ত্রিস্রোতা মন্দিরটি জলপাইগুড়ি জেলার তিস্তা নদীর তীরে অবস্থিত। এটি একান্ন সতীপীঠের মধ্যে অন্যতম একটি পীঠ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর বাঁ পা পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী ভ্রামরী এবং ভৈরবের নাম ঈশ্বর।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। বলা হয় ত্রিস্রোতা সতীপীঠে সতীর বাঁ পা পড়েছিল। পীঠ নির্ণয়তন্ত্র অনুসারে ত্রিস্রোতা হল ষষ্টদশ সতীপীঠ।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে পৃথিবীতে একসময় অরুনাসুর নামে অত্যাচারী এক অসুরের বাস ছিল। স্বর্গের দেবতাদের সে নানাভাবে হেনস্তা করত। এমনকি দেবপত্নীরাও এই অসুরের হাত থেকে মুক্তি পায়নি। একসময় অরুণাসুরের অত্যাচারের সহ্যের সীমা পেরিয়ে যায়। তখন তাঁর হাত থেকে বাঁচতে দেবতারা দেবী দুর্গার শরনাপন্ন হন। দেবী দুর্গা অরুণাসুরকে পরাজিত করতে অসংখ্য ভ্রমরের রূপ ধারণ করেন। সেই থেকে দেবী ভ্রামরী নামে পরিচিত। আবার অন্য কাহিনী অনুসারে অরুণাসুর কৈলাস আক্রমণ করে দেবাদিদেব মহাদেবকে পরাজিত করেন। তখন দেবী পার্বতী অসংখ্য ভ্রমরের সৃষ্টি করে এই অসুরের বিনাস করেন। সেই ভ্রমরেরা পরে দেবীর অলঙ্কার হিসাবে সজ্জিত থাকত। সেই থেকেই দেবী ভ্রামরী নামে পরিচিত।
ত্রিস্রোতা মন্দিরকে অনেকটা সাপের মতো পেঁচিয়ে তিস্তা নদী এখানে তিনটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। তারই মধ্যেকার স্থানে মন্দিরটি অবস্থান করছে বলে এই মন্দির ত্রিস্রোতা নামে পরিচিত। মন্দিরে প্রবেশের রাস্তাটি খুব সুন্দর। চারপাশে শাল-সেগুনের সারি।মন্দিরের প্রবেশদ্বারের ওপর শিব পার্বতীর মূর্তি রয়েছে। এখান দিয়ে প্রবেশ করে মূল দেবীমন্দিরের দরজার ঠিক বাঁদিকে রয়েছে সিদ্ধিদাতা গণেশের মূর্তি। মূল মন্দিরে রয়েছে দেবীমূর্তি। এর বাঁপাশে রয়েছে অন্য আরেকটি মন্দিরগৃহ। সেখানে রয়েছে বেশ কিছু দেবদেবীর মূর্তি। ডানদিকে রয়েছে জোড়াবট। দুটি বটগাছ গোড়ায় আলাদা হলেও ওপরে এসে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। এই মন্দিরে বলি নিষেধ। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে আগে বলিপ্রথা চালু থাকলেও একবার পরপর তিন বার বলির পাঁঠা হারিয়ে যায়। তখন থেকেই এই প্রথা বন্ধ আছে।
মূল মন্দিরে প্রবেশ করলেই সামনে দেবীমূর্তি। কালীমূর্তির মত দেবী শিবের ওপরে থাকলেও দেবীর জিভ বের করা নেই। দেবী এখানে সিংহবাহিনী এবং অষ্টভুজা। দেবীমূর্তির ডানপাশে আছে মহাদেবের মূর্তি এবং সেই মূর্তির পাশে রয়েছে নন্দীর মূর্তি। এই কক্ষ থেকে কয়েকধাপ নীচে সিঁড়ি বেয়ে নামলেই মায়ের গর্ভগৃহ। এখানেও রয়েছে একটি দেবীমূর্তি। দেবী এখানে সিংহবাহিনী এবং কৃষ্ণবর্ণা। তাঁর সামনেই বেদীতে রাখা আছে দেবীর প্রস্তরীভূত বাঁ পা।
প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী ও ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকেন। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। ত্রিস্রোতা মন্দিরে অধিষ্ঠিত দেবীর নাম ভ্রামরী এবং ভৈরবের নাম ঈশ্বর।
মন্দিরে অন্ন ভোগ হলেও মাছ দেওয়া হয় না, কাটা ফলও নয়। সারাবছর ধরেই মায়ের আরাধনা করা হয়। তবে নবরাত্রিতে বেশ বড় করে উৎসব হয় এখানে। এছাড়াও অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উৎসবগুলো হল মকর সংক্রান্তি, রাম নবমী, দীপান্বিতা কালীপূজা ইত্যাদি। এইসব উৎসবে দেবীর বিশেষ পূজা করা হয় এবং মন্দিরে প্রচুর ভিড় হয়।
এই সতীপীঠ নিয়ে বিস্তারিত ভিডিও দেখুন এখানে