হকি খেলা

হকি

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি আউটডোর দলগত খেলা হকি (Hockey)। ১১ জন খেলোয়াড়ের দুটি দলের মধ্যে একটি বাঁকানো লাঠির সাহায্যে একটি শক্ত, ছোট বলকে বিপক্ষের গোলে মারার মধ্য দিয়েই হকি খেলা অনুষ্ঠিত হয়। সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে ইংল্যান্ড, গ্রিস, ভারত সহ অন্যান্য প্রায় সব দেশেই হকি খেলা প্রচলিত রয়েছে। কবাডির পাশাপাশি হকি খেলাও ভারতের অন্যতম জাতীয় খেলা।

১৭৭৩ সালে রিচার্ড জনসনের লেখা ‘জুভেনাইল স্পোর্টস অ্যান্ড পাসটাইমস’-এ প্রথম একটি অধ্যায়ের নামকরণে ‘হকি’ নামকরণটি খুঁজে পাওয়া যায়। এই বইটিরই একাদশ অধ্যায়ের নাম ছিল ‘নিউ ইমপ্রুভমেন্টস অন দ্য গেম হকি’। যদিও এর আগে ১৩৬৩ সালে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডের একটি ঘোষণায় হকির উল্লেখ করা হয়েছিল বলে অনেকে বিশ্বাস করেন, যদিও এই ধারণা প্রশ্নাতীত নয়। মনে করা হয় ফরাসি ভাষায় মেষপালকদের ব্যবহৃত লাঠিকে ‘হকেট’ (hoquet) বলা হত আর তা থেকেই সম্ভবত ‘হকি’ কথাটি এসেছে। পৃথিবীর অনেক প্রাচীন সভ্যতায় একটি বাঁকা লাঠি আর বল দিয়ে খেলার ঐতিহ্য ছিল। প্রায় ৪০০০ বছরের পুরনো মিশরীয় একটি খোদাইকৃত লিপিতে একটি লাঠি আর একটি দলের প্রক্ষিপ্ত ছবি পাওয়া যায়। আয়ারল্যান্ডে ১২৭২ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে এই খেলার অস্তিত্ব ছিল বলে মনে করা হয় এবং প্রাচীন গ্রিসে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ একইরকম খেলার অস্তিত্ব ছিল যার নাম ছিল ‘কেরেৎজিন’ (kerētízein)। শিং বা শিং-এর মত একটি লাঠি দিয়ে এটি খেলা হত। আজ থেকে প্রায় ১০০০ বছর আগে মঙ্গোলিয়ায় ‘বেইকু’ (beikou) নামে ঠিক আজকের ফিল্ড হকির মত একটি খেলার প্রচলন ছিল। মধ্যযুগে খেলা সংক্রান্ত আইন-কানুনের বইপত্রেও হকির মত বহু খেলার উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৫২৭ সালে আয়ারল্যান্ডে ‘গ্যালোয়ে সংবিধি’ (Galway Statute) অনুসারে ‘হুকড’ ব্যবহার করে সমস্ত প্রকার বল সংক্রান্ত খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এছাড়া আজ থেকে ১০০০ বছর আগে ইথিওপিয়ায় এবং প্রায় দুই হাজার বছর আগে ইরানেও এই হকি খেলার প্রচলনের ঐতিহাসিক নথি পাওয়া যায়। বিভিন্ন জাদুঘরের প্রামাণ্য নথি থেকে বলা যায় যে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের আগে গ্রিস ও রোমের পাশাপাশি অ্যাজটেকদের মধ্যেও এই খেলার একটি রূপ প্রচলিত ছিল। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডে আধুনিক হকি খেলা শুরু হয়। ১৮৫০-এর দশকে স্কুলে স্কুলে এই খেলার জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীতেও হকি খেলার প্রচলন শুরু হয়। ১৮৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম হকি অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয় এবং হকি খেলার প্রাথমিক কিছু নিয়মবিধি প্রণয়ন করা হয়। ১৮৮৩ সালে লন্ডনের উইম্বলডনে আরেকটি হকি ক্লাব স্থাপিত হয় এবং এই ক্লাবই হকি খেলাকে একটি যথাবিহিত প্রামাণ্য রূপ দেয়। ১৮৯৫ সালে প্রথম ইংল্যান্ডের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের হকি খেলা হয় যেখানে ৫-০ পয়েন্টের ব্যবধানে ইংল্যান্ডের কাছে আয়ারল্যান্ড পরাজিত হয়। এই ম্যাচটাই ছিল বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিখকি ম্যাচ। ১৯০৮ সালে অলিম্পিকেও হকি খেলা স্থান পায় এবং ঐ বছরই পুরুষদের হকি অলিম্পিক প্রতিযোগিতা আনুষ্ঠানিকভাবে আয়োজিত হয় যেখানে ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলস অংশ নেয়। হকির আন্তর্জাতিক স্তরে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে ব্রাসেলসে ১৯২৪ সালে গড়ে ওঠে ‘ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল দ্য হকি’ (Federation International the Hockey) বা সংক্ষেপে FIH। ১৯২৭ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ওমেন্স হকি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৮ সালে প্রথম হকি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮০ সালে অলিম্পিকেও মহিলাদের জন্য হকি খেলা চালু হয়।

হকি খেলার অনেকগুলি প্রকারভেদ রয়েছে। যেমন – ব্যান্ডি, ফিল্ড হকি, আইস হকি, প্যারা আইস হকি, রোলার হকি, স্ট্রিট হকি ইত্যাদি। এর মধ্যে মূলত ফিল্ড হকিকেই প্রামাণ্য হকির মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ইউরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নিউজিল্যান্ডে এই ফিল্ড হকি অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা। খেলার মূল উদ্দেশ্য হল লাঠি দিয়ে একটি বলকে আঘাত করে গোল করা। ফুটবলে যেমন একইভাবে পা দিয়ে বলে আঘাত করে গোল করার লক্ষ্য থাকে, হকির ক্ষেত্রে পায়ের বদলে সরঞ্জাম হল লাঠি। যে দল গোলে বল পাঠাবে, প্রতিবার সেই দল একটি করে পয়েন্ট পায়। সবচেয়ে বেশি গোলদাতা দলকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। মোট এগার জন খেলোয়াড় নিয়ে একেকটি হকি দল গড়ে ওঠে যেখানে ১ জন থাকেন গোলরক্ষক এবং ১০ জন আউটফিল্ড খেলোয়াড়। এই ১০ জন খেলোয়াড় আবার তিন ভাগে বিভক্ত – আত্মরক্ষক (Defender), মাঝ-মাঠের খেলোয়াড় (Mid Fielder) এবং আক্রমণকারী (Attacker)। হকি খেলার জন্য মাঠের প্রতিটি পিচের দৈর্ঘ্য হওয়া উচিত ১০০ গজ ও প্রস্থ হওয়া উচিত ৬০ গজ। মাঠের প্রস্থ বরাবর ২৫ গজের তিনটি দাগ কাটা থাকে খেলোয়াড়রা মাঠের কোন অবস্থানে আছেন তা বোঝানোর জন্য। প্রত্যেক পিচের শেষে একটি ৪ গজ চওড়া গোল থাকে এবং গোলের চারধারে ১৬ গজের একটি দাগ আঁকা থাকে। গোল করতে হলে ১৬ গজের দাগের ভিতরে এসে করতে হয়। এই দাগের বাইরে থেকে করা গোল কোনও পয়েন্ট পায় না। যে লাঠিটি খেলোয়াড়রা ব্যবহার করেন, কেবলমাত্র তার চ্যাপ্টা অংশটি দিয়েই বলে আঘাত করতে হয়। যদি লাঠির অন্য কোনও প্রান্ত বলে আঘাত করে, তবে তা ‘ফাউল’ (Foul) বলে ঘোষিত হয়। সুরক্ষার জন্য খেলোয়াড়দের গায়ে থাকে ‘গাম-শিল্ড’ (Gum Shield) এবং পায়ে থাকে ‘শিন প্যাড’ (Shin Pad) আর গোলরক্ষক অনেকগুলি প্যাড পরে থাকেন। তাছাড়া একটি হেলমেট, একটি মুখোশ, প্যাডযুক্ত গ্লাভস এবং একটি বক্ষ আবরক (Chest Guard) পরে থাকেন গোলরক্ষক। লাঠি দিয়ে বল আঘাত করার সময় শরীরের কোনও অংশে যাতে স্পর্শ না করে সেদিকে খেলোয়াড়দের খেয়াল রাখতে হবে। একটি ৫ মিনিটের বিরতি বাদে ৩৫ মিনিটের দুটি অর্ধ মিলিয়ে মোট ৭০ মিনিট ধরে খেলা হয়। প্রত্যেক দলে এগার জন খেলোয়াড়ের পাশাপাশি ৬ জন করে বিকল্প খেলোয়াড়ও থাকেন। বলের বদলে খেলোয়াড়কে ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করা হলে, বলকে আঘাত করে শরীরের কোনও অংশ ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করলে কিংবা কোমরের উপরে লাঠিটি তুলে ধরলে ফাউল ডাকা হয়।    

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে এই খেলায় প্রায় একশ জন গ্রামবাসী অংশ নিত। প্রায় পনের দিন ধরে এই খেলা চলত সেই সময়। খেলায় সেই সময় একজন রেফারি থাকলেও তাঁর খুব একটা গুরুত্ব ছিল না। ধীরে ধীরে খেলার নিয়ম-কানুন বদলাতে থাকে এবং একশ জনের বদলে মোট তিরিশ জন গ্রামবাসীকে নিয়ে হকি খেলা শুরু হয়। পরে ইংল্যান্ডের এটন কলেজ এই খেলায় বেশ কিছু নিয়মনীতি নতুন করে যুক্ত করে। গ্রিসে বা মিশরে হকি খেলার উৎপত্তি হলেও ইংল্যান্ডেই এই খেলার একটি পূর্ণ রূপ গড়ে ওঠে। আগে ফিল্ড হকিতে অফসাইডের বিশেষ একটি নিয়ম ছিল। মাঠে বলের আগে কোনও খেলোয়াড় থাকলে এবং তার পিছনে অন্তত দুজন বিপক্ষীয় খেলোয়াড় না থাকলে অফসাইড ডাকা হত, যা ১৯৯৬ সালের অলিম্পিকের পরে খেলার নিয়ম থেকে বাদ দেওয়া হয়। বর্তমানে ২০১৬ সালের পর থেকে ৭০ মিনিটের বদলে ৬০ মিনিটে অনুষ্ঠিত হয় হকি খেলা। এর মধ্যে ১৫ মিনিট করে চারটি অংশে বিভক্ত রয়েছে সমগ্র খেলাটি। লং কর্নার মারার নিয়ম এখন ২৩ গজের লাইন থেকে। ১৯৯২ সালের পর থেকে হকিতে অফসাইডের নিয়মটিই অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।    

ভারতেও এই হকি খেলার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। খুব বেশি সরঞ্জাম না লাগায় এবং খেলার পদ্ধতি মোটামুটি সরল হওয়ায় ভারতে খুব দ্রুত এই খেলার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ১৮৫৫ সালে কলকাতায় ভারতের প্রথম হকি ক্লাব স্থাপিত হয়েছিল। পরবর্তী কয়েক দশকের মধ্যেই কলকাতার বেইটন কাপ এবং বম্বের আগা খান টুর্নামেন্ট হকি খেলার অন্যতম প্রধান দুটি প্রতিযোগিতার রূপ নেয় ভারতে। ১৯০৭ ও ১৯০৮ সালে ভারতে হকি অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হলেও তা বাস্তুবায়িত হয়নি, এর অনেক পরে ১৯২৫ সালে তৈরি হয় ‘ইন্ডিয়ান হকি ফেডারেশন’ (Indian Hockey Fedaration)। ১৯২৬ সালে  এই ফেডারেশনের পক্ষ থেকে নিউজিল্যান্ডে প্রথম আন্তর্জাতিক সফর আয়োজিত হয় এবং সেখানে ভারতের পুরুষ হকি দল ২১টি ম্যাচের মধ্যে ১৮টিতেই জয়লাভ করে। সেই সময় থেকেই ভারতের অন্যতম বিখ্যাত হকি খেলোয়াড় হিসেবে ধ্যানচাঁদের উত্থান ঘটে। ১৯২৭ সালে ভারতীয় হকি ফেডারেশন ‘ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল দ্য হকি’-র সদস্য হয় এবং ১৯২৮ সালে প্রথম ভারতীয় হকি দল অলিম্পিকে অংশ নেয় এবং প্রথম স্বর্ণপদক অর্জন করে। ১৯৩২ ও ১৯৩৬ সালেও ভারত অলিম্পিকে স্বর্ণপদক পায়। ১৯৮২ সালে দিল্লিতে আয়োজিত এশিয়ান গেমসে ভারতীয় মহিলা হকি দল প্রথম অংশগ্রহণ করে। ধ্যানচাঁদ, রূপ সিং, বলবীর সিং সিনিয়র, অরিজিত পাল সিং, শঙ্কর লক্ষ্মণ, ধনরাজ পিল্লে প্রমুখরা ভারতের হকি খেলাকে বিশ্বের দরবারে এক অন্যতর উচ্চতা দিয়েছেন। ধ্যানচাঁদকে তো ভারতের ‘হকির জাদুকর’ বলা হয়। ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশেও হকি খেলা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ১৯১০ সাল নাগাদ। ১৯৭২ সালে ‘বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন’ গঠিত হয়।  

আপনার মতামত জানান