্ষেন্দু। তাঁদের এক ছেলে সম্রাট এবং এক মেয়ে দেবলীনা।
কোচবিহারের মিশনারি স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়। সেই সময় থেকেই বোর্ডিংয়ে থাকা অভ্যাস হয়ে যায় তাঁর। ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই দেশভাগ প্রত্যক্ষ করেন তিনি। ১৯৫২ সালে কোচবিহারের কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি আর তারপরে ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। ১৯৫৫ সালে তিনি বাংলায় সাম্মানিক সহ স্নাতক স্তরে ভর্তি হন কলকাতার সিটি কলেজে। এখানে তাঁর শিক্ষক ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এবং সমালোচক ও গবেষক শঙ্করীপ্রসাদ বসু। লেখক অমলেন্দু চক্রবর্তী এবং জাহ্নবী কুমার চক্রবর্তী ছিলেন শীর্ষেন্দুর সহপাঠী। তারপরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি হলেও সাহিত্যসাধনার আগ্রহে পরীক্ষা দেওয়া হয়নি তাঁর। ছাত্র থাকাকালীনই ১৯৫৯ সালে ‘জলতরঙ্গ’ নামে একটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয় ‘দেশ’ পত্রিকায়। ঐ সময়েই বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ প্রমুখদের সঙ্গে আলাপ জমে ওঠে তাঁর।
মেদিনীপুর জেলার নারায়ণগড়ের একটি স্কুলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৬১ সালে কালীঘাট ওরিয়েন্টাল অ্যাকাডেমি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। ১৯৬৫ সালের শুরুর দিকে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের কাছে দীক্ষিত হন তিনি। ১৯৬৭ সালে ‘দেশ’ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’। তারপরই বাংলার সাহিত্যজগতে আলোড়ন পড়ে যায়। ১৯৭৬ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দেন শীর্ষেন্দু। তারপরে দীর্ঘকাল তিনি ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদকের পদে আসীন ছিলেন।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখার মধ্যে একটা অধ্যাত্মবাদের স্পষ্ট ছোঁয়া লেগে থাকে। বোহেমিয়ানা তাঁর সাহিত্যিক বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়, বরং এক সাজানো গোছানো সাংসারিক তথা পারিবারিক পরিবেশেই তিনি থাকতে স্বচ্ছন্দ। তাঁর কাছে লেখালিখি আসলে একটা ‘মিশনারি ওয়ার্ক’ অর্থাৎ হিতকারী কাজ। তাঁর গল্প-উপন্যাসের প্রধান কেন্দ্রে থাকে মধ্যবিত্ত সমাজের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন। ‘ঘুণপোকা’ উপন্যাসে শ্যাম চরিত্রের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির অস্তিত্বের সংকট নিয়ে এক বিরাট প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন শীর্ষেন্দু। আবার ‘দূরবীন’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ধ্রুবকে দেখা যায় একজন হতাশ ও ধর্ষকামী চরিত্র হিসেবে। ‘পারাপার’ উপন্যাসের ক্যান্সার রোগাক্রান্ত ললিতের শিশু হয়ে পুনরায় এই পৃথিবীতে ফিরে আসার অদ্ভুত ইচ্ছে উপন্যাসকে এক নতুন মাত্রা দেয়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে একদিকে দেশভাগ, খণ্ডিত স্বাধীনতার লজ্জা আর বিশ্বযুদ্ধের সংকট ছাপ ফেলেছিল বাংলা তথা ভারতের মধ্যবিত্ত সমাজের মনভূমে। দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় এই মধ্যবিত্ত সমাজকেই প্রতিভাত করেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
তিনি মোট ৮২টি উপন্যাস লিখেছেন, ৩৭টি গল্প সংকলন রয়েছে তাঁর, এছাড়াও শিশু-কিশোরদের জন্য প্রায় ৫৪টি বই লিখেছেন তিনি। উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘উজান’, ‘পারাপার’ (১৯৭১), ‘ফেরা’, ‘যাও পাখি’ (১৯৭৬), ‘কাগজের বউ’ (১৯৭৭), ‘শূন্যের উদ্যান’ (১৯৭৮), ‘জাল’ (১৯৮৫), ‘দূরবীন’ (১৯৮৬), ‘মানবজমিন’ (১৯৮৮), ‘কাঁচের মানুষ’, ‘ওয়ারিশ’ (১৯৯৫), ‘পার্থিব’ (১৯৯৪), ‘অসুখের পরে’ (১৯৯৫) ইত্যাদি। ১৯৯০ সালে ‘কাছের ঠাকুর’ নামে এবং ২০১০ সালে ‘সুদূর প্রসারী বৃষ্টি’ নামে মোট দুটি ফিচার জীবনী লিখেছেন শীর্ষেন্দু। তাঁর লেখা দুটি অসামান্য ভ্রমণ বৃত্তান্ত হল ‘বাঙালের আমেরিকা দর্শন’ (১৯৯৭) এবং ‘পথে প্রান্তরে’। ছোটোদের জন্য তাঁর লেখা প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত গল্প ছিল মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি যা ১৯৭৮ সালে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়। যদিও তার আগে ১৯৭৬ সালে তিনি লিখেছিলেন ‘গল্পটা খুব সন্দেহজনক’ নামে আরেকটি গল্প। এছাড়াও শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প-উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’ (১৯৮১), ‘নৃসিংহ রহস্য’ (১৯৮৫), ‘গোয়েন্দা বরদাচরণ’ (১৯৮৫), ‘পাগলা সাহেবের কবর’ (১৯৮৭), ‘ছায়াময়’ (১৯৯২), ‘অদ্ভুতুড়ে’ (১৯৯৬), ‘বিপিন বাবুর বিপদ’ (১৯৯৮) ইত্যাদি।
বাংলা সাহিত্যে বিশেষ কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৩ সালে ‘আনন্দ’ পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। এর আগে যদিও ১৯৮৫ সালে বিদ্যাসাগর পুরস্কার এবং ১৯৮৮ সালে রামকুমার ভূয়ালকা পুরস্কার পেয়েছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় । ১৯৮৯ সালে তাঁর লেখা ‘মানবজমিন’ উপন্যাসের জন্য ‘সাহিত্য অকাদেমি’ পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে ‘বঙ্গবিভূষণ’ উপাধিতে সম্মানিত করেন। ২০২১ সালে সাহিত্য অকাদেমির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা বহু গল্প-উপন্যাস ইংরেজি সহ ভারতের অন্যান্য আরো ভাষাতে অনূদিত হয়েছে, রাশিয়ান ভাষাতেও সেগুলির অনুবাদ হয়েছে। তাঁর লেখা কিছু গল্প-উপন্যাস নিয়ে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি। ১৯৭৮ সালে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ‘দূরত্ব’ নামে একটি ছবি তৈরি করেন, ১৯৯২ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষ তৈরি করেন ‘হীরের আংটি’ নামে আরেকটি ছবি। এছাড়া ১৯৯৮ সালে তপন সিন্হার পরিচালনায় ‘আজব গাঁয়ের আজব কথা’, ২০০৩ সালে অভিজিৎ চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘পাতালঘর’, ২০১০ সালে অঞ্জন দাসের পরিচালনায় ‘বাঁশিওয়ালা’ মুক্তি পায় যা সবই তাঁর গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। ২০১১ সালে নীতিশ রায়ের পরিচালনায় ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’, ২০১২ সালে অপর্ণা সেন পরিচালিত ‘গয়নার বাক্স’ এবং ২০১৩ সালে হরনাথ চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘ছায়াময়’ সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির তালিকায় পড়ে। ২০১৩ সালে পরিচালক অনীক দত্তের পরিচালনায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ নামে একটি ছবি মুক্তি পায়। এছাড়াও গোয়েন্দা শবর দাশগুপ্তকে নিয়ে লেখা তিনটি উপন্যাস অবলম্বনে তিনটি ভিন্ন মাত্রার ছবি নির্মিত হয়েছে। অরিন্দম শীলের পরিচালনায় এই ধারার প্রথম ছবি ‘এবার শবর’ মুক্তি পায় ২০১৫ সালে, তারপর ২০১৬ সালে মুক্তি পায় ‘ঈগলের চোখ’ এবং ২০১৮ সালে মুক্তি পায় ‘আসছে আবার শবর’ নামে তিনটি পৃথক পৃথক চলচ্চিত্র। বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দা চরিত্রদের মধ্যে শবর দাশগুপ্ত এক স্বাতন্ত্র্যের ছাপ রেখে যায়। তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে বহু কমিকসও তৈরি হয়েছে। যেমন, ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের ‘আনন্দমেলা’ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিপিনবাবুর বিপদ’ উপন্যাস অবলম্বনে একটি কমিকস যার অলঙ্করণ করেছিলেন স্বপন দেবনাথ। পারুল প্রকাশনী তাঁর লেখা ‘পাতালঘর’, ‘বিধু দারোগা’, ‘পাগলা সাহেবের কবর’ এবং ‘পটাশগড়ের জঙ্গলে’ ইত্যাদি উপন্যাস অবলম্বনে আরো চারটি কমিকস প্রকাশ করেছে। বিখ্যাত অলঙ্করণ শিল্পী সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায় এই কমিকসগুলিতে ছবি এঁকেছিলেন।
সাহিত্য অকাদেমির সদস্য হিসেবে বর্তমানে কাজ করছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং আজও তাঁর লেখনী চলছে অবিরত।