পূর্বস্থলী চুপির চর

চুপির চর ।। পূর্বস্থলী ।। কাষ্ঠশালী ভ্রমণ

কেউ বলে চুপির চর, কেউ বলে পূর্বস্থলী আবার কেউ বলে কাষ্ঠশালী। তিনটে জায়গার মানে স্থানীয়দের কাছে আলাদা হলেও পর্যটকদের কাছে তিনটের মানে একটাই। সেটা হল ছাড়ি গঙ্গার ধারে শীতকালে পিকনিক করতে আসা এবং ছাড়ি গঙ্গার বুকে নৌকাভ্রমণের অসাধারণ অভিজ্ঞতা। পাখিপ্রেমীদের কাছে অবশ্য এখানে আসার কারণ হল শীতকালে উত্তরবঙ্গ তথা উত্তর এশিয়া, ইউরোপ, তিব্বত, সাইবেরিয়া থেকে পরিযায়ী পাখিদের ভিড় দেখতে আসা।

পাখি। ছবি সববাংলায়

বর্ধমান শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তনের ফলে তৈরি হয়েছে একটি অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ (Ox bow lake), যাকে স্থানীয়রা ছাড়ি গঙ্গা বলে। মূল গঙ্গা এই লেকটিকে ছেড়ে চলে গেছে বলে লেকের নাম ছাড়ি গঙ্গা। জায়গাটি পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলী ২ পঞ্চায়েত সমিতির অন্তর্গত চুপি গ্রামে অবস্থিত। লেকের এই পাড়ের জায়গা যেখানে পিকনিক করা হয় তার নাম কাষ্ঠশালী। লেকের ওই পাড়ে যে জায়গাটি আছে, তাকে বলে চুপির চর।

ছাড়ি গঙ্গাকে ঘিরে পরিযায়ী পাখিদের ভিড় পূর্বস্থলী জায়গাটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। শীতকালে কাছেপিঠের পাখিরা যেমন ভিড় জমায় এখানে, তেমনই অনেক দূর থেকেও তুলনায় উষ্ণ এই জায়গায় খাবার ও প্রজননের প্রয়োজনে পাখিরা আসে। উত্তরবঙ্গ থেকেও যেমন কিছু পাখি আসে, তেমনই আসে উত্তর এশিয়া, ইউরোপ, তিব্বত, সাইবেরিয়া এইসব জায়গা থেকেও। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অসপ্রে, রুডি, স্মল প্রাটিনকোল, গ্রিন বি ইটার শেলডাক, রিভার ল্যাপ, গ্রে হেরন,উইং পার্পল হেরন, রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড সহ অন্যান্য পাখি। পাখিপ্রেমীরা এইসব পাখিকে সহজেই চিনতে পারে, তবে সাধারণ মানুষেরা এদের চিনতে না পারলেও ক্ষতি নেই। চারপাশে অচেনা পাখি দেখা ও তাদের কোলাহল শুনতে শুনতে নৌকাভ্রমণের অভিজ্ঞতা অন্য রকম। এছাড়া শীতের দুপুরে পিকনিক তো রয়েছেই।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

পাখি। ছবি সববাংলায়

ট্রেনে এলে নামতে হবে পূর্বস্থলী ষ্টেশন। ষ্টেশনের বাইরে মিলবে টোটো। টোটো করে সহজেই এখানে আসা যাবে। টোটো করে এসে পার্কিং জোনে নেমে যেতে হবে। সেখান থেকে কিছুটা হাঁটাপথ। পিকনিক করতে পর্যটকেরা সাধারণত নিজের গাড়িতে বা বাসে করে আসে। খেয়াল রাখতে হবে আসবার পথ অত্যন্ত সরু। বড় বাস নিয়ে এখানে প্রবেশ করলে অসুবিধার সৃষ্টি হতে পারে। নিজের গাড়ি করে এলে চৈতন্য সেতু দিয়ে ভাগীরথী পেরিয়ে পূর্বস্থলী বাজার হয়ে স্টেশন। তারপর সেখান থেকে ডান দিকে ঘুরে স্টেশনের পিছন দিক দিয়ে খানিকটা গেলেই পিকনিক স্পট তথা লেক। পার্কিং জোন ছাড়া অন্য কোনও স্থানে গাড়ি রাখা যাবে না। পার্কিং জোনটি পিকনিক স্পট থেকে পায়ে হাঁটা পথ হলেও সন্ধ্যের সময় পার্কিং জোন সম্পূর্ণ অন্ধকার এবং সেই সময় পার্কিং-এ একা না আসাই ভাল।

বর্ধমান শহর এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল থেকে মানুষেরা পিকনিক করতেই মূলত এখানে আসে। পিকনিকের সাথে পাখি দেখা তাদের উপরিপাওনা। পিকনিক স্পটের জন্য স্থানীয় লোকেরা মাথাপিছু ১০ থেকে ১৫ টাকা করে ভাড়া নেয়। এটা তাদের কথায় জায়গাটা পরিষ্কার রাখার জন্য। পাখিপ্রেমীরা দূর থেকে এখানে থাকবার জন্যও আসে। তাদের জন্য রয়েছে পঞ্চায়েত সমিতির গেস্ট হাউস, জলাভূমির পাশে বেসরকারি কটেজ এবং রুম।

পূর্বস্থলী এসে দ্রষ্টব্য বা ঘোরার জায়গা মূলত দুটিই। পিকনিক স্পট এবং ছাড়ি গঙ্গা লেক।

পিকনিক স্পট। ছবি সববাংলায়

কাষ্ঠশালী পিকনিক স্পট – দলবল নিয়ে শীতকালে পিকনিক করতে আসার জন্য আদর্শ স্থান এটা। তবে মানুষের ক্রমাগত ভিড় আর হই-হট্টগোলে কয়েক বছর ধরেই পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা কমছে। পরিযায়ী পাখিরা একটু উষ্ণতা পাবার আশায় এখানে আসত, কিন্তু ক্রমাগত সেই সংখ্যা কমছে। তাদের কথা মাথায় রেখে একটু সংযত হওয়া দরকার। সেই কারণে পঞ্চায়েত থেকে কিছু নিয়ম করে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো মেনে চলতে হবে। পিকনিকের জায়গায় নোংরা আবর্জনা ফেলবেন না। আবর্জনা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানেই আবর্জনা ফেলুন। পিকনিকে মাইক বা বক্স বাজানো, ডিজে, জোরে গান চালানো নিষিদ্ধ। উন্মুক্ত স্থানে মদ খাওয়া বা কোনরকম নেশা করা একেবারেই নিষিদ্ধ। বদলে লেকের ধারে মনোরম পরিবেশে পাখি দেখতে দেখতে পিকনিক করুন। নিজেরা কোলাহল না করে পাখিদের কোলাহল শুনুন। যারা দল বেঁধে এখানে এসে রান্না বান্না করে খাবার কথা ভাবছেন, তাঁরা এখানের স্থানীয় দোকানের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। সেখানে যথাযথ মূল্যেই পছন্দের খাবার পাওয়া যায়। আগে থেকে তাদের বলে রাখতে হবে। এতে করে অতিরিক্ত বাসন ধোয়ার ঝামেলা যেমন থাকে না, পিকনিক স্পট নোংরা হয় অপেক্ষাকৃত কম এবং আপনাদের হাতে কিছুটা অতিরিক্ত সময় থাকে , যাতে করে আপনি জায়গাটি বেশি সময় ধরে উপভোগ করতে পারেন।

ছাড়ি গঙ্গা লেক। ছবি সববাংলায়

ছাড়ি গঙ্গা লেক – ভূগোলের ছাত্র এবং পাখিপ্রেমীদের পছন্দের জায়গা হতে পারে ছাড়ি গঙ্গা লেক। অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ নিয়ে ভূগোলের বইতে আমরা পড়েছি, এই লেকে এসে সেটা দেখা যায়। গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তনের ফলে তৈরি হয়েছে এই অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ বা লেকটি। মূল গঙ্গা থেকে আলাদা হওয়ায় বা গঙ্গানদী এই লেকটিকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় লেকের নাম ছাড়ি গঙ্গা। নৌকা করে এই লেক ঘুরে দেখা যায়। বড় নৌকায় সর্বাধিক ৮ জন এবং ছোট নৌকায় সর্বাধিক ৪ জন ভ্রমণ করতে পারে। নৌকা আগে থেকে বুক করার কোন উপায় নেই। স্পটে এসেই বুক করতে হবে। নৌকা করে শান্ত এই পরিবেশে যেতে যেতে মন হারিয়ে যেতে বাধ্য। সঙ্গে ক্যামেরাবন্দি করুন সেই সব অতিথি পাখিদের যারা ভিনদেশ থেকে এসেছে। পরিযায়ী পাখিদের স্বর্গরাজ্য এই লেক। তবে লেকে মানুষের উৎপাতে পাখির সংখ্যা অনেক কমছে। পরিবর্তে চুপিগ্রাম থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে নবদ্বীপের একটি নতুন অংশে ভিড় জমাচ্ছে তারা। পাখিদের কথা মাথায় রেখে আমাদের বেশ কিছ নিয়ম মেনে চলতে হবে। লেকের জলে নোংরা আবর্জনা ফেলবেন না। মাইক বা বক্স বাজানো, ডিজে, জোরে গান চালানো নিষিদ্ধ। নৌকায় ভ্রমণকালে হই হট্টগোল বা চেঁচামেচি করাও মানা। অনেকে মজা করার জন্য পানীয় জলের বোতলে মদ মিশিয়ে নিয়ে লেকের জলে নামবার কথা ভাবে। মদ খেয়ে লেকের জলে নামবেন না বা পানীয় জলে মদ মিশিয়ে নিয়েও নৌকায় উঠবেন না। এটা দণ্ডনীয় অপরাধ। একমাত্র সিল করা জলের বোতল নিয়েই নৌকায় ওঠা যায়। নৌকায় ভ্রমণকালে সকলের লাইফ জ্যাকেট পরা বাধ্যতামূলক। অনেকেই ভাল ছবি উঠবে না অথবা শৌখিনতার কারণে লাইফ জ্যাকেট পড়তে চান না বা মাঝপথে খুলে ফেলেন। এটা অত্যন্ত বিপদজনক।

সারা বছর ধরেই এখানে আসা যায়। তবে পুজোর পর থেকে পুরো শীতকালটাই পিকনিক এবং পাখি দেখার জন্য আদর্শ সময়।


ট্রিপ টিপস

  • কীভাবে যাবেন – ট্রেনে এলে নামতে হবে পূর্বস্থলী ষ্টেশন। ষ্টেশনের বাইরে মিলবে টোটো। পিকনিক করতে পর্যটকেরা সাধারণত নিজের গাড়িতে আসে।
  • কোথায় থাকবেন – পঞ্চায়েত সমিতির গেস্ট হাউস, জলাভূমির পাশে বেসরকারি কটেজ এবং রুম।
  • কী দেখবেন – ছাড়ি গঙ্গার বুকে নৌকাভ্রমণের সাথে শীতকালে উত্তরবঙ্গ তথা উত্তর এশিয়া, ইউরোপ, তিব্বত, সাইবেরিয়া থেকে পরিযায়ী পাখিদের ভিড়।
  • কখন যাবেন – সারা বছর ধরেই এখানে যাওয়া যায়। তবে শীতকালে পরিযায়ী পাখিদের ভিড় হয় বেশি। এছাড়াও পিকনিকের জন্য আদর্শ স্থান শীতকাল।
  • সতর্কতা
    • পিকনিকের জায়গায় বা লেকের জলে নোংরা আবর্জনা ফেলবেন না। আবর্জনা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানেই আবর্জনা ফেলুন।
    • পিকনিক স্পটের জন্য স্থানীয় লোকেরা মাথাপিছু ১০ থেকে ১৫ টাকা করে ভাড়া নেয়।
    • পাখিরালয়ে আসবার পথ অত্যন্ত সরু। বড় বাস নিয়ে এখানে প্রবেশ করলে অসুবিধার সৃষ্টি হতে পারে।
    • পার্কিং জোন ছাড়া অন্য কোনও স্থানে গাড়ি রাখা যাবে না। স্টেশন থেকে টোটো করে গেলেও পার্কিং জোনেই নেমে যেতে হবে।
    • পার্কিং জোনটি পিকনিক স্পট থেকে পায়ে হাঁটা পথ হলেও সন্ধ্যের সময় পার্কিং জোন সম্পূর্ণ অন্ধকার এবং সেই সময় পার্কিং-এ একা না আসাই ভাল।
    • পিকনিকের স্থানে বা নৌকায় ভ্রমণকালে মাইক বা বক্স বাজানো, ডিজে, জোরে গান চালানো নিষিদ্ধ। নৌকায় ভ্রমণকালে হই হট্টগোল বা চেঁচামেচি করাও মানা।
    • উন্মুক্ত স্থানে মদ খাওয়া বা কোনরকম নেশা করা একেবারেই নিষিদ্ধ।
    • অনেকে মদ খাওয়ার জন্য পানীয় জলে মদ মিশিয়ে নিয়ে লেকের জলে নামবার কথা ভাবে। মদ খেয়ে লেকের জলে নামবেন না বা জলে মদ মিশিয়ে নিয়েও নৌকায় উঠবেন না। এটা দণ্ডনীয় অপরাধ। একমাত্র সিল করা জলের বোতল নিয়েই নৌকায় ওঠা যায়।
    • নৌকায় ভ্রমণকালে সকলের লাইফ জ্যাকেট পরা বাধ্যতামূলক। অনেকেই ভাল ছবি উঠবে না অথবা শৌখিনতার কারণে লাইফ জ্যাকেট পড়তে চান না বা মাঝপথে খুলে ফেলেন। এটা অত্যন্ত বিপদজনক।
    • নৌকায় ভ্রমণকালে জলের মধ্যে হাত দেবেন না। এর ফলে অনেক সময়ে ব্যালান্স হারিয়ে জলে পড়ে যেতে পারেন। একই কারণে নৌকায় দাঁড়িয়ে ছবি তোলাও নিষেধ।
    • বড় নৌকায় সর্বাধিক ৮ জন এবং ছোট নৌকায় সর্বাধিক ৪ জন ভ্রমণ করতে পারে।
    • নৌকা আগে থেকে বুক করার কোন উপায় নেই। স্পটে গিয়েই বুক করতে হবে।
    • সূর্যাস্তের আগেই সকল নৌকা পাড়ে ফিরে আসে। সেইভাবেই আপনার যাত্রা প্ল্যান করুন। অযথা মাঝিকে সূর্যাস্তের পর অতিরিক্ত সময় কাটানোর জন্য জোর করবেন না।
  • বিশেষ পরামর্শ
    • পিকনিক করার জন্য যারা দল বেঁধে এখানে এসে রান্না বান্না করে খাবার কথা ভাবছেন, তাঁরা এখানের স্থানীয় দোকানের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। সেখানে যথাযথ মূল্যেই পছন্দের খাবার পাওয়া যায়। আগে থেকে তাদের বলে রাখতে হবে। এতে করে অতিরিক্ত বাসনকোসন ধোয়ার ঝামেলা যেমন থাকে না, পিকনিক স্পট নোংরা হয় অপেক্ষাকৃত কম এবং আপনাদের হাতে কিছুটা অতিরিক্ত সময় থাকে , যাতে করে আপনি জায়গাটি বেশি সময় ধরে উপভোগ করতে পারেন।

তথ্যসূত্র


  1. নিজস্ব প্রতিনিধি
  2. https://www.anandabazar.com/

আপনার মতামত জানান